মধ্যমগ্রামের দক্ষিণ বীরেশ পল্লীর মূল রাস্তা থেকে অলি গলি পেরিয়ে লাল রঙয়ের পুরোনো একটা একতলা বাড়ি। বাড়ির মালিক স্বপন দাস। থাকেন কলকাতার বেলেঘাটায়। গত ২২ মাস আগে তাঁর বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল আরতি ঘোষ এবং তাঁর মেয়ে ফাল্গুনী ঘোষ। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্কই ছিল না মা ও মেয়ের। সাধারণ মেলামেশা, কথাবার্তাও ছিল না প্রতিবেশীদের সঙ্গে। দিনরাত বহিরাগত ছেলে মেয়েদের আসা যাওয়া সহ সেক্স র্যাশকেট চলত বলেই ফাল্গুনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে গণস্বাক্ষর করে মধ্যমগ্রাম থানায় অভিযোগও জানিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা। স্থানিয় কাউন্সিলরের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল ফাল্গুনী এবং তাঁর মা আরতি ঘোষের। এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই দক্ষিণ বীরেশপল্লীর ওই ভাড়া বাড়িতেই পিসি শ্বাশুড়িকে নৃশংস খুনের ঘটনা জানাজানি হতেই ফাল্গুনী এবং তাঁর মায়ের উপর ক্ষোভ কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে প্রতিবেশীদের।
পুলিশ এবং বাড়িওয়ালা সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে ফাল্গুনীর বিয়ে হয়েছিল। তাঁর স্বামী আসামে কর্মরত। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ফাল্গুনী তাঁর মা আরতি ঘোষের কাছেই থাকতে শুরু করে। স্বামীর পেনশনের টাকাতেই চলত আরতির। মা, মেয়ে আগে মধ্যমগ্রামে ভাড়া থাকত। বছর পাঁচেক আগে মধ্যমগ্রাম পৌরসভার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বীরেশপল্লীর ওই বাড়িটা কিনেছিলেন স্বপন দাস। তাঁর বাড়িতেই গত ২২ মাস ধরে ভাড়ায় রয়েছে ফাল্গুনী এবং আরতি। ফাল্গুনী বারাসত আদালতের এক আইনজীবীর সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন বলেই জানা গেছে। ফাল্গুনীর আচরণের মধ্যে ক্রোধ ভাব বেশি ছিল বলেই অভিযোগ। হুটহাট রেগে যেত সে। তাদের দুজনের আচার,আচরণ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ প্রতিবেশীদের। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, ফাল্গুনীদের বাড়িতে দিনরাত বহিরাগত ছেলেমেয়েদের আসা যাওয়া বেশি ছিল। বাড়িতে আজেবাজে কাজও হত। বহিরাগতরা মদ্যপান করে জোরে করে কথাবার্তা বলত। বিষয়টি নিয়ে আপত্তিও তুলেছিলেন প্রতিবেশীরা। এই বিষয়ে স্থানিয় তৃনমূল কাউন্সিলার তথা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান প্রকাশ রাহাকেও জানিয়েছিলেন তাঁরা। প্রকাশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়েছিল ফলগুনীদের। পড়ে, বাড়িওয়ালার সঙ্গেও তার বাকবিতণ্ডা হয়েছিল। এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে বলে ফাল্গুনী এবং তাঁর মাকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িওয়ালাকে চাপ দিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা। মঙ্গলবার খুনের ঘটনা সামনে আসার পরেই সেই ক্ষোভ কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে প্রতিবেশীদের।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২৩ সালে মধ্যমগ্রাম থানায় স্বামীর বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ করেছিলেন ফাল্গুনী। অভিযোগের ভিত্তিতে ফাল্গুনীর স্বামীকে গ্রেপ্তারও করেছিল পুলিশ। সেই কেস এখনও চলছে মধ্যমগ্রাম থানায়। স্বামীর সঙ্গে সেপারেশনের মামলা চলছে ফাল্গুনীর। নিহত সুমিতা ঘোষ সম্পর্কে পিসি শ্বাশুড়ি হন ফাল্গুনীর। পুলিশের অনুমান, শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি, গয়না সহ পারিবারিক বিষয় নিয়ে নিহত সুমিতা ঘোষের সঙ্গে তাঁর বিবাদ ছিল। গত ১১ ফেব্রুয়ারি পিসি শ্বাশুড়ি ফাল্গুনীদের ভাড়া বাড়িতে এসেছিলেন। তবে, সুমিতা নিজে এখানে এসেছিলেন, না কি ফাল্গুনী তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা এখনও পরিষ্কার নয় মধ্যমগ্রাম থানার তদন্তকারীদের কাছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এখানে আসার পর গত দু'দিন আগেও তাদের মধ্যে অশান্তি হয়েছিল। পারিবারিক এই অশান্তিতে আরতির ভূমিকাও ছিল। সোমবার রাতে সেই অশান্তি চরমে পৌঁছায়। অশান্তি চলাকালীনই পিসি শ্বাশুড়িকে দেওয়াকে ধাক্কা মেরেছিল ফাল্গুনী। ফলে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন পিসি শ্বাশুড়ি। জ্ঞান ফেরার পরেই পিসি শ্বাশুড়ির মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করেছিল ফাল্গুনী। মাথায় আঘাতের জেরেই মৃত্যু হয়। খুনের পর দেহ লোপাট করতেই ঘরে থাকা কোন ধারালো দা বা অন্য কিছু দিয়ে পিসি শাশুড়ির দেহ কয়েক টুকরো করা হয়। দেহ টুকরো করতে মেয়েকে সহযোগীতা করেছিলেন মা আরতি ঘোষ। এরপর টুকরো টুকরো দেহ নীল রংয়ের একটা ট্রলি ব্যাগে ভরতে গিয়েও বিপত্তি হয়। শেষে নিহত পিসি শ্বাশুড়ির পায়ের গোড়ালি কেটে ট্রলিবন্দী করেছিল মা এবং মেয়ে। গোটা রাত ধরে অপারেশন চালালেও প্রতিবেশীরা কিচ্ছু টের পান নি। মঙ্গলবার ভোরের আলো ফুটতেই পিসি শ্বাশুড়ির ট্রলিবন্দী দেহ নিয়ে বাড়ির সামনে থেকেই ভ্যানে ওঠান মা এবং মেয়ে। অলি গলির ওই রাস্তায় সি সি ক্যামেরা না থাকায় ভ্যানে ওঠার ছবি পায় নি পুলিশ। কিন্তু দক্ষিণ বীরেশপল্লীর মূল রাস্তার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে অবশ্য তাদের ভ্যানে যাওযার ছবি পেয়েছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, ভ্যানে করেই তাঁরা মধ্যমগ্রামের চৌমাথা হয়ে যশোর রোড ধরে দোলতলা পর্যন্ত গিয়েছিল। এরপর সেখান থেকে একটি ট্যাক্সি ধরেছিল। সিসি ক্যামেরা থেকে সেই ছবিও হাতে এসেছে পুলিশের। সেই সূত্র ধরেই ওই ভ্যান এবং ট্যাক্সির চালকের হদিশ পেয়েছে পুলিশ।
এই প্রসঙ্গে প্রতিবেশী ঋতুপর্ণা ঘোষ বলেন, মা মেয়ের আচরণ মোটেই ভালো ছিল না। দিনরাত বহিরাগত ছেলেমেয়েদের আসা যাওয়া ছিল ওদের বাড়িতে। অশালীন কাজকর্ম হত। বিষয়টি জানার পরেই আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। এই নিয়ে আমাদের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া মা এবং মেয়েকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িওয়ালাকেও বলেছিলাম। গত নভেম্বর মাসে গণস্বাক্ষর করে প্রতিবেশীরা মধ্যমগ্রাম থানায় অভিযোগও জানিয়েছিলেন।
মনি সেন, বৈশালী রায় বলেন, ওরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে একদম মিশতেন না। ফাল্গুনীর মা সকাল, সন্ধ্যায় এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে ফুল, গাছের ফল চুরি করত। আমাদের বিশ্বাস, মায়ের প্রশ্রয় ছাড়া ফাল্গুনীর কাছে বহিরাগত ছেলেমেয়েরা আসার সাহস পেত না। স্থানিয় কাউন্সিলার তথা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান প্রকাশ রাহা বলেন, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে আমিও প্রতিবাদ করেছিলাম। বাড়িওয়ালাকেও ওই ভাড়াটিয়াকে তুলে দেওয়ার কথা বলেছিলাম। এই নিয়ে আমার সঙ্গে বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল। খুব নৃশংস ঘটনা। পুলিশ তদন্ত করছে।
এই প্রসঙ্গে বাড়ীওয়ালা স্বপন দাস বলেন, ৪ হাজার ২০০ টাকায় গত ২২ মাস ধরে মা এবং মেয়ে আমার বাড়িতে ভাড়ায় রয়েছে। এর আগেও ভাড়াটিয়ার বাড়িতে বহিরাগতদের আসা যাওয়া নিয়ে প্রতিবেশীরা অভিযোগ জানিয়েছেন। ওদের সঙ্গে ভাড়ার চুক্তি শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৮ মার্চ। ওদের তারপর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলেছিলাম। কিন্ত ,তারমধ্যেই এমন ঘটনা ঘটে যাবে ভাবতেই পারছি না।
বারাসতের পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাঁড়খড়িয়া বলেন, পিসি শ্বাশুড়ির সঙ্গে ফাল্গুনী ঘোষের পারিবারিক, সম্পত্তিগত বিষয় নিয়ে গণ্ডগোল ছিল। গত ১১ ফেব্রুয়ারি নিহত সুমিতা ঘোষ ফাল্গুনীদের ভাড়া বাড়িতে এসেছিলেন। সোমবার রাতে সেই অশান্তি থেকে তাকে খুন করেছেন ফাল্গুনী এবং তাঁর মা। কলকাতা পুলিশকে আমরা তদন্তে সাহায্য করছি।
Comments :0