TMC Corruption

জঙ্গলের জমিতেও নজর তৃণমূলের

ফিচার পাতা

Forest Land TMC Corruption

 

পাথপ্রতিম নাগ

অরণ্যাঞ্চল জুড়ে বিস্তর জনসম্পদ তথা জমি বেচে দিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর প্রকল্প গড়া ও এটাকে নিজেদের সাফল্য বলে নিজেরাই ঢাক পেটানোর কাজে একই উৎসাহ কেন্দ্রের মোদী আর এই রাজ্যের তৃণমূলের সরকারের। নবান্ন থেকে অতি সম্প্রতি ঘোষিত রাজ্যের তৃণমূল সরকার নিজেদের হাতে থাকা ২০হাজার একর জমি বিক্রি করার যে ছাড়পত্র দিয়েছে তার থেকেই তা প্রমাণিত হয়ে যায়। বেশ বোঝা যাচ্ছে, দেশ ও দেশের সম্পদ বিক্রি করে কর্পোরেটদের পুঁজি বাড়ানোর পরিকল্পনায় এই দুই সরকারই সমানভাবে উৎসাহী। সেই কারণেই বিপুল কর্পোরেট ফান্ডিং জোটে তাদের রাজনৈতিক দলের কপালে।

সরকারি জমি এভাবে বিক্রি করে টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারার পরিকল্পনা এখানেই শেষ নয়। নতুন নতুন ক্ষেত্রে এমন চক্রান্ত চলছে সমানে সমানে। এখন তৃণমূল সরকারের লোভের নজর গিয়ে পড়েছে রাজ্যের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় উদ্যান ভূমিতে। উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা ও মালবাজার উদ্যান ঘিরে ব্যাপক বেসরকারিকরণ তারই একটি ধাপ। এটা যে এখন আর কোনও প্রকার কল্পনাশ্রিত অভিযোগ নয় বরং তা বাস্তব তার প্রমাণ রাজ্য সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ। গত ২০২১ সালেই এই বিষয়ে প্রথম পর্বে অত্যন্ত গোপনে সরকারি সার্কুলার তৈরি করে রাখা হয়েছিল। ইডেন উদ্যান থেকে রাজ্য সরকারের আধিকারিকদের দিয়ে তৈরি করা সেই সার্কুলারেই বলা আছে, জলপাইগুড়ির উল্লিখিত দু’টি উদ্যান ছাড়াও উত্তরবঙ্গেই বালুরঘাট উদ্যান এবং কোচবিহারের এনএন উদ্যানে চলতি ইংরেজি বছর ২০২৩-এর  শুরুর দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে বন বিভাগের উদ্যোগে অর্থাৎ তাদের অনুমোদন নিয়ে ভাড়া দেওয়া যাবে। এরফলে এবার থেকে যে কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বিয়ের অনুষ্ঠানে ৫০হাজার, জন্মদিন হলে ২৫হাজার, কনফারেন্স হলে ১৫হাজার, প্রাক বৈবাহিক অনুষ্ঠানে ১১হাজার টাকা ভাড়ায় তা ব্যবহার করতে পারবেন।

বিপত্তি হলো, রাজ্য সরকারের এমন ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন জলপাইগুড়ি সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে এবং দক্ষিণবঙ্গেও রীতিমতো অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। অরণ্য ও প্রকৃতিপ্রেমী এবং সেই সঙ্গে পরিবেশবিদরা পরিবেশ নষ্ট নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিভিন্ন মহলে। সরকারি বন দপ্তরে স্থায়ী এবং অস্থায়ী কর্মীরাও প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন। তার প্রতিফলনও ঘটতে শুরু করে দিয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, এলাকাবাসী ও সাধারণের পক্ষে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের এই পরিবেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত প্রতিরোধের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘উদ্যান বাঁচাও মঞ্চ’। এই মঞ্চের পক্ষে ইতিমধ্যেই সংগঠিত হয়েছে একটি গণকনভেনশন। গত ২৯ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি শহরে নেতাজী ফাউন্ডেশন হলে সেই কনভেনশন আয়োজিত হয়েছিল। কনভেনশনে ছিলেন বামফ্রন্টের শরিক দলগুলি এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধিরাও। ছিলেন বহু বিশিষ্টজন। সেই কনভেনশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮ জানুয়ারি জলপাইগুড়ির জেলা শাসক ও রাজ্যের মুখ্য বনপালের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। এরপর এই উদ্যান বাঁচাও মঞ্চের পক্ষে ২৩ জানুয়ারি তিস্তা উদ্যান সহ অন্যত্রও উদ্যান বাঁচানোর দাবি নিয়ে দিনভর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।


