বিমান বসু
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ছিলেন আদ্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির বন্ধু, কৃষক সমাজের একান্ত আত্মীয় এবং শোষণভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানের লড়াই সংগ্রামের এক অতন্দ্র প্রহরী। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আজ থেকে ১৩৪ বছর আগে ১৮৮৯ সালের এই দিনে বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপ দ্বীপে।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শক্তি খর্ব করার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তার বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল, যা সেই সময়ে তরুণ বয়সে তাঁর মনের ওপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়েই ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ও দেশে তৈরি দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহারের আন্দোলন শুরু হয়েছিল যাকে তৎকালীন সময়ে ‘স্বদেশী আন্দোলন’ বলে অভিহিত করা হতো। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের কাহিনি জানার জন্য উদগ্র বাসনায় তাড়িত ছিলেন। সেই কাহিনি জানার পরে তিনি ভারতের বুকে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত হন। একই সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাধারণ মঞ্চ জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়েই তিনি শ্রমিক কৃষকের স্বার্থরক্ষায় কোনো কোনো সময়ে কিছু প্রস্তাবও উত্থাপন করেছিলেন।
ঐতিহাসিক রুশ বিপ্লবের দু’বছরের মধ্যেই পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় যা সারা দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে প্রসারিত করতে সাহায্য করেছিল। মুজফ্ফর আহমদ নিজের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, ‘‘১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল নববর্ষের দিন (বৈশাখী) ছিল। এই দিনে হাজার হাজার লোক অমৃতসরে জড়ো হয়ে থাকেন। বিশ হাজার লোক জড়ো হয়েছিলেন তখনকার জালিয়ানওয়ালাবাগে। সেখানে বক্তৃতা চলছিল। অমৃতসরে সামরিক আইন জারি হওয়ার কোনো ঘোষণা তখনও ছিল না। এই বাগের চারদিকে পাকা প্রাচীর। যাতায়াতের পথ মাত্র একটি। ব্রিটিশ সামরিক অফিসার জেনারেল ডায়ারের পরিচালনায় ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যরা সমবেত জনমণ্ডলীর ওপরে গুলি চালাতে লাগল। ষোলোশো রাউন্ড গুলি চালানোর পরে গুলি ফুরিয়ে যায়। ....প্রায় চারশো লোক হত হলেন। আর আহত হলেন বারোশো লোক। ....পাঞ্জাবের লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের প্রতিবাদে মিছিল বার হলো। আবার এই প্রতিবাদ মিছিলগুলির ওপরেও গুলি চললো। কলকাতায়ও গুলি চলেছিল। নিহত হয়েছিলেন ছয় জন, আর আহত বারো জন। .... প্রতিবাদে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ রাজার দেওয়া নাইট খেতাব বর্জন করেন।’’ মুজফ্ফর আহ্মদ শুধু কলকাতার প্রতিবাদী কর্মসূচির বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অভিঘাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছোটো বড় নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছিল যা শহীদ ই আজম ভগৎ সিংয়ের লেখায় উঠে এসেছে। এই পৃষ্ঠভূমিকে সামনে রেখে ১৯২০ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত শ্রমিকদের আন্দোলনের একটি কেন্দ্র গড়ে তুলতে মহারাষ্ট্রের বোম্বাই শহরে লালা লাজপৎ রায়ের সভাপতিত্বে একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক সম্মেলন থেকে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস গড়ে ওঠে।
আবার এই ১৯২০ সালেই সোভিয়েত ইউনিয়নের উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল। প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পর মুজফ্ফর আহ্মদ জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেও শ্রমিক কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগঠিতভাবে শ্রমিক এবং কৃষক সমাজকে ব্যাপকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত করতেই হবে। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর ভরা যৌবনে একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাধারণ মঞ্চ কংগ্রেসের নেতৃত্বে লড়াই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করায় এবং অন্য দিকে ভারতের বুকে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে যুক্ত থাকায় নানা সময়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে থেকেছেন। ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র দাবি বক্তব্য ও ভারতে ‘কমিউনিস্টদের ইশতেহার’ প্রচারের দায়ে তিনি ব্রিটিশের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। এই সময়ে বিভিন্ন পরিবারে অবস্থানকালে তাঁর পরিচয় গোপন রাখার কারণেই তিনি সবার কাছে কাকাবাবু নামে পরিচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পার্টি কর্মী ও নেতৃত্বের কাছে এমনকি শুভ্যানুধ্যায়ী অনেক মানুষের কাছেও কাকাবাবু হিসাবেই সম্বোধিত হতেন।
উল্লেখ্য, ১৯২১ সালে পেশোয়ার, ১৯২৪ সালে কানপুর এবং ১৯২৯ সালে মীরাট ষরযন্ত্র মামলা ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ের করা হয়েছিল। কমরেড মুজফফর আহমদ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যতম আসামি হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছিলেন। কাকাবাবু দেশবাসীর স্বার্থে যে কাজ করেছেন তার স্বপক্ষে আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেই সওয়াল করেছেন, কারণ তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, দেশের ও দেশবাসীর স্বার্থে কাজ করা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত বক্তব্য ‘কমিউনিস্টস চ্যালেঞ্জ ইমপিরিয়লিজম ফ্রম দ্য ডক’ বইতে বেশ কিছু বর্ণনাও রয়েছে যা উৎসাহী পাঠক পড়তে পারেন।
ব্রিটিশ ভারতে এক প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরে মার্কসবাদ লেনিনবাদের আদর্শকে সামনে রেখে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজটা খুব সহজ ছিল না। এই কঠিন কাজে আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় কাকাবাবু নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিনি নিজের ও তাঁর পরিবারের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য এই কঠিন ব্রত গ্রহণ করেননি যা এখনকার