Anganwadi

মায়ের মুখের স্ক্যান মিললে তবে শিশুর পাতে খাবার!

রাজ্য

অভিভাবকের মুখের ছবি মিললে তবেই শিশুদের পাতে পড়বে রান্না করা খাবার! সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার। কেন্দ্রের এই ফরমান মেনে নিয়েছে রাজ্য সরকারও। 

সঙ্গে টিফিন কৌটো নিয়ে এখন শিশুরা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আসে। নিজের কিংবা ভাই-বোনের প্রাপ্য রান্না করা খাবার নিয়ে চলে যায় বাড়িতে। সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন করছে কেন্দ্রীয় শিশু ও নারী কল্যাণ মন্ত্রক। ইতিমধ্যে দেশের সব রাজ্য সরকারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। শুধু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আসা শিশুরাই নয়। মন্ত্রকের এফআরএস(ফেস রেকগনেশন সিস্টেম) ব্যবস্থায় যুক্ত করা হবে প্রসূতি ও সদ্যোজাত সন্তানের মায়েদেরও। আইসিডিএস প্রকল্পের আওতায় থাকা এই মহিলাদেরও খাবার পৌঁছে দেওয়ার আগে করতে হবে মুখের স্ক্যান!

১ জুলাই থেকে এই ব্যবস্থা আইসিডিএস সেন্টারে প্রসূতিদের জন্য কার্যকরী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আগস্ট মাসের শুরু থেকে শিশুদের জন্য মুখের স্ক্যান করার পর খাবার বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় সরকারের এই একতরফা সিদ্ধান্তে গরিব পরিবারের শিশুরা প্রকল্পের আওতা থেকে বাদ চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডের সংযোগের পর আঙুলের ছাপ দিয়ে রেশন তোলার ব্যবস্থায় এরাজ্যের সঙ্গে গোটা দেশের আদিবাসী প্রধান এলাকার মানুষ রেশন থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে। এরাজ্যেও রেশন দোকানে বহু সময় আঙুলের ছাপ না মেলায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রেশন প্রাপ্তি। তখন ফের সরকারি দপ্তরে ছোটাছুটি করে ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে রেশন প্রাপ্তি। তাতেও দু’মাস সময় চলে যাচ্ছে। কিন্তু আইসিডিএস প্রকল্পে সরকারের এই সিদ্ধান্তে অশনি সঙ্কেত দেখছেন কর্মীরা। 

এরাজ্যে আইসিডিএস’এ ৫৭৬টি প্রকল্প চালু আছে। এই প্রকল্পগুলিতে রাজ্যের প্রায় ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৪০০র ওপর আইসিডিএস সেন্টারে শিশু ও প্রসূতি মিলিয়ে প্রায় ৯৬ লক্ষাধিক উপভোক্তা আছে। বিপুল অংশের গরিব মানুষকে এখন মোবাইলের সঙ্গে আধার সংযোগ করে মুখের ছবি স্ক্যান করতে হবে। কেন্দ্রের এই নির্দেশিকা পাওয়ার পর কোনও প্রশ্ন না তুলে তা বাস্তবায়িত করতে নেমে পড়েছে রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর। সিআইটিইউ অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ আইসিডিএস কর্মী সমিতির কার্যকরী সভানেত্রী ইন্দ্রাণী মুখার্জি জানান,‘‘ অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারে উপভোক্তাদের জন্য ই-কেওয়াইসি’র সিদ্ধান্ত অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব। সরকারের এই পরিকল্পান নির্ভর করছে গরিব মানুষের হাতে একটা মোবাইল ফোন থাকার ওপর। এখন তো মানুষ রিচার্জ করার পয়সা জোগাড় করতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ মোবাইল অকেজো। সিম কার্ড নষ্ট করে ফেলেছে। প্রায় সব সেন্টারেই এই ঘটনা। ফলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গরিব মানুষের ঘরের ছেলেমেয়েরা আর খাবার পাবে না।’’ 

