Editorial

৩১৮ বছর বাদে কেন

সম্পাদকীয় বিভাগ

ঔরঙ্গজেবের সমাধি ঘিরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা নাগপুরের সাম্প্রতিক দাঙ্গার আগে থেকেই চলছিল। ১৭ মার্চ সন্ধ্যায় মহারাষ্ট্রের নাগপুরস্থিত আরএসএস’র সদর দপ্তরের কাছ থেকেই দাঙ্গা শুরু হয়। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং বজরং দল শহরের মহল এলাকায় একটি মিছিল করে, সম্ভাজিনগরে অবস্থিত মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংসের দাবি তোলে এবং ঔরঙ্গজেবের কুশপুতুল পোড়ায়। অভিযোগ কলমা লেখা একটি কাপড়েও তারা আগুন লাগায়। যার ফলে দাঙ্গা শুরু হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলের সদস্যরা অন্যান্য উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর সাথে মিলে শিব রাত্রি উপলক্ষে রাজ্যজুড়ে ঔরঙ্গজেবের সমাধি খুলদাবাদ, ছত্রপতি সম্ভাজি নগর থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে। এর পরিণতিতেই, সোমবার সন্ধ্যায় নাগপুরের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ঘটে।

মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশ, যিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়করি দু’জনেই নাগপুরের বাসিন্দা। দাঙ্গা শুরু হওয়ার অনেক পরে তারা শান্তি বজায় রাখা এবং গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তাদের এই আহ্বানের কোনও গুরুত্বই তখন আর ছিল না, কারণ গত এক মাস ধরে বিজেপি’র বিভিন্ন নেতাই তাদের উসকানিমূলক বক্তৃতায় ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করেছে। ৯ মার্চ, বিধান পরিষদে দেওয়া এক বিবৃতিতে ফড়নবীশ বলেছিলেন, তিনি ঔরঙ্গজেবের সমাধি ভেঙে ফেলার দাবিকে সমর্থন করেন, তবে এটি আইন মেনে করা উচিত। এটি (সমাধি) ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ ঘোষিত ঐতিহ্যবাহী সুরক্ষিত স্থান। 

এখন প্রশ্ন হলো, ১৭০৭ সালের ৩ মার্চ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয় এবং তারপরেই সমাধিক্ষেত্রও নির্মিত হয়। এখন ২০২৫ সাল। হঠাৎ ৩১৮ বছর বাদে এই বিচিত্র দাবি তোলার অর্থ কি? ঘটনাচক্রে, আরএসএস সদর দপ্তরের কাছেই এই সহিংসতা ঘটে, যার ফলে সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সেই দিন সকালেই মুম্বাইয়ের ভিওয়ান্দিতে ছত্রপতি শিবাজির একটি মন্দির উদ্বোধন করার সময় ফড়নবীশ বলেছিলেন, "এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের ঔরঙ্গজেবের কবর রক্ষা করতে হবে, কারণ ৫০ বছর আগে এএসআই এটিকে সুরক্ষিত স্থান ঘোষণা করেছিল। ঔরঙ্গজেব আমাদের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল, তবে আমাদের তার কবর রক্ষা করতে হবে।" রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই উত্তেজনা ছড়িয়েছেন সেদিন সকাল থেকেই। তারও কয়েক মাস আগে থেকেই সঙ্ঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নানা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি লাগাতার বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়েছে নাগপুর সহ গোটা রাজ্যে। ফলে পরিকল্পিত এই দাঙ্গা বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারের উদ্যোগেই সংগঠিত হয়েছে, এনিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতেই পারে না। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সহ তার মন্ত্রিসভার কিছু মন্ত্রী ঘৃণা ভাষণ দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন।  ঘটনা পরম্পরাই প্রমাণ করে, আরএসএস ও বিজেপি’র পরিকল্পনায় এই দাঙ্গা হয়েছে। 

এভাবেই তারা দেশের মানুষকে জাত, ধর্ম, ভাষার নামে বিভক্ত করতে চাইছে। দেশজোড়া বেকারত্ব, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-চিকিৎসা ক্রমশ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মহিলাদের নিরাপত্তা নেই। জাতীয় সম্পদ আদানি-আম্বানি সহ দেশি বিদেশি অতি ধনীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্কে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত অর্থ অবাধে লুট করছে এই অতি ধনীরা। দারিদ্র-ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এসব থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতেই ধর্মকে ব্যবহার করে উত্তেজনা ছড়িয়ে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম, যুক্ত্ররাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে তছনছ করে, দেশকে মধ্যযুগীয় বর্বতার অন্ধকারে নিয়ে যেতে চাইছে এরা।

Comments :0

Login to leave a comment