Religious!

ধর্মের নামে অধর্ম

সম্পাদকীয় বিভাগ

মহাকুম্ভের পর এবার রামনবমী। দুটোই ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ধার্মিক মানুষরা তাদের মতো করে পালন করবেন যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এটাই স্বাভাবিক। সরকারের কাজ সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, পুণ্যার্থীদের সুরক্ষা দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হইহই করে ঢুকে পড়ছেন কদর্য উৎকট প্রচারের মাধ্যমে— এটা ধর্ম পালন করা হচ্ছে? সম্প্রতি মহাকুম্ভ মেলাকে কেন্দ্র করে গণহিস্টিরিয়া নির্মাণ করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর বিশাল ছবি সহ কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে, টেলিভিশন সঞ্চালকদের কপালে তিলক কাটিয়ে ধুন্ধুমার প্রচারের ঝড় তোলা হলো। প্রচার তুঙ্গে তোলা হলো– কুম্ভে স্নান করুন, সব পাপ ধুয়ে ফেলুন আর কাঁড়ি কাঁড়ি পুণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। এদিকে কুম্ভযাত্রীদের না ছিল সুরক্ষা, না ছিল যাতায়াতের বন্দোবস্ত, না ছিল নিরাপত্তা। ফলে বেঘোরে প্রাণ গেল অনেক মানুষের এই প্রধানমন্ত্রী আর উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর অপদার্থতায়। আচ্ছা কুম্ভে স্নানের রীতি কি মোদীজি’র আবিষ্কার নাকি আদিত্যনাথের মস্তিষ্ক প্রসূত? তাহলে ওদের পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন কেন? কেনই বা টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে এই দু’জনের প্রচার? যদি ধর্ম করতেই চাইতেন ওনারা, তাহলে কুম্ভে গিয়ে স্নান সেরে পুজো দিয়ে আসতেন। কিন্তু তা ওদের উদ্দেশ্য ছিল না। প্রধানমন্ত্রী জানেন, কোটি কোটি মানুষের স্নান, শৌচকর্ম ইত্যাদিতে ভয়ঙ্কর দূষিত হয়েছিল সঙ্গমের জল, তাই তো ওয়াটার প্রুফ জ্যাকেট পরে স্নানের দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছে তাঁকে। আসলে ধর্ম পালন করা ওদের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে অন্ধ কুসংস্কার, তীব্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে তোলা, যাতে মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ বিলুপ্ত হয়। অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার চাষ করতে সুবিধা হয়, এটা ওরা ভালোই জানেন।
একইভাবে রামনবমীকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক নেতাদের গদা, অস্ত্র হাতে লম্ফঝম্প করার উদ্দেশ্য কি? রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো? মোটেই নয়। মানুষের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ, বিভাজন এবং ক্রমান্বয়ে দাঙ্গা বাধিয়ে বিদ্বেষ-বিভাজনকে স্থায়ী রূপ দেওয়াই এদের ‘রাম ভক্তি’র মূল কারণ। না হলে অযোধ্যায় রামের মন্দির উদ্বোধনে রামের ছবির ১০ গুণ বেশি মোদীর ছবি কেন লাগানো হয়েছিল? রামের কাটআউট ৫ ফুট, আর মোদীর কাটআউট ৫০ ফুট - কেন? রামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এই তো নমুনা! এরা ধর্ম করছে, নাকি সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে? হঠাৎ ১ কোটি হিন্দু রামনবমীতে মিছিল করবে বাংলায়, এই হুঙ্কার ছেড়েছেন দুর্নীতির দায়ে জেলযাত্রা থেকে বাঁচতে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া এক তৃণমূলী নেতা। ১ কোটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ঠিকাদারি ওকে কে দিয়েছে? 
সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে এরা অত্যন্ত সুচারুভাবে ব্যবহার করছে, তার মধ্যে সুপ্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাব নির্মাণ করার জন্য। ধার্মিক মানুষ ধর্ম পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। ধার্মিক মানুষ বাড়িতে বসে অথবা তাঁর ধর্মের নির্দিষ্ট উপাসনালয়ে যান ধর্ম পালন করতে। প্রাত্যহিক ধর্মপালন যারা করেন না, এমনকি যারা আদৌ তেমন ভাবে ধার্মিকই নন, বড় বড় ধর্মীয় উৎসবে তারাও সোৎসাহে অংশগ্রহণ করেন। এতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যখন সেই উৎসবকে ঘিরে গণহিস্টিরিয়া তৈরি করা হয় একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরি করার জন্য, তখন সেই ধর্মীয় উৎসবে সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া লেগে যায়। ঠিক এই কাজটাই করছে আরএসএস নিয়ন্ত্রণাধীন সব কটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলায় সম্প্রীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে, তীব্র ঘৃণা-বিদ্বেষের বীজ ছড়াতে চাইছে এরা। সতর্ক থাকতে হবে, ধর্মের নামে যারা অধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তারা যেন এই বাংলার মাটিকে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার রক্তে সিক্ত করতে আর না পারে।  

 

Comments :0

Login to leave a comment