এই মর্মে ঐদিন থেকেই চলছে গণস্বাক্ষর অভিযান। উদ্যান বাঁচাও মঞ্চের আওয়াজ, রাজ্য সরকারকে এধরনের জন বিরোধী ও পরিবেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে। প্রত্যাহার করে নিতে হবে জনস্বার্থ বিরোধী এই সিদ্ধান্ত। কারণ এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক পরিবেশ রক্ষা সনদ এবং বনাঞ্চল সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী। আমাদের দেশের সংবিধানের ৪৬/৪৮এ অনুচ্ছেদে বন্য প্রাণীর এবং একই সঙ্গে পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে যে নির্দেশিকা রয়েছে তার মান্যতা দিতেই হবে। সংবিধানেই ৫১এ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, অরণ্য-প্রকৃতি, তার পরিবেশ, জলাভূমি, নদী-নালা রক্ষা করার ক্ষেত্রে প্রতি নাগরিক এবং সরকারগুলির দায়িত্ব রয়েছে এবং তা রক্ষা করতেই হবে।


উদ্যান বাঁচাও মঞ্চের পক্ষে আরো বলা হয়েছে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার তার অভিসন্ধিমূলক সার্কুলার কার্যকর করলে শুধু অরণ্য পরিবেশই বিঘ্নিত হবে না শিশুদের মনোজগত জুড়ে ঘটে যাবে ব্যাপক বিপর্যয়। শিশুদের কোমল মনের বিনোদন, মুক্ত মনের বিকাশ সবই ধ্বংস হতে বাধ্য। কেবল মাত্র রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানো জনকল্যাণকামী কোনও সরকারের লক্ষ্য হতে পারে না। এই ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থা কার্যকরী হলে জঙ্গল থেকে নানা প্রজাতির প্রাণী, কীট-পতঙ্গ এবং উদ্ভিদ সব শেষ হয়ে যাবে। এমনিতেই পরিবেশে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, দূষণ বাড়ছে। তার ওপরে জঙ্গলের অধিকার কর্পোরেট মুনাফাখোরদের গ্রাসে চলে গেলে অরণ্যের শান্তিও ধ্বংস হবে যা সেখানকার প্রাণীদের বিপন্ন করবে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল সাব অর্ডিনেট ফরেস্ট সার্কেল অ্যাসোসিয়েশন নেতৃত্ব রাজ্য সরকারের ঐ তথাকথিত বাণিজ্যিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সার্কুলারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এই রাজ্য সরকার চাইছে সরকারের হাতে থাকা অরণ্য সম্পদের বেসরকারিকরণ, এরজন্যই স্থায়ী পদের বিলোপ সাধন করে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে এবং তাঁদের মাত্রারিক্ত শোষণ ও বঞ্চনা করা হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর জীবন রক্ষার ক্ষেত্রেও এই সরকার উদাসীন।



উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান বা গোরুমারা বন উদ্যান থেকে শুরু করে  দক্ষিণবঙ্গ ও পশ্চিমাঞ্চলের বনাঞ্চলও চলে যাবে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে। রক্ষা করা যাবে না ঐতিহাসিক ইডেন উদ্যান, বিধাননগরের ‘বনবিথি’, ঝাড়গ্রামের বীরসা মুণ্ডা নামাঙ্কিত জঙ্গল, পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী বা অযোধ্যা পাহাড়ের লাগোয়া প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। বাঁকুড়ার সিমলিপাল জঙ্গলও ছারখার হয়ে যাবে অচিরেই। নদীয়ার বেথুয়াডহরি জঙ্গল ও সরকারি উদ্যানও হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুন্দরবনের ঝাড়খালিতে কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকার ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা তারই প্রতিচ্ছবি। দেশি ও বিদেশী ধনী ব্যক্তিদের ফূর্তি ও নিছক বিনোদনের জন্যই এই আয়োজন। অরণ্য প্রকৃতির এরূপ ধ্বংসলীলা বন্ধ করতেই গড়ে উঠছে বিভিন্ন সরকারি উদ্যান ও অরণ্যাঞ্চলে দখলের প্রতিরোধী আন্দোলন। জনমত যত গড়ে উঠছে ততোই শক্তিশালী হয়ে উঠছে এই আন্দোলন।


নিছক অর্থনৈতিক সূচকে উন্নয়নকে মাপার ধারণা সারা দুনিয়াতে পরিত্যক্ত। মানবোন্নয়ন ও সাসটেনেবল বা স্থিতিশীল উন্নয়নের দাবিতে বিশ্বজুড়ে মানুষ সরব হচ্ছেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘও সব দেশের সরকারকে সেটাই মানতে বলছে। ভারতও তা মানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অথচ কার্যক্ষেত্রে এসে উলটোটা ঘটাচ্ছে। স্থিতিশীলতার অন্যতম শর্ত হলো প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে যাতে উন্নয়নের সুফল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও পৌঁছতে পারে। প্রকৃতিকে নিঃশেষিত করে অর্থ ও স্বাচ্ছন্দ্য লোটাকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলা চলে না, কারণ তা স্থিতিশীল নয়। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করার ফল ভুগতে হবে আগামী প্রজন্মকে। যোশীমঠের ঘটনায় সেটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু কর্পোরেট পুঁজি এখনই মুনাফা চায়, পরিবেশ প্রকৃতি ও আগামী প্রজন্মের প্রতি তার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। সেই কারণেই প্রকৃতিকে এই কর্পোরেট পুঁজির হাত থেকে রক্ষা করা দরকার। জলাভূমি, অরণ্যভূমি, নদী, পাহাড় একবার সরকারি মালিকানা থেকে বেসরকারি হাতে গেলে সেগুলি কর্পোরেটগ্রাসেই চলে যাবে এবং তারা সেগুলির ক্ষয়ের বিনিময়ে মুনাফা ঘটাবে। সব জেনেশুনেও মোদী সরকারের মতোই তৃণমূল সরকারও সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে। 
অথচ এর বিকল্প পথ যে রয়েছে তা এরাজ্যের বিগত বামফ্রন্ট সরকার দেখিয়েছিল। অরণ্য রক্ষার দায়িত্ব অরণ্যের অধিবাসীদের মধ্যে বণ্টন করেছিল তারা। আদিবাসীদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করে তাদের জন্য অরণ্য থেকে উপার্জনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল, এমনভাবে যাতে অরণ্যের ক্ষয় ঘটে না। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার বামপন্থীদের দাবি মেনে আদিবাসীদের অরণ্যভূমিতে পাট্টা দেওয়ার আইনও করেছিল। কারণ, বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে অরণ্য ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু সেখানে বসবাসরকারি আদিবাসীরা তা ধ্বংস হতে দেয় না, প্রকৃতিকে ঈশ্বরজ্ঞানে রক্ষা করে। বর্তমানে সেই আইনও অমান্য করে আদিবাসীদের উৎখাত চলছে। এভাবেই অরণ্যকে তুলে দেওয়া হবে কর্পোরেট পুঁজির হাতে? 
গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব আছে পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায়। কিন্তু তাদের সক্রিয়তা কই! তারা চুপ করে বসে আছে তাদের কর্পোরেট মালিকদের নির্দেশে। এসব সত্ত্বেও, একসময়ে গাছ জড়িয়ে ধরে চিপকো আন্দোলন হয়েছিল, এখন কোনও প্রতিরোধ ছাড়া অরণ্যের হাত বদল হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment