প্রসূন ভট্টাচার্য
প্যালেস্তাইনের মহিলা চিত্র সাংবাদিক সামর আবু এলাফ এই বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোগ্রাফিতে পুরস্কার পেয়েছেন ৯ বছরের একটি বালকের ছবি তুলে। ছবিটি গতবছর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল। মাহমুদ আজ্জুর নামের ঐ ৯ বছরের শিশুকে সামর আবু এলাফ দেখতে পেয়েছিলেন গাজায় হাসপাতালে। ইজরায়েলী বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাকে বাঁচানোর জন্য তার দুটি হাতই কাঁধের নিচ থেকে কেটে বাদ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। আর এই ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনটি করতে হয়েছিল কোনও অ্যানাস্থেসিয়া ছাড়া, কারণ ইজরায়েলী অবরোধের কারণে, শুধু খাদ্য নয়, গাজার হাসপাতালে চিকিৎসার ওষুধ ও সরঞ্জামেরও অভাব চলছে। অপারেশনের সময় প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল ছোট্ট আজ্জুর। ডাক্তাররা হাত কেটে তার প্রাণ বাঁচানোর পরে আজ্জুর নাকি তাঁর মাকে প্রথম প্রশ্নটা করেছিল, ‘মা, এবার আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরবো কী করে!’
নিজে নিজেই ফটোগ্রাফি শিখেছেন সামর আবু এলাফ, গাজার হাসপাতালে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আজ্জুরের ছবিটি তাঁর তোলা ‘নিছকই’ একটি পোর্ট্রেট, কিন্তু সেই আলো আর ছায়ায় মাখা পোর্ট্রেটই প্রেস ফটোগ্রাফিতে এবার পুরস্কৃত হয়েছে। জুরিদের মতে, ‘যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি ফল, শারীরিক এবং মানসিক ক্ষয়ক্ষতিকে এই ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেছে চিত্র সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার ওপর বিধিনিষেধ চাপিয়ে সেখানে গণহারে মানবিকতাকে লাঞ্ছনার যে ছবিকে আড়াল করা হচ্ছে সেটাই প্রকাশ করেছে ছবিটি।’
গতবছর রয়টার্সের সাংবাদিক মহম্মদ সালের একটি ছবি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোগ্রাফিতে পুরস্কৃত হয়েছিল, সেটাও ছিল দক্ষিণ গাজায় নাসের হাসপাতালে তোলা একটি ছবি। ইনাস আবু মামার নামের ৩৬ বছর বয়সি প্যালেস্তানীয় মা তাঁর পাঁচবছরের শিশু সন্তানের খোঁজে হাসপাতালে এলে, তাঁর হাতে সাদা কাপড়ে মোড়া সন্তানের মৃতদেহ তুলে দেওয়া হয়েছিল। সাদা কাপড়ে মোড়া সেই দেহটি কোলে জড়িয়ে কাঁদছিলেন মা। সেই ছবিকে পুরস্কৃত করেও পুরস্কারদাতারা আশা প্রকাশ করেছিলেন, মানুষের বিবেক জাগ্রত হবে, এই মানবতাবিরোধী গণহত্যা বন্ধ হবে। কিন্তু এখনও তার কোনও লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে কি?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট, রাষ্ট্রসঙ্ঘের শিশু রিপোর্ট সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে সারা বিশ্বে যতো শিশুদের হাত পা অ্যামপিউট বা বাদ দেওয়ার অপারেশন হচ্ছে তার বিপুল অংশই ঘটছে গাজায়। বিস্ময়ের কোনও কারণই নেই, কারণ ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে গাজায় ইজরায়েলী গণহত্যার অভিযানে ইতিমধ্যেই ৫২ হাজারের বেশি প্যালেস্তানীয় মারা গেছেন যার সিংহভাগই নারী ও শিশু। বোমা, গুলি কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র হানায় পালিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করায় সবচেয়ে দুর্বল অংশই প্রাণ হারাচ্ছে নির্বিচার হামলায়। অথচ এটাই নাকি ইজরায়েলের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ!
টাইম মেশিনে যদি আমরা পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যাই, তাহলেও এই এশিয়ার বুকেই যুদ্ধচিত্রের পুরস্কৃত হওয়ার নজির দেখতে পাবো। ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল মার্কিন সেনা। স্বাধীনতা ও সংযুক্তি ঘটেছিল দুই ভিয়েতনামের। কয়েকদিন আগেই হো চি মিন সিটিতে সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের উদ্যাপন করা হয়েছে, সারা দুনিয়ার শান্তি আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এই কলকাতা শহর থেকেও সংহতি আন্দোলনের কর্মীরা গিয়েছিলেন সেখানে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের সংগ্রামীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে পঞ্চাশ বছর আগের কলকাতা শহরই আওয়াজ তুলেছিল ‘তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’।
সেইসময়ে ১৯৭২ সালে নিক উট নামের এক ভিয়েতনামী চিত্র সাংবাদিক কাজ করছিলেন এপি’র হয়ে। তিনি রাস্তায় দেখতে পেয়েছিলেন মার্কিনি নাপাম বোমার আঘাতে ছুটে পালাচ্ছে মানুষজন, তারই মধ্যে আগুনে ঝলসে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে বাঁচার জন্য জামাকাপড় খুলে দৌড়াচ্ছে ৯ বছরের কিশোরী কিম ফুক। শাটার টিপেছিলেন নিউ উট, তাঁর সেই ছবি ১৯৭৩ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোগ্রাফিতে শুধু পুরস্কৃতই হয়নি, ছবিটি ভিয়েতনামে মার্কিনি বর্বরতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল বিশ্বজুড়ে।
২০২২ সালে সেই ঐতিহাসিক ফটো ক্লিকের পঞ্চাশ বছরে সিএনএন সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ষাটের কাছাকাছি বয়সি সেদিনের কিশোরী কিম ফুক’এর। তিনি বলেছিলেন, ‘সেদিনের ঘটনা আমার মনে আজও জ্বলজ্বল করছে। আমার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছিল, আর দৌড়তে দৌড়তে আমি ভাবছিলাম, ইস্ এবার আমাকে দেখে লোকে কিরকম কুৎসিত বলবে!’
মিল পাচ্ছেন ৯ বছরের প্যালেস্তানীয় বালক মাহমুদ আজ্জুর ‘মাকে এবার জড়িয়ে ধরবো কী করে’ এই ভাবনার সঙ্গে? পাবেনই তো, আসলে প্যালেস্তাইন হোক কিংবা ভিয়েতনাম অথবা দুনিয়ার অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে, সর্বত্রই ৯বছরের শিশুরা একইরকম ফুলের মতো হয়ে থাকে। কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী আর যুদ্ধোন্মাদ রাষ্ট্রই সেটা দেখতে পায় না।
১৯৭৭ সালে মার্কিনী লেখিকা সুসান সন্টাগ তাঁর বিখ্যাত ‘অন ফটোগ্রাফি’ বইতে ভিয়েতনামের প্রতীক হয়ে ওঠা সেই ছবি সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘নাপাম স্প্রেতে জ্বলতে থাকা নগ্ন বালিকার রাস্তা দিয়ে দু’হাত তুলে ছুটে যাওয়ার সেই ছবি বিশ্বের বহু সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। টেলিভিশনে কয়েকশো ঘণ্টা ধরে দেখানো বর্বরতার থেকেও সম্ভবত ঐ একটা ছবি অনেক বেশি গণবিক্ষোভ তৈরি করতে পেরেছিল।’
বাস্তবতা তাই, ভিয়েতনাম থেকে মার্কিনী সেনা প্রত্যাহারের পিছনে ভিয়েতনামের বীর সংগ্রামী জনগণের লড়াইকে বিন্দুমাত্র খাটো না করেও বলা চলে, বিশ্বজুড়ে মানুষের প্রতিবাদ, এমনকি আমেরিকার মানুষেরও প্রতিবাদ পিছু হটতে বাধ্য করেছিল মার্কিন সরকারকে। সেই প্রতিবাদের পিছনে ছিল সাহসী এবং মানবিক চিত্রসাংবাদিকতার বিশেষ ভূমিকা।
আমেরিকাও সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। পরবর্তীকালে নয়ের দশকে ইরাক যুদ্ধের সময় আমেরিকা আর স্বাধীন সাংবাদিকতাকে জায়গা দেয়নি, সাদ্দাম হুসেইনকে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী হিসাবে প্রচারে তারা মিডিয়াকে সাথি করে নিয়েছিল। কেবল এম্বেডেড জার্নালিস্ট হিসাবেই চিত্র সাংবাদিকদের তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অনুমোদন দিয়ে থাকে। প্যালেস্তাইনের বুকে ইজরায়েলও তাই করছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার কোনও পরিসর তারা সেখানে দিচ্ছে না বলে ইতিমধ্যেই গাজায় শতাধিক সাংবাদিক নিহত হয়েছে ইজরায়েলী হানায়। তবুও প্যালেস্তাইনের বুক থেকে প্রতিদিন ইজরায়েলী বর্বরতার ছবি তুলে ধরছেন বহু সাংবাদিক, এমনকি সোশাল মিডিয়াতে বহু নাগরিকও এই কাজ করছেন সাহসের সঙ্গে।
ঠিক এখানেই উঠে আসছে প্রশ্নটা। আজকের দিনে যুদ্ধচিত্রের আদৌ কি কোনও মূল্য আছে? প্রচলিত ধারণা হলো, ‘একটা ছবি হাজার শব্দের লেখার থেকে বেশি কথা বলে’। কিন্তু আর কত ছবি দরকার গাজায় ইজরায়েলী বর্বরতাকে বোঝাতে? এরপরেও সারা বিশ্বের নীরব হয়ে থাকবে? প্রশ্নটা যে কেউ নয়, তুলেছেন এবারের পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্র সাংবাদিক আবু এলাফ নিজেই। সম্প্রতি সোশাল মিডিয়াতে একটি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি সবসময় চেয়ে এসেছি এমন ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে যা এই যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, ক্ষুধায় মৃত্যুমিছিলকে বন্ধ করবে। কিন্তু আমাদের ছবি যদি ভয়ানক মর্মান্তিক ঘটনাকে থামাতেই না পারে তাহলে এই ছবির মূল্য কী? গাজায় ঘটনাবলী বোঝার জন্য আপনাদের আর কী কী ছবি দরকার?’
Palestinian war
যুদ্ধচিত্র কি মূল্যহীন হয়ে গেছে?

×
Comments :0