editorial

মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে বিপন্ন শ্রমিক

সম্পাদকীয় বিভাগ

ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে আরও একটি কারখানা। তে‍লেঙ্গানা রাজ্যের সাঙ্গারেড়ি জেলায় সিগাচি কেমিক্যাল সংস্থার অধীন একটি কারখানায় ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের জেরে ইতিমধ্যে ৪০জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। বিস্ফোরণের সময় যারা কর্মরত ছিলেন তাদের অনেকেরই খোঁজ নেই। বিস্ফোরণের ফলে তিনতলা বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত। ফলে তার নিচে এখনো কত দেহ আছে স্পষ্ট নয়। যাদের মৃতদেহ মিলেছে এবং যারা নিখোঁজ তারা প্রধানত বিহার, ওডিশা, অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিক। পশ্চিমবঙ্গের চার শ্রমিকের মধ্যে একজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে, দু’জন নিখোঁজ ও একজন সুস্থ আছেন। ভিন রাজ্য থেকে রুজির সন্ধানে এসে কর্মস্থলে এভাবে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠছে যথাযথ নিরাপত্তাবিধির অনুপস্থিতিতে। বাইরে থেকে আসা শ্রমিকরা কাজ হারানোর ভয়ে নিরাপত্তা প্রশ্নে কথা বলার সাহস পান না। তাছাড়া শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন না থাকায় নিজেদের অজান্তে শ্রমিকরা মালিকের হাঁড়িকাঠে গলা দিয়ে বসে থাকেন।
রাসায়নিক বা ভেষজ তো বটেই যে কোনও ধরনের কলকারখানায় দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে। এমন কোনোদিন যায় না যেদিন দেশের কোথায় না কোথাও কারখানায় দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা হতাহত হয় না। কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই ঠুনকো যে কার্যত মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। কাগজে-কলমে নিরাপত্তার কড়াবিধি থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিক সেগুলি গ্রাহ্য করে না। আবার নিরাপত্তা বিধি ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কিনা সেটা নজরদারির জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনা থাকলেও তাদের অঠারো মাসে বছর। অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমেও মালিকরা নজরদারি এড়ানো নিশ্চিত করেন।
কর্মস্থলে শ্রমিকদের পূর্ণ নিরাপত্তার জন্য যে আইন আছে সেটা মানতে হলে অনেক টাকা খরচ করতে হয় মালিকদের। তাতে মুনাফার ভাগ কমে যায়। তাই নিরাপত্তার গাফিলতি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। পাশাপাশি ঢিলেঢালা নজরদারি মালিকদের আরও সুবিধা করে দেয়। নানা সূত্রে পাওয়া তথ্য পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় সাম্প্রতিককালে কলকারখানায় দুর্ঘটনা দ্রুত বাড়ছে এবং তাতে শ্রমিকদের হতাহতের ঘটনা বাড়ছে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে ১৩০ রাসায়নিক কারখানায় দুর্ঘটনায় ২৫৯ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ২৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৩০১টি জেলার বিপজ্জনক কারখানায় ১৮৬১টি বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাসায়নিক কারখানায় নিরাপত্তার জন্য ১৫টি আইন এবং ১৯বিধি আছে। এর একটাও কোথাও পুরোপুরি অনুসরণ করা হয় না। তাই দুর্ঘটনা, মৃত্যু শ্রমিকদের নিত্যসঙ্গী। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে অধিকাংশ শ্রম আইন তুলে দিয়ে চারটি শ্রম কোড বানিয়েছে। তাতে মালিকদের আরও পোয়াবারো, শ্রমিকদের সর্বনাশ। আগামী ৯ জুলাই যে সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট হতে যাচ্ছে তার দাবিগুলির মধ্যেও আছে শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি। স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা তুলে দিয়ে যত ঠিকা বা চুক্তি শ্রমিক বাড়ছে ততই শ্রমিকদের অধিকার ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক, সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে। সরকার বিকাশের কথা বলে, বেশি নিয়োগের কথা বলে, বেসরকারি বিনিয়োগের কথা বলে মালিকদের ঢালাও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। মালিকদের সর্বোচ্চ মুনাফাবৃদ্ধিই সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছে। শ্রমিক স্বার্থ দেখলে মুনাফায় টান পড়বে। তাই সরকার নীরবে পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা তাই সরকারের তালিকা থেকে বাদ হয়ে গেছে।

Comments :0

Login to leave a comment