কালো টাকার স্তূপে যেন বাংলা!
কখনও ইডি, কখনও সিবিআই, কখনও বা আয়কর দপ্তরের তল্লাশিতে গত কয়েকমাসে এরাজ্য থেকে উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি নগদ টাকা, এমনকি রাজ্য পুলিশের তল্লাশিতেও উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা, রাজ্যের একাধিক প্রান্তে।
এবার কালো টাকার পাহাড় মিলল মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্য, তৃণমূলের বর্তমান বিধায়ক জাকির হোসেনের বাড়ি, অফিস, চালকল, গুদাম থেকে। উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ১১ কোটির বেশি। নগদ টাকার স্তূপ। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলাতেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ দুই ব্যবসায়ীর বিড়ি কারখানা থেকে আয়কর দপ্তরের তল্লাশিতে মিলেছে পাঁচ কোটিরও বেশি টাকা। শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতেই তৃণমূলী বিধায়কের বাড়ি, গুদাম, চালকল ও আলাদা দুটি বিড়ি কারখানা থেকে আয়কর দপ্তরে দশ ঘণ্টার বেশিতে মিলেছে ১৬কোটি টাকা, নগদে। যদিও তৃণমূলী বিধায়কের দাবি, বাড়ি থেকে সামান্য টাকা পাওয়া গেছে!
স্বাভাবিকভাবেই ফিরে এসেছে নিয়োগকাণ্ডে ধৃত পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জির দুটি ফ্ল্যাট থেকে নগদে ৪৯কোটি ৮০ লক্ষ উদ্ধারের সেই দৃশ্য! ২২জুলাই টালিগঞ্জের হরিদেবপুরে অর্পিতা মুখার্জির ফ্ল্যাট থেকে ইডি’র তল্লাশি অভিযানে উদ্ধার হয় নগদ ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। তার পাঁচদিন পরেই ২৭ জুলাই বেলঘরিয়ার আবাসনে পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে নগদ উদ্ধার হয়েছিল ২৭কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। তারপর সেপ্টেম্বর মাসেই চিট ফান্ড হালিশহর পৌরসভার তৃণমূলী চেয়ারম্যান রাজু সাহানীর নিউটাউনের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় নগদ ৮০ লক্ষ টাকা। ঐমাসেই মেটিয়াবুরুজ থানা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রাজ্যের এক দাপুটে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পরিবহণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে ইডি’র তল্লাশি অভিযানে খাটের তলা থেকে উদ্ধার হয় ১৮কোটির বেশি নগদ টাকা!
এবার আয়কর দপ্তরের ঝটিকা তল্লাশি অভিযানে জঙ্গিপুরের তৃণমূল বিধায়ক, প্রাক্তন মন্ত্রী, ব্যবসায়ীর বাড়ি ও চালকল থেকে মিলল নগদ ১১কোটি টাকা। বুধবার সকালে আয়কর দপ্তরের আধিকারিকরা হানা দিয়েছিলেন জাকির হোসেনের বাড়িতে। ৯টা নাগাদ সুতি থানার অরঙ্গাবাদে জাকির হোসেনের বাড়িতে শুরু হয় তল্লাশি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা বাড়ি ঘিরে রেখেছিলেন। প্রায় ১০ ঘণ্টা চলে জেরা, তল্লাশি। সেখানেই মেলে টাকার হদিশ, যদিও বুধবার আয়কর দপ্তরে আধিকারিকরা তা জানাননি। রাতভর টাকা গোনা শেষের পরে বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনা জানানো হয়।
আয়কর দপ্তরের একটি সূত্রে জানা গেছে জঙ্গিপুরে জাকির হোসেনের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় নগদে প্রায় দুই কোটি টাকার মতো। আর তাঁর চালকল ও গুদাম থেকে উদ্ধার হয় নগদ ৯কোটি টাকা। জাকির হোসেন মূলত ব্যবসায়ী, বিড়ির ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবসাতেও বিপুল বিনিয়োগ আছে। উদ্ধার হওয়া টাকা আসলে কালো টাকা বলেই দাবি আয়কর দপ্তরের। এত বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা রাখাও বেআইনি।
বুধবার রাতেই তল্লাশির পরে বাড়ির লাগোয়া অফিসে বসে সাংবাদিকের সামনে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাকির হোসেন। এমনকি তিনি বিপুল আয়কর দেন বলেও দাবি করেন। ততক্ষণে তাঁর বাড়ি, চালকল থেকে যে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধার হয়েছে তা নিয়ে কিছু বললেনি জাকির হোসেন। যদিও টাকা উদ্ধারের খবর সামনে আসতেই বৃহস্পতিবার জাকির হোসেন বলেন, বাড়ি থেকে সামান্য টাকা পেয়েছে। চালকল থেকে কতো টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছে জানেন না তিনি। বাড়িতে রাখা টাকা স্ত্রীর সম্পত্তি বলে দাবি করেছেন জাকির হোসেন।
তৃণমূলী বিধায়কের কাছে যা ‘সামান্য’ তার পরিমাণ ১১কোটি, বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণও ২ কোটির বেশি!