চলতি মাসে কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক থেকে সব রাজ্যের মুখ্যসচিব ও দপ্তরের প্রধান সচিবদের কাছে একটি নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে। তাতেই বাধ্যতামূলকভাবে শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবক ও প্রসূতিদের ক্ষেত্রে নিজেদের মুখের ছবি স্ক্যান করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিশুদের উপস্থিতিকে তদারকি করার জন্য এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। 

আইসিডিএস সেন্টারে আসা শিশুদের জন্য প্রথমে তাদের অভিভাবকের মোবাইলের সঙ্গে আধার কার্ডের সংযোগ করতে হবে। সংযুক্তির পর সেই মোবাইল নাম্বারে ‘ওটিপি’ আসবে। তারপর সেই ওটিপি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী তাঁর নিজস্ব মোবাইলে ‘পিএম পোষণ’ অ্যাপে দেওয়ার পরের ধাপে শিশুর অভিভাবকের ছবি তুলে আপলোড করতে হবে। আপলোডের সময় আধার কার্ডের অভিভাবকের ছবির সঙ্গে আইসিডিএস কর্মীর তোলা ছবি মেলার পর গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তাই শুরুতে শিশু ও মায়েদের খাবারের জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ‘ই-কেওয়াইসি’র ওপর।

এরাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের অভিজ্ঞতা কী?

সব থেকে বেশি সমস্যার মুখে পড়েছেন মোবাইল নিয়ে। গ্রামের গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরাই এখনও আসছে আইসিডিএস সেন্টারে। কিন্তু অধিকাংশ বাবা-মা মোবাইল ব্যবহার করতে পারছেন না। বিশেষ করে রিচার্জের খরচ বেড়ে যাওয়ার পর থেকে মাসের দীর্ঘ সময় মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন গরিব মানুষ। দক্ষিণবঙ্গের এক  জেলার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর অভিজ্ঞতা, ‘‘ এক সময় যে মোবাইল নাম্বার ছিল তা দিয়ে আধার কার্ডের লিঙ্ক করাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে সেই নাম্বারের আর অস্তিত্ব নেই। এমনও ঘটনা ঘটছে, আধারের সঙ্গে মোবাইলের লিঙ্ক করাতে গিয়ে ওটিপি কোথায় যাচ্ছে, তার আর হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।’’ 

একসময় আইসিডিএস কর্মীদের কাছ থেকে শিশুদের অভিভাবকদের মোবাইল নাম্বার নথিভুক্ত করার নির্দেশিকা এসেছিল। তখনই সমস্যাটা টের পেয়ে আধিকারিকদের জানিয়েছিলেন কর্মীরা। কিন্তু সরকারি ফরমান মানার জন্য কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, একজন কর্মী তাঁর নিজস্ব মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে তিনজনের নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন। বাকিটা পাড়া, পড়শি, আত্মীয়, স্বজন, যে কারোর মোবাইল নাম্বার দিয়ে নথিভুক্ত করার। এখন সেই মোবাইল দিয়ে আধার সংযোগ করতে গিয়ে খোঁজ মিলছে না, কোথায় যাচ্ছে ‘ওটিপি’! আর ‘ওটিপি’ না পাওয়ার জন্য ফেস রেকগনিশন সিস্টেমে অভিভাবকদের মুখের ছবি স্ক্যান করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নির্দেশিকাতে অবশ্য একবারই স্ক্যান করার পর খাবার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, আগামীদিনে খাবার দেওয়ার সময় ফি দিন স্ক্যান করা বাধ্যতামূলক করা হবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে আইসিডিএস কর্মীদের মধ্যে। গোটা দেশে আইসিডিএস সংগঠনগুলি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের এই ফরমানের বিরুদ্ধে বৈঠক বসে। আগামী ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রতিবাদ পত্র পাঠাবে কর্মী সংগঠনগুলির মঞ্চ। একইসঙ্গ প্রতিটি রাজ্যে আইসিডিএস প্রকল্পের ডিরেক্টরের কাছেও অভিযোগ জানানো হবে।

Comments :0

Login to leave a comment