Madurai Party Congress

খেটে খাওয়াদের উপচে পড়া ভিড়ে এক নয়া মাদুরাই

জাতীয়

সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়: মাদুরাই 
 ‘কলকাত্তা?’ ঘাড় নাড়তেই একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে অন্ধ্র প্রদেশের প্রভাত বললেন, ‘জ্যোতি বাসু ল্যান্ড...’ লাল পার্টির সমাবেশে পা রেখে মাঝবয়সি ওই শ্রমিক আরও সহকর্মীদের নিয়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান তুলে ঢুকলেন মাঠে। সূর্য তখন মধ্য গগনে। রোদের তেজ দেখে বোঝার উপায় নেই, আগের রাতে মাদুরাই শহর ছিল বৃষ্টিস্নাত। পায়ের তলায় কাদামাটি, ভেজা ত্রিপল-কার্পেটে সেই চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল। জোর ঝড়বৃষ্টির পর যতটা গনগনে রোদ উঠেছে, তার চার গুণ জোশ নিয়ে বান্দিয়ুর রিং রোডে উপচে পড়েছিল খেটে খাওয়া মানুষের ভিড়। শরীরি ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল ফের ঝড় উঠবে। তবে সেই ঝড় প্রকৃতির নয়, মানুষের। অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কেরালা থেকে কাতারে কাতারে মানুষ এসেছেন, শুধু ‘সিপিএম পার্টি’র মিটিং বলে। আদিবাসী মহিলাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রবল দাবদাহকে হার মানতে হয় তাঁদের তেজের কাছে। 
দিন্দিগুল, কাঞ্চিপুরম, কৃষ্ণগিরি, কারুর, পুদুকোত্তাইর মতো তামিলনাডুর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারে হাজারে মানুষ রবিবার ভিড় জমান রিং রোডের পাশের খোলা জমিতে— সিপিআই(এম) ২৪তম পার্টি কংগ্রেস শেষে প্রকাশ্য সমাবেশে। কেন এসেছেন তাঁরা? দিব্যা, উত্তকুমরা তামিল ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় স্বচ্ছন্দ নন। তা-ও ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললেন, ‘ইয়ে লোগ হামারে লিয়ে সোচতে হ্যায়। কোরাপশন মে নেহি হ্যায়।’ দিব্যা তাঁর পুচকে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। ওঁরা মাঠে ঢোকার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভিল্লুপুরমের একদল যুবক চে গুয়েভারা’র ছবি দেওয়া বিরাট এক পতাকা নিয়ে মিছিল করে ঢুকছিলেন। দিব্যা ছেলেকে নিয়ে দৌড়ে গেলেন সেদিকে। চে’র পতাকার সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুললেন একরত্তির। মূল মঞ্চে তখন তামিল ভাষায় চলছে শ্রুতিনাটক। হিন্দুত্ব, আরএসএস, সঙ্ঘ এই চেনা শব্দগুলি ভেসে আসছে। সঙ্গে শোনা যাচ্ছে, ‘ওনিয়ন’, ‘পোট্যাটো’ সহ বিভিন্ন সবজির নাম আর তার পরেই জুড়ছে কমিউনিস্ট শব্দটি। অর্থ কী এর? কৌতূহল মেটাতে বহু কষ্টে কেরালার পলাক্কাড থেকে আসা একজন বলতে পারলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িকতা, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নাটক বেঁধেছেন শিল্পীরা। আর মানুষকে বোঝাচ্ছেন, এই অবস্থা থেকে একমাত্র মুক্তি ঘটাতে পারেন কমিউনিস্টরাই। যতবার কমিউনিস্ট শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে গোটা মাঠ ফেটে পড়েছে হাততালিতে। 
পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে এমনিতেই মাদুরাই শহর মুড়েছে লাল পতাকায়। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে পার্টির পতাকার পাশাপাশি প্রতীক ছাড়া ছোট ছোট লাল পতাকায় সাজানো হয় রাস্তা। মাদুরাইও ব্যতিক্রম হয়নি। শহরের বাইরের দিকে ওভারব্রিজে পর পর লাল পতাকা বহু দূর থেকেই চোখে পড়বে। তারই মধ্য দিয়ে নানা ধরনের বাজনা বাজাতে বাজাতে পরপর মিছিল আসছিল। মাদুরাই যেন আজ এভাবেই ‘রেড সিটি’ হয়ে ওঠে। সকাল হতে না হতেই বিভিন্ন জেলা থেকে পর পর বাস ঢোকে ইয়ানাইকাল রোড, তালাকুলাম সহ মাদুরাইয়ের নানা প্রান্তে। মাদুরাই কনভেনশন সেন্টার, যেখানে গত পাঁচ দিন ধরে পার্টি কংগ্রেস চলেছে, সেখানে এদিন সকাল থেকে পা রাখা কার্যত দুষ্কর হয়ে যায়। কংগ্রেসে যোগ দেওয়া প্রতিনিধিদের সঙ্গে একবার দেখা করতে, তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাতে, তাঁদের জড়িয়ে ধরতে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। কাস্তে হাতুড়ি আঁকা লাল-সাদা টুপিতে ছেয়ে গিয়েছিল কনভেনশন সেন্টারের মাঠ। পাঁচ নম্বর গেটের ঠিক মুখেই দাঁড়িয়েছিলেন এক বৃদ্ধ। সাদা ধুতি হাঁটু অবধি তুলে কোমড়ে গিঁট বাঁধা। দরদর করে ঘামছেন। হাত-পায়ের আঙুল বেশ ফোলা। নাগাপত্তিনমের এক গ্রাম থেকে বাস ধরে চলে এসেছেন তিনি। কাজ করেন খেতে। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। বগলের মধ্যে থাকা পুঁটুলি থেকে বেরিয়ে এল মোবাইল। স্মার্ট ফোনের যুগে যা ‘কী-প্যাড ফোন’ বলে পরিচিত। নিজের ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। ঠিক বোঝা না গেলেও আন্দাজ করতে পারা গেল বলছেন কমিউনিস্ট মিটিংয়ে এসেছেন। আজ আর কাজে যাবেন না। 
শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, আদিবাসী সহ সমাজের যে সমস্ত নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) নিজের লড়াইয়ে অবিচল, সেই সমস্ত অংশের মানুষ এদিন আশায় বুক বেঁধেছেন আরও একবার। বাড়ির বয়স্ক থেকে সবচেয়ে কমবয়সি সদস্যকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এমন বিরাট জনসমাগম হতে পারে বুঝেই মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে সমাবেশের জায়গা ঠিক করেন নেতৃবৃন্দ। তা-ও গোটা শহর কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে যায়। একের পর এক মিছিল, রেড ভলান্টিয়ার্স মার্চ, বিভিন্ন রকমের স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জমজমাট হয়ে ওঠে গোটা প্রাঙ্গণ। ভিড়ের মধ্যেই চোখে পড়ল, কেরালা থেকে আসা বেশ কয়েকজনের হাতে বেশ কারুকাজ করা একটি বিরাট স্ট্যান্ড। যার সামনে পিছনে মার্কসের ছবির সঙ্গেই রয়েছে মন্দির, মসজিদ, গির্জার ছবি। মোদী-শাহের ঘৃণ্য প্রচারের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত-ভাবনাকে তুলে ধরেছেন তাঁরা। 
দুপুর যত গড়িয়েছে, মাঠ তত কানায় কানায় ভরে উঠেছে। অনেকে মূল প্রাঙ্গণে ঢুকতে না পেরে বসে থেকেছেন বাইরে। চোখ রেখেছেন জায়ান্ট স্ক্রিনে। সূর্যের তেজ আসতে আসতে কমতে থাকে। আকাশে মেঘ বাসা বাঁধে। ততক্ষণে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। একের পর এক মিছিল ঢুকছে। আর মঞ্চে শুরু হয়েছে, কমরেড গ্যাংস্টারের র্যাকপ। গানে গানে তাঁরা ট্রাম্পকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ‘হাউ মেনি কিডস ইউ কিল টু ডে? হোয়াট ইওর সে?’ চার যুবক-যুবতী হাতে প্যালেস্তাইনের পতাকা নিয়ে মার্কিন মদতে গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদী স্বর হয়ে ওঠেন। তারপর ‘লালে লাল লাল রহো’র সুরে সুরে বেঁধে শুরু হয় নেতৃবৃন্দের ভাষণ। এই গোটা পর্বে মঞ্চের ডান দিকে চোখ আটকাবেই। এক জন মহিলা একটানা মূক-বধিরদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন বক্তৃতার সারমর্ম। যে ব্যবস্থা কোথাও বিশেষ দেখা যায় না।
 

Comments :0

Login to leave a comment