ময়ূখ বিশ্বাস
উত্তরবঙ্গের আয়তন ২১,৩২৫ বর্গকিলোমিটার, যা পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ। শুরু থেকেই উত্তরবঙ্গের জনসংখ্যার গঠন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্রময়। বিভিন্ন ভাষা, জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মিলনস্থল। অভিবাসন এই বৈচিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু এই বৈচিত্রের রঙমহল উত্তরবঙ্গ বর্তমানে ভয়াবহ পরিবেশগত জরুরি অবস্থার মুখোমুখি। যা মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।
উত্তরবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তা, মহানন্দা, মেচি, বালাসন, তোর্ষা, জলঢাকা, রায়ডাক, সংকোশ। এই নদী গুলির উৎপত্তি উপরে হিমালয় পর্বত থেকে। হিমালয় থেকে আগত এই নদীগুলি মেশে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা বা কোশি নদীতে। উত্তরবঙ্গে রয়েছে আরও বহু ছোট ছোট নদী। সাধারণভাবে এই নদীগুলি বর্ষার আগে পর্যন্ত থাকে শুষ্ক।
অনেক বছর তিস্তা স্বাভাবিক নিয়মেই প্রবাহিত হয়ে আসছিল। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছরের মধ্যে সিকিম থেকে সেবক পর্যন্ত তিস্তা পাড়ে হয়েছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা ভূমি ধস। অনেক রাস্তা, সেতু, বাড়িঘর এর ফলে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অনেকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত হয়েছেন সীমান্তে পাহারারত সামরিক বাহিনীর অনেকে । ২০১৪-১৫ সালে সিকিম ও উত্তরবঙ্গে ভালোমাত্রায় ভূমিকম্প হয়। সিকিমের তিস্তার পার দিয়ে ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। আরেকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই অঞ্চলে সম্প্রতিক সময়ে অনেকবার ঘটছে, তা হলো মেঘ ভাঙা বৃষ্টি ও হড়পা বান। এতেও মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের অক্টোবরের বন্যা ও ধসের উদাহরণ, যা বহু প্রাণ কেড়েছে এবং হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, ভেঙে দিয়েছিল মিরিক–শিলিগুড়ির গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ দুধিয়া আয়রন ব্রিজ সহ অসংখ্য সেতু, বহু নদী বাঁধ।
এরই সাথে অজস্র ছোট ছোট পাহাড়ি নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে। যা জীবনযাত্রা ও বাস্তুতন্ত্রকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে নদীর পাড়ে বসবাসকারী গরিব মানুষরা সব হারাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গের নদীগুলির উৎসের সঙ্গে একাধিক দেশ যেমন চীন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ বা আসাম, সিকিম, বিহার রাজ্য যুক্ত। ব্রহ্মপুত্র বোর্ড থাকলেও নদী নিয়ে বিভিন্ন দেশ বা রাজ্যগুলির মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলির মধ্যেও আন্তরিক উদ্যোগের অভাবও রয়েছে। উত্তরবঙ্গে এবারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে অনেক প্রাণীরও মৃত্যু হয়েছে। যা উদ্বেগের তা হলো গত দুই দশকে, বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে এই অঞ্চলে প্রত্যেক বছরেই বিশেষ করে তিস্তার নিম্ন ধারা বা স্রোত বরাবর অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
উত্তরবঙ্গের পাহাড় বা সমতল অঞ্চলের সাধারণভাবে নগরায়নের হার কম। একমাত্র ব্যতিক্রম শিলিগুড়ি বা তার সংলগ্ন জলপাইগুড়ি জেলার কিছু অংশ। এই অঞ্চলে উৎপাদন ভিত্তিক শিল্প নেই বললেই চলে। কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস কৃষি, চা বাগান, পর্যটন ও ক্ষুদ্র ব্যবসা। অথচ অঞ্চলটি শুধু ভৌগোলিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত দিক দিয়েও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ আমলে তো বটেই স্বাধীনতা ও দেশ ভাগের পরেও উত্তরবঙ্গ যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। পেয়েছে শুধু অবহেলা। ব্যতিক্রম শুধু বামফ্রন্ট সরকারের সময়। এমনিতেই দার্জিলিঙের পাহাড় বা তরাই অঞ্চল বা ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ডুয়ার্স অঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রবণ এলাকা। হিমালয় পর্বত একটি নবীন পার্বত্য এলাকা, যার গঠন চলছে এবং স্থির হয়নি। ফলে, পাহাড় নড়লেই নিমেষে সব শেষ। সেই কারণেই এই পাহাড়ে জমির ব্যবহার করা প্রয়োজন খুব সতর্কভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে।
২০০০ সালে বামফ্রন্ট সরকারের সময় পাহাড় এলাকার জন্য ভূমি ব্যবহারের একটি মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে ও পরে কি করণীয় তারও একটি নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। পাহাড়ে নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা, ১১ মিটারের নিচে গৃহ নির্মাণ করা, সমস্ত পাহাড়ি ঝোরা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনও নির্মাণ কাজ না করা, নদী লাগোয়া অঞ্চলে গৃহ নির্মাণ না করা, রাস্তায় অতিরিক্ত মাল নিয়ে যান চলাচল নিষিদ্ধ করা, ইত্যাদি বিধি তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে তিস্তা স্টেজ ভি প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার সময় নদী অববাহিকার বহন ক্ষমতা পরীক্ষার শর্তও রাখা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই সমস্ত বিধিগুলি বিন্দুমাত্র মেনে চলা হচ্ছে না। বরং তার বিপরীত মুখে যাওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিককালে সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত তিস্তা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ৩০ টি নদী বাঁধ। নির্মাণ করা হয়েছে অনেকগুলি উঁচু জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। নদীর বহন ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে হ্রাস করেছে। সিকিমে তিস্তার উজানে ১২০০ মেগাওয়াটের তিস্তা-৩ বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা এবং অন্যান্য বিতর্কিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি বিপর্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাও শিক্ষা হয়নি। এই বিশাল প্রজেক্টগুলোকে কেন্দ্র করে অনেক ওজনের যন্ত্রপাতি বহন করা হচ্ছে ১০ নং জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে। এরপর তিস্তা নদীর পাড় দিয়ে জাতীয় সড়কটি একটি ভঙ্গুর পাহাড়ের উপরে তৈরি হয়েছে। বিকল্প রাস্তা নির্মাণের কথা অনেকবার বলা হলেও তা গড়া হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নির্মিত সেবক করোনেশন সেতুর বিকল্প সেতু আজও নির্মাণ করা হয়নি। সুভাষ ঘিসিং যখন গোর্খা পার্বত্য পরিষদের কার্যনির্বাহী ছিলেন তখনই বামফ্রন্ট সরকারের সহায়তায় নির্মাণ করা হয়েছিল শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াঙ পর্যন্ত রোহিনী রোড। গত ১০ বছরে এই অঞ্চলে একটিও নতুন রাষ্ট্রীয় সড়ক বা জাতীয় সড়ক নির্মিত হয়নি। এতগুলি বড় নদী বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সিকিমে লেপচা উপজাতি ও বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা ২০০৩-০৪ সালে আন্দোলন শুরু করেছিল। বামপন্থী ও প্রগতিশীল মানুষও তা সমর্থন করেছিল। সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক নির্মাণ কাজ চলেছে সেবক থেকে সিকিমের সিংথাম পর্যন্ত পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করে রেলপথ নির্মাণ। তার ফলে তিস্তার পার দিয়ে ভঙ্গুর পাহাড় অঞ্চল আরও ভঙ্গুর হয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি করেছে। ভঙ্গুর পাহাড়ি ঢালের ওপর দিয়ে সিকিম রেল প্রকল্প নিয়মিত ভূমি ধস ঘটাচ্ছে, যার পরিণতিতে ১০ নং জাতীয় সড়ক অঞ্চলে প্রত্যেক বছর এই ভূমি ধস বেড়েই চলেছে এবং তিস্তায় নিচের দিকে বন্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। নদীতে ভেসে যাচ্ছেন অনেক মানুষ। পাহড়ে ধসে এই শীতেও গৃহহারা মিরিক থেকে সোনাডায় বহু মানুষ। তাঁদের জন্য নিরাপদ পুনর্বাসন আজও অধরা।
লুট হচ্ছে নদী। তরাই বা ডুয়ার্সের পাহাড়ি নদীগুলির পাথর বালি ব্যাপকভাবে লুট করে নিচ্ছে একদল লুটেরা, যারা মদত পাচ্ছে শাসকদলের কাছ থেকে। ফলে এই সমস্ত নদীগুলির গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং হড়পা বানের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্সে ব্যাপকভাবে হয়েছে হোম স্টে নামে একরকমের বেআইনি পর্যটন ব্যবসা। পাহাড়, বন বা নদীর পারে বেপরোয়াভাবে হোম স্টের নামে বড় বড় হোটেল বা রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে। সেখানে মানা হচ্ছে না কোনও গৃহনির্মাণ বিধি, বনাঞ্চলের আইন। নদী সংলগ্ন কমপক্ষে ২০০ মিটার এলাকাকে River Regulated Zone (RRZ) হিসাবে রক্ষা করার কথা থাকলেও, সেখানে এই অবৈধ নির্মাণ ও বসতি গড়ে উঠেছে, যা নদীর স্বাভাবিক গতিকে আটকে দিচ্ছে। পাহাড় বা ডুয়ার্সের মূল্যবান জমি এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আদিবাসী বা সমতলের রাজবংশী বা মেচ রাভা, ধীমালি উপজাতির মানুষের জমির মালিকানা থেকে। বনাঞ্চলেও গড়ে উঠেছে অনেক বড় বড় হোটেল, রিসর্ট, বাগান বাড়ি। চা বাগানের অনেক জমিও ব্যবহৃত হচ্ছে এসব কাজে। উত্তরবঙ্গে এই লুট চলছে শাসক দলের সাহচর্যে ও মদতে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দ্রুত বনাঞ্চলের এলাকা হ্রাস পাচ্ছে। স্যাটেলাইট ডেটা অনুযায়ী ২০০১-২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাপক বন লুট হয়েছে। আলিপুরদুয়ারে ৮.৬৯ কিলো হেক্টর, জলপাইগুড়িতে ২.৭৭ কিলো হেক্টর এবং দার্জিলিংয়ে ২.১৩ কিলো হেক্টর বনভূমি নষ্ট হয়েছে। নদীর ধারে ৫০০ এরও বেশি বেআইনি পাথরখাদান নদীর স্বাভাবিক স্থিতি নষ্ট করছে, যার ফলে বন্যা আরও ভয়াবহ হচ্ছে। বক্সা টাইগার রিজার্ভের মূল অঞ্চলে ৬৯টি বেআইনি লজ ও নির্মাণ পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করছে। এখানেও রয়েছে রাজ্যের শাসকদলের ভূমিকা। আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারই ২০২০ সালের পরিবেশগত মূল্যায়ন (EIA) সংশোধনী কর্পোরেট প্রকল্পগুলিকে সহজ অনুমোদন দিয়ে হিমালয়ের সংবেদনশীল অঞ্চলগুলির আরও ক্ষতি ডেকে এনেছে। যার প্রভাব এখন এই অঞ্চলও অনুভব করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ কীভাবে লুট হচ্ছে, বিশেষ করে গাছ কাটা কীভাবে বাড়ছে উত্তরবঙ্গে!
এরসাথে ভুটান থেকে নেমে আসা তিস্তা, জলঢাকা, তোর্ষা সহ বিভিন্ন নদী দুটি বড় সঙ্কটের মুখে। ভুটান থেকে নিচে চা বলয় ও ডুয়ার্সে নেমে আসা ডলোমাইট -সিলিকনের জন্যে পাহাড় কাটার ফলে বর্জ্য, রাসায়নিক সার - বিয়ার ফ্যাক্টরির বর্জ্য, শহুরে নিকাশি ও কৃষির রাসায়নিক বর্জ্য নদীগুলোকে ভয়াবহভাবে দূষিত করছে। গুণগত মান কমছে চায়ের। আবার বন কেটে বানারহাট ও বীরপাড়া থেকে ট্রেন যাবে ভুটানে খনিজ আনতে। ফলে এবার হাতির বনও শেষের পথে। বীরপাড়া, চুনাভাটি, চামুর্চি অঞ্চলে এই সবের প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। বাড়ছে শ্বাসজনিত সমস্যা ও চর্ম রোগ। স্থানীয়রা নানাভাবে আন্দোলন করলেও, তা দমানো হচ্ছে খনি মাফিয়া ও তাদের রক্ষক দলের চাপে। এর সাথে পাথর ও বালি উত্তোলনের বেআইনি ও অতিরিক্ত খনন নদীর গতিপথ পরিবর্তন করছে, তলদেশ গভীর করে ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমিয়ে দিচ্ছে এবং নদীর জীব বৈচিত্র ধ্বংস করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, উত্তরবঙ্গে ব্যাপক বনচ্ছেদন হাতি-চিতা-বাইসন-গন্ডার-বুনো শুয়োর' সহ নানা বন্যপ্রাণীকে মানুষের বসতিতে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে ফসল নষ্ট, সম্পত্তির ক্ষতি এবং মানুষ ও প্রাণী, দুই পক্ষেরই মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। ২০২১ সালে গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু মহা সম্মেলনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন,"আমরা নিজেরাই আমাদের কবর খুঁড়ে চলেছি।" উত্তরবঙ্গে তাই হচ্ছে। রাজ্যের বর্তমান সরকার একবারের জন্যও তাদের বলে না এই সমস্ত অনৈতিক কাছ থেকে বিরত থাকতে। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী একবারের জন্যও বলেননি তিস্তার ওপর বেপরোয়া ভাবে বাঁধ তৈরি বন্ধ করা হোক বা হোম স্টে নির্মাণের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ। পাহাড়ে-জঙ্গলে বেআইনিভাবে গৃহনির্মাণের কাজ বন্ধ করার আদেশও দেননি। আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রকে একটি চিঠিও লিখে বলেননি,'বন্ধ করা হোক পাহাড় কেটে রেল লাইন পাতার কাজ।' এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে তিনি একবারের জন্য উত্তরবঙ্গের মানুষকে সতর্ক করেননি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে ও পরের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রশাসানিকভাবে যে ন্যূনতম প্রস্তুতি রাখার দরকার ছিল সেই প্রস্তুতিও এই সরকার তা রাখেননি পাহাড় বা সমতলের কোনও স্থানে। তিনি যে উত্তরবঙ্গের মানুষের প্রতি এতটুকুও আন্তরিক নন, তা তিনি দেখিয়েছেন কার্নিভালে নাচানাচি করে।
উত্তরবঙ্গের ভবিষ্যৎ নির্মাণে পরিবেশ, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকার ও স্থিতিশীল অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা খুব জরুরি। তারজন্যে এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি-উপজাতি, ভাষা-উপভাষার মানুষদের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে হবে। প্রথমেই স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকার ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে পরিবেশের সাথে সাযুজ্য রেখে। চা বাগানের শ্রমিকদের বসতভিটার অধিকার দিতে হবে। আদিবাসীদের জমি হস্তান্তর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানব-প্রাণী সংঘাত মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সরলীকরণ জরুরি যেমন, তেমনই বনদপ্তরের কাজে স্থানীয়দের অংশগ্রহণ, কৃষিবন ও ভেষজ চাষে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সমগ্র সংবেদনশীল অঞ্চলের জন্য একটি বিজ্ঞানভিত্তিক মাস্টারপ্ল্যান জরুরি। যার কেন্দ্রে থাকবে তিস্তা উপত্যকার জলধারণ ক্ষমতা ও পরিবেশগত ঝুঁকির মূল্যায়ন। গুরুত্ব দিতে হবে পূর্বে বাম আমলের সেচ প্রকল্পের পুনরুজ্জীবনে। তাই তিস্তা সেচ প্রকল্পের বর্তমান সময়োপযোগী পরিকাঠামো পুনর্গঠন ও জলকে ধরে রেখে বহুমুখী চাষের উপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার। এগুলো সরকার ভুলে গেছে। এছাড়া মাটির উপরের জঙ্গল, ঝোরার জলের উৎস ধরে তৌসিরের বাঁধ, চানা বাঁধ, বিরু বাঁধ সহ ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করতে হবে। এরসাথে তিস্তা-৩ বাঁধ সহ অপরিকল্পিত পরিবেশ নাশকারী সব পুনর্নির্মাণ ও নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থগিত, বেআইনি খনন, বন উজাড় করে পাহাড় কাটার মাধ্যমে রেলপথ নির্মাণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তারসাথে ভুটানের সাথে যৌথ নদী কমিশন গঠন করে ডলোমাইট খনন ও দূষণ রোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বাম আমলে তৈরি শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এসজেডিএ’র মতো পরিকল্পিত উন্নয়ন মডেল পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যাতে শিল্পায়ন ও নগরায়ন পরিবেশ বান্ধব হয়। দুর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থা শক্তিশালী ও বিকল্প আশ্রয় ক্যাম্পের পরিকাঠামো, নেওড়া ভ্যালি-জলদাপাড়ার মতো জাতীয় উদ্যানগুলোকে রক্ষা এবং সর্বোপরি, সকলের অংশগ্রহণমূলক নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের পরিবেশের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং তার সাথে সাথে সামাজিক ন্যায় বিচার একসাথে অর্জন করা সম্ভব।
বিলেত ফেরত তরুণ ব্যারিস্টার জ্যোতি বসু কলকাতায় কিছু বছর শ্রমিক আন্দোলন করেই সেই সময় প্রত্যন্ত ডুয়ার্সে এসেছিলেন বেঙ্গল আসাম রেলওয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে। জলপাইগুড়ির দোমোহনি ছিল সেই সময় অবিভক্ত বাংলার এক রেলওয়ে সেন্টার। এখান থেকেই অবিভক্ত পরাধীন দেশে তিন জন কমিউনিস্টের মধ্যে একজন হিসাবে বাংলার আইনসভায় যান তরুণ শ্রমিক নেতা কমরেড জ্যোতি বসু। ১৯৪৬ সালে রেলওয়ে শ্রমিক কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হুমায়ুন কবীরকে পরাস্ত করে জ্যোতি বসু নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে বছর আরও দুই কমিউনিস্ট প্রার্থী বিধানসভার সদস্য হয়েছিলেন। সবাই উত্তর বাংলা থেকে। দার্জিলিঙ কেন্দ্রে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও দিনাজপুর কেন্দ্রে (আজ তা বাংলাদেশে পড়ে) রূপনারায়ণ রায়। এবার সেই উত্তরবঙ্গে প্রথম জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত 'জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশাল স্টাডিজ অ্যা ন্ড রিসার্চ'-এর উদ্যোগে আলোচনাসভা হলো জলপাইগুড়িতে, "উত্তরবঙ্গ: প্রকৃতি, পরিবেশের সঙ্কট এবং জীবন-জীবিকা।"
Highlights
উত্তরবঙ্গের জনসংখ্যার গঠন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্রময়। বিভিন্ন ভাষা, জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মিলনস্থল। অভিবাসন এই বৈচিত্র নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু এই বৈচিত্রের রঙমহল উত্তরবঙ্গ বর্তমানে ভয়াবহ পরিবেশগত জরুরি অবস্থার মুখোমুখি। যা মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।
North Bengal
উত্তরবঙ্গ: সঙ্কটে প্রকৃতি-পরিবেশ, সঙ্গে জীবন-জীবিকাও
×
Comments :0