SUNDARBAN BUDHAKHALI MARTYRS

জমি গিলছে মুড়িগঙ্গা, নেই ক্ষতিপূরণ, হিসাব নিতে তৈরি শহীদের গ্রাম বুধাখালি

জেলা

SUNDARBAN BUDHAKHALI MARTYRS

প্রতীম দে

মুড়ি গঙ্গার ভেঙে যাওয়া বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে আঙুল দেখিয়ে বিভূতিভূষণ ভুঁঞা বলেন‘‘ওই দিকে একটু গেলে দেবু আর ঊষার বাড়ি।’’

দেবু দাস এবং ঊষা দাস। কাকদ্বীপের শহীদ দম্পতি। সিপিআই(এম) করার অপরাধে ২০১৮ সালে রাতের অন্ধকারে জীবিত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল তৃণমূল। তারপর পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে। বুধাখালির আকাশে আর মানুষ পোড়ার গন্ধ নেই। কিন্তু যেই বুধাখালি সেদিন প্রতিবাদ করতে পারেনি আজ সেই বুধাখালি ক্ষোভে ফুঁসছে। গ্রামে বাঁধ হয়নি। লক্ষ্মীর ভান্ডার পান না গ্রামের বেশির ভাগ মহিলা। আমফানের টাকা পায়নি। রাস্তা হয়নি। গ্রাম সংসদের সভায় অভাব অভিযোগ জানাতে গেলে জুটেছে অবহেলা। এমন কি হেনস্তা।

যেই বিভূতিভূষণ ভুঁঞা শহীদ দেবু দাস এবং উষা দাসের বাড়িটা দেখালেন তিনি আগে তৃণমূল করতেন। নিজেই সেই কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন‘‘আগে টিএমসি করতাম। দেবু আর ঊষাকে যখন মারা হয় তখন গোটা গ্রামে কেউ কোন কথা বলতে পারেনি ওদের ভয়ে। এখন আর ওই দল করি না।’’

কিছুটা থেমে আবার শুরু করলেন‘‘আসুন দেখবেন আসুন। আমাদের বাড়ির কী অবস্থা। টাকা দেয়নি ঘরের জন্য। বোল্ডার দিয়ে বাঁধ তৈরি করেনি। আমার ২৩ বিঘা চাষের জমি নদীতে চলে গিয়েছে, তার কোন ক্ষতিপূরণ পাইনি।’’

জমি নেই। চাষ নেই। কিন্তু সংসার তো চালাতে হবেতাই বিভূতিভূষণ ভুঁঞা এখন মিন ধরেন। বাজারে তা বিক্রি করে যা ঘরে আসে তাই দিয়ে কোনোমতে সংসার চালান তিনি। তার কথায়‘‘গত দু’বছর ১০০ দিনের কাজ হয় না গ্রামে। তাই মিন চাষ করি সংসার চালাতে। বাজারে ১০০০ মিনের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা।’’

বিভূতিভূষণ ভুঁঞা যখন এই কথা গুলি বলছেন তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে গয়ারাম মণ্ডল। তিনিও বুধাখালির বাসিন্দা। তার জমি এখনও নদী ভাঙনে যায়নি। তিনি জমিতে ধান চাষ করেন। তিনি বলেন‘‘ওর যেমন মীন চাষ করে সংসার চলছে না আমারও ধান চাষ করে সংসার চলছে না। ধান চাষ করতে গিয়ে যদি আট হাজার টাকা খরচ হয় তাহলে বাজারে সেই দাম পাচ্ছি না। তিন চার হাজার টাকায় আমায় ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।’’

গয়ারাম প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘর করার জন্য টাকা পেয়েছেন। কিন্তু  ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা নয়। পেয়েছেন ৭৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা তৃণমূলকে দিতে হয়েছে কাটমানি হিসাবে। 

বুধাখালি মৌজায় ৭০ থেকে ৮০টি পরিবারের বসবাস আগে ছিল। কিন্তু নদী ভাঙনের কারণে অনেকে বাধ্য হয়েছেন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। এখন মাত্র ৩০টি পরিবার রয়েছে গ্রামে। কিন্তু এই পরিবারের অধিকাংশ মহিলা লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের সুবিধা পান না। মানে তাঁরা মাসে ৫০০টাকা করে পান না। তাঁদের মধ্যে মায়া হালদার একজন। তিনি বলেন‘‘না। আমি লক্ষ্মীর ভান্ডার পাই না। আমাদের গ্রামে অনেকে পায় না ৫০০ টাকা।’’

এরপরের কথোপথন দেখে নেওয়া যেতে পারে।

-        দুয়ারে সরকারে গিয়েছিলেন?

-        হ্যাঁ।

-        কোন লাভ হয়নি?

-        না। অনেক বার বলেছি তৃণমূল পার্টির লোকদের তাও কিছু হয়নি।

কাকদ্বীপনামখানাউস্থিমগরাহাটের একাধিক গ্রামে গেলে এই ছবি দেখা যাচ্ছে।

তবে মায়া হালদার যে শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডার পান না তা নয়। তাঁর জমি নদী ভাঙনে ভেসে গিয়েছে। সরকার থেকে বলেছিল টাকা দেওয়া হবে তাদের। সেই টাকাও তাদের কাছে আসেনি। 

মুড়ি গঙ্গার দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বলেন‘‘ওই নদীর মাঝে আমার শ্বশুরের জমি রয়েছে। জলে ভেসে গিয়েছে। বিডিও এসে নাম নিয়ে গিয়েছিল বলেছিল টাকা দেবে কিন্তু দেয়নি।’’

মায়া হালদার সেই গ্রাম সভার সাক্ষী যেখানে বাঁধের কথা বলতে গিয়ে এক মহিলা তৃণমূলের রোষের মুখে পড়তে হয়।

তিনি বলেন‘‘আমি ওই সভায় ছিলাম। লক্ষী দি (লক্ষী ভান্ডারি) যখন বলে বোল্ডার দিয়ে বাঁধ বানিয়ে দিতে তখন টিএমসির লোকরা ওর ওপর রাগ দেখাতে থাকে। তারপর ওকে বার করে দেয় সভা থেকে।’’ 

হালকা হালকা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বাঁধের চারপাশে আরও অনেক মানুষ তখন জড়ো হয়েছেন। হঠাৎ তাদের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে বললেন‘‘আমরা বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরার কাছে যাই। গিয়ে বলেছিলাম বাঁধটা ঠিক করে দিতে। তিনি বলেনসব কাজ হয়ে গিয়েছে কোন কাজ বাকি নেই।’’

তারপর বাঁধের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘‘দেখুন দেখুন এটা ঠিক হয়েছে?’’ তিনি যখন বলছেন তখন নদীর স্রোতে এক পাঁজা ইঁটের দলা ভেসে চলে যাচ্ছে।

কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে বাঁধের জন্য টাকা এসেছে সেই টাকা খরচ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বুধাখালিঈশ্বরীপুরনান্দাভাঙাকালিয়ারারামতনু নগরে কংক্রিটের বাঁধ হয়নি। প্রায় ৫০ কিলোমিটার নদী বাঁধের কোন কাজই হয়নি।

মুড়ি গঙ্গার ড্রেজিংয়ের জন্য বরাদ্দ ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এর কোন হিসাব নেই। কত বালি তোলা হয়েছে তার কোন হিসাব নেই।

উল্লেখ্য এখনও পর্যন্ত বালি বিক্রি করে সরকারের ঘরে জমা পড়েছে ৭০ লক্ষ টাকা। অভিযোগ, সরকারি রেট হচ্ছে ২.৫ টাকা প্রতি স্কোয়ার ফুট। কিন্তু সেই বালি বিক্রি হচ্ছে ৭.৫ টাকা প্রতি স্কোয়ার ফুট। মানে পাঁচ টাকা যাচ্ছে তৃণমূলের ঘরে। 

Comments :0

Login to leave a comment