সংসদে বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনে বরাবরের মতো এবারও পেশ করা হয়েছে ‘আর্থিক সমীক্ষা’ রিপোর্ট। দেশের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের ভাবনার প্রকাশ ঘটে সাধারণত এই রিপোর্টে। মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অনন্ত নাগেশ্বরণের তৈরি এই রিপোর্টে দেশবাসীর অর্থনৈতিক জীবনের অনেকগুলি নির্মম বাস্তবকে এড়িয়ে গেলেও সবগুলিকে আড়াল করা সম্ভব হয়নি। সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়ে তেমন কিছু জরুরি বিষয় রিপোর্টে জায়গা দিতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। তা নাহলে ৫২২ পৃষ্ঠার অতিকায় রিপোর্টটি হাস্যকর হয়ে যেত সেটা নাগেশ্বরণ বুঝতে পেরেছেন। তাই দু’কূল বাঁচিয়ে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে রিপোর্ট তৈরির চেষ্টা করেছেন। আর সেটা করতে গিয়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনেক ভাষ্যের সঙ্গে পুরোপুরি তাল মেলাতে পারেননি। তার ফলে বিরোধীরা যে বিষয়গুলি জোরালো তুলে ধরছেন এত বছর ধরে আর অনেকগুলিকেই স্বীকার করতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য নেতা-মন্ত্রীরা সাফল্যের ঢাক পেটালেও সঙ্কট নিরসনে সরকারি ব্যর্থতা আড়াল করা যায়নি। যেমন গত অর্থবর্ষে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশকে মোদী স্বগর্বে ট্রেলার বলে চিহ্নিত করে পুরোছবিতে আরও বড় সাফল্যের বার্তা দিয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক সমীক্ষায় ট্রেলারের অনেকটা নিচে নেমে গেছে বৃদ্ধির হার (৬.৫-৭ শতাংশ)। প্রধানমন্ত্রী সুপারহিট ছবি দেখাবেন বললেও আর্থিক সমীক্ষা সেটা নাকচ করে দিয়েছে।
মোদী জমানায় দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে নির্মম সত্য হলো ভয়াবহ বেকারি। দেশে যে হারে কাজের বাজারে নতুন কর্মপ্রার্থী প্রতি বছর যোগ দিচ্ছে কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে অনেক কম। ফলে কর্মহীনতার মাত্রা বেড়েই চলেছে। যারা কাজ পাচ্ছেন যোগ্যতার থেকে অনেক নিম্নমানের কাজ তাদের করতে হচ্ছে অনেক কম মজুরিতে। চাকরির জোগানের থেকে চাকরির চাহিদা অনেক বেশি হওয়া প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। তাই মজুরি হ্রাস পেয়ে গেছে। এই সত্য আড়াল করা যায়নি। এমনকি কিছুদিন আগে দু’-তিন বছরে সাড়ে আট কোটি কাজ তাঁর সরকার সৃষ্টি করেছে বলে প্রধানমন্ত্রী দাবি করলেও সমীক্ষার তথ্য-পরিসংখ্যানে তার সত্যতা মেলেনি। সমীক্ষা এটা জানাতে বাধ্য হয়েছে যে বৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশি হলেও কর্মসংস্থা সৃষ্টিতে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
মোদী এবং তাঁর অনুগতরা অর্থনীতির সাফল্য নিয়ে বরাবর প্রবল উচ্ছ্বাস দেখালেও সমীক্ষা রিপোর্ট কিন্তু অনেকটাই সংযত। দায়বদ্ধতা থেকে আশাবাদী হলেও নাগেশ্বরণ কিন্তু অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা এড়াতে পারেননি। আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক অবস্থার অনিশ্চয়তা, চীনের সঙ্গে আমেরিকা ইউরোপের তিক্ত বাণিজ্য সম্পর্ক এবং চীনের পুঁজি ভারতে লগ্নিতে ও চীন থেকে আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতির বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে সেটা রিপোর্টে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তেমনি মৃদু উদ্বেগও ফুটে উঠেছে সম্পদ ও আয় বৈষম্য তীব্র গতিতে বাড়ার ফলে। অর্থাৎ মোদী জমানায় কর্পোরেট বান্ধব অর্থনীতির ভয়ঙ্কর পরিণতিই যে এই বৈষম্য তা মানতে হয়েছে। অবশ্য মূল্যবৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে আড়াল করে মোদীকে খানিকটা স্বস্তি দেবার চেষ্টা হয়েছে। আসলে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র বিরুদ্ধে হাওয়া ঘোরার ইঙ্গিত পেয়ে বিরোধীদের তোলা ইস্যুগুলি নিয়ে পদক্ষেপের ভাবনা উসকে দেওয়া হয়েছে। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে সরকার বেকারি-বৈষম্য, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে পদক্ষেপ করবে।
Comments :0