২০১৫ সালে অধুনা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন বিড়ি শিল্পের মালিক জাকির হোসেন। ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে জঙ্গিপুর কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন জাকির হোসেন। ভোটে জিতে মন্ত্রী হন জাকির। শ্রম দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হন তিনি। ২০২১-এ নির্বাচনের আগে নিমতিতা স্টেশনে বিস্ফোরণে জখম হয়েছিলেন জাকির হোসেন। ২০২১-এর নির্বাচনে জঙ্গিপুর কেন্দ্র থেকে ফের দাঁড়ান জাকির হোসেন। ২০২১-এ নির্বাচন কমিশনকে তিনি জানান, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ৬৭ কোটি, পাঁচ বছরে ২০কোটি থেকে ৬৭কোটি হয়ে গিয়েছিল সম্পত্তির পরিমাণ।
জাকির হোসেন ব্যবসা শুরু করেছেন শিব বিড়ি দিয়ে। খুলেছেন শিবম এডুকেশন অ্যান্ড সোসাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। মুর্শিদাবাদে সাতটিরও বেশি বিএড কলেজ, ডিএলএড কলেজ চালায় এই প্রতিষ্ঠান। জাকির হোসেনের রয়েছে চাল মিল, ডাল মিল, জুট মিল। শিক্ষা, রিয়াল এস্টেট সহ এক একটি সেক্টর দেখার জন্য রয়েছেন একজন করে ম্যানেজার। শুধু ব্যবসাই নয়। লাগাতার একের পর এক জমি কিনেছেন জাকির হোসেন। বুধবার জাকির হোসেনের ম্যানেজার অরবিন্দ দাসের বাড়িতেও হানা দেয় আয়কর দপ্তরে।
এদিন সকালে ব্যবসার সাফাই দিয়েছেন জাকির হোসেন। জাকির হোসেন বলেন, ‘‘আমার ৬০ হাজার লেবার। লেবারের টাকা ক্যাশে হ্যান্ডেল হয়। বাড়িতে সামান্য টাকা পেয়েছে। রাইস মিলে কী পেয়েছে জানি না। রাইস মিলে চাষিদের জন্য বরাদ্দ টাকা ছিল।’’ তবে এই বিপুল পরিমাণ কাঁচা টাকা কেন বাড়িতে, কারখানায় তার সদুত্তর দিতে পারছেন না জাকির হোসেন। চাল, ধান কেনার ক্ষেত্রে এত পরিমাণ নগদে লেনদেন হলে সেক্ষেত্রে আদৌ আয়কর দেওয়া হচ্ছিল কিনা সেই প্রশ্নও উঠছে। অন্যদিকে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরিও অত্যন্ত কম। হাজার বিড়ি বেঁধে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা পান শ্রমিকরা। কাজেই বিড়ি শ্রমিকদের মজুরির তত্ত্বও কার্যত ধোপে টিকছে না।
জাকির হোসেনের বাড়ি, চালকল ছাড়াও সামসেরগঞ্জের আনন্দ বিড়ি ও অরঙ্গাবাদে কল্পনা বিড়ি কারখানায় হানা দিয়েছিল আয়কর দপ্তর। দুই বিড়ি কোম্পানির মালিকই তৃণমূল কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ। বিড়ি শিল্পের পাশাপাশি ঠিকাদারির ব্যবসা রয়েছে তাঁদের। তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত ধূলিয়ান পৌরসভার বিভিন্ন কাজের বরাত পায় বিড়ি কোম্পানিগুলিই। সেখান থেকেই আরও ৫ কোটির বেশি নগদ টাকা উদ্ধার করে আয়কর দপ্তর।
জঙ্গিপুর এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তি বাড়াতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন জাকির। ২০১৮ সালের পঞ্চাতের নির্বাচনে পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য করতে জাকির হোসেনের এই যখের ধন ব্যবহার করেছিল তৃণমূল। জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ দাপিয়ে বেড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস দুষ্কৃতীরা। ২০১৭ সালে গোরু পাচার নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছিলেন জাকির হোসেন। যদিও সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীরও ধমক খান তিনি।
স্থানীয় সূত্রের দাবি, এই টাকার বড় অংশ বিড়ির ব্যবসা থেকে উঠে আসা হিসাব বহির্ভূত টাকা। বিড়ি শিল্পে শ্রমিকের মজুরি দেওয়া হয় না ঠিকমতো। জিএসটি থেকে সেস নিয়েও চলে ব্যাপক কারচুপি। এই টাকার বড় অংশ বিনিয়োগ করা হয় বিভিন্ন ব্যবসায়। তৃণমূল কংগ্রেসের বড় অংশের কর্মকাণ্ডও চলে এই টাকা দিয়েই। টাকা সামনে আসায় তাই প্রবল অস্বস্তিতে তৃণমূল কংগ্রেস।
Comments :0