চন্দন দাস ও অনির্বাণ দে: জলঙ্গী
সকাল থেকে ঘুরলেন জলঙ্গীর বিস্তীর্ণ এলাকায়। গেলেন পদ্মাপাড়ে, কাকমারী চরে। সেখানে মহিলা, পুরুষ, যুবক, ছাত্র— কথা বললেন অনেক মানুষের সঙ্গে। কখনও দাঁড়ালেন কোনও দোকানে, কারও দাওয়ায়। কখনও কাঁটাতার আর পদ্মার কাছে গাছের ছায়ায় বসে কথা শুনলেন গ্রামবাসীদের। গ্রামবাসী মহিলারা তুললেন কাজের প্রসঙ্গ। শুনলেন অনেক। বললেন কম। বিকালে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিম সাংবাদিক সম্মেলন করলেন রানিনগরের শেখপাড়ায়, তারপর বক্তব্য রাখলেন বিরাট জনসভায়।
কী বললেন? মহম্মদ সেলিম বললেন, বিজেপি’র হাওয়া পাতলা হয়েছে। তাতে তৃণমূলও আতঙ্কিত। বিজেপি’র দৌলতে তৃণমূল এত দুর্নীতি, লুট করতে পেরেছে। আবার তৃণমূলের দৌলতেই রাজ্যে বিজেপি পা রাখতে পেরেছে। বাম এবং কংগ্রেসের মধ্যে মানুষ একটি বিকল্প পেয়েছেন। এখন সন্দেশখালির স্টিং অপারেশন, রাজ্যপালের বাড়িতে পুলিশের চিঠির মতো বিষয় নিয়ে তৃণমূল, বিজেপি আবার ভুল বোঝানোর চেষ্টা শুরু করেছে যে, লড়াই শুধু তাদের দুই দলের মধ্যেই। আবার বাইনারি তৈরির চেষ্টা। কিন্তু মানুষ জেগেছেন। গ্রাম, শহর জেগেছে। তাঁদের ঢল নেমেছে আমাদের পক্ষে। তৃণমূল ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। আমরা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানাচ্ছি। ভোট শান্তিতে হলে দেশে, রাজ্যে শান্তি ফিরবে। মোদী সরকার উৎখাত হবে। আর এ যদি সেমিফাইনাল হয়, তবে ফাইনালে নবান্ন থেকে পিসি-ভাইপোর সরকারও সরবে।
এদিন শেখপাড়ার সমাবেশে মহম্মদ সেলিম ছাড়াও ছাত্রনেতা ঐশী ঘোষ, সিপিআই(এম)’র মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা, পার্টির নেতা নবকুমার মণ্ডল, জুলফিকার আলি, কংগ্রেসের নেতা ফিরোজা বেগম, মোশারফ হোসেন, কুদ্দুস আলি, মমতাজ বেগম হীরা, জাহাঙ্গির ফকির প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভা পরিচালনা করেন পার্টির নেতা জামাল হোসেন।
মহম্মদ সেলিম বলেন, মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ। যৌবনের ঢল নেমেছে। কারণ তাদের কাজ চুরি হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ চুরি করেছে তৃণমূল। তাদের রাগ, ক্ষোভ ছিল। কিন্তু তার মধ্যে সন্ত্রাস, পুলিশের মিথ্যা মামলার কারণে অনেকে মুখ খুলতে পারতেন না। সেই আগল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই জন্য মানুষের উৎসাহ। আমাদের বা কংগ্রেসের পুরানো সমর্থক যাঁরা সন্ত্রাস, পুলিশি জুলুমের কারণে কিছু করতে পারছিলেন না, তাঁরা এসেছেন। দু’তিনটি প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটেছে। এটি শুধু মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে নয়, সারা রাজ্যে দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এতগুলো ছেলেমেয়ের চাকরি গেছে রাজ্য সরকারের জন্য। সরকার হাইকোর্টে গেছে চাকরি দেওয়ার জন্য নয়, যাতে মন্ত্রীসভার কেউ গ্রেপ্তার না হয়, তার জন্য। এরা শিক্ষাকে ধ্বংস করেছে। স্কুল, মাদ্রাসায় শিক্ষক নেই। আমরা চাই সুষ্ঠু, অবাধ নিয়োগ। শিক্ষকদের শূন্য পদ পূরণ।
তিনি আরও বলেন, এখন মুর্শিদাবাদে আমরা দেখলাম তৃণমূল, বিজেপি দাঙ্গাহাঙ্গামা বাঁধানোর চেষ্টা করেছে রামনবমীকে কেন্দ্র করে। কিন্তু মানুষ তাতে প্ররোচিত হননি। রানিনগরে, ডোমকলের মতো কিছু এলাকায় ভয় দেখাচ্ছিল পুলিশের সাহায্যে। আমরা নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ, নথি দিয়েছি— কীভাবে পুলিশ তৃণমূলকে সাহায্য করছে ভয় দেখাতে, বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের কর্মীদের ভয় দেখাতে। পুলিশের নামে আমরা নির্দিষ্ট অভিযোগ করেছি। শুক্রবার ডোমকলে একজন তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে বোমা ছিল, সেও ছিল। আমরা দাবি করলাম, তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। ডোমকল থানা দেরি করে, যাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছাতে না পারে, যাতে সেই ব্যক্তিকে খবর দেওয়া হয়। ঘোড়ামারার সেই ব্যক্তি সরে পড়েছে, তবে বোমা উদ্ধার হয়েছে। পুলিশ তাকে পালানোর সুযোগ করে দিল। আমি ডোমকল থানার আইসি, অফিসারের নামে অভিযোগ করছি। ওখানে মহিলাদের গিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। মাচা ভেঙে দিচ্ছে, বলছে এখানে কেন বসছ? যেহেতু মানুষের সমর্থন পাচ্ছে না, তাই পুলিশকে দিয়ে এসব করছে। আমি বলছি, এখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো হবে না। এটা লোকসভার ভোট।
সেলিম বলেন, তৃণমূল, বিজেপি’র অবস্থা যত খারাপ হচ্ছে, তত তারা নতুন বাইনারি তৈরির চেষ্টা করছে। আজ সন্দেশখালি শিরোনামে। আমরা প্রথম থেকে বলে এসেছি, সন্দেশখালি হলো জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে ভেড়ি বানানো, জমি লুট করা, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করা, এমনকী সরকারি সম্পত্তি লুট করা, মানুষের টাকা লুট করার ঘটনাস্থল। বিজেপি প্রথম দিন অপরাধীদের আড়াল করতে রোহিঙ্গা, বাংলাদেশী এই সব বলছিল। তার পাশাপাশি নারী নির্যাতন, অবশ্যই হয়েছে। গোটা ঘটনাকে জমি লুট, দুর্নীতি, চুরি থেকে সরিয়ে হিন্দু-মুসলমান এবং ধর্ষণে নিয়ে যেতে চেয়েছে ওরা। সন্দেশখালি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কীভাবে জমি, রুটিরুজি, সারের দাম, জিনিসপত্রের দাম, বেকারির বিষয়কে পিছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়। এরা এনআরসি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, মন্দিরকে সামনে এনে মূল সঙ্কটগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে চাইছে।
মহম্মদ সেলিম বলেন, আমরা জানি, মিথ্যা অভিযোগ মমতা ব্যানার্জি চম্পলা সর্দারকে নিয়ে করেছিলেন। তাপসী মালিককে নিয়ে করেছিলেন। তখন বামফ্রন্ট সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য করেছিলেন। এখন নির্বাচনের আগে রাজ্যপালকে কেন্দ্র করে আর একটি কথা বলছেন। কিন্তু এটি নবান্ন আর রাজভবনের সার্কাস, জোকারের খেলা। লক্ষ্য, মানুষের মূল সমস্যা থেকে নজর সরানো। মমতা এবং মোদীর কোনও বিরোধ নেই। রাজভবন এবং নবান্নর কোনও বিরোধ নেই।
Comments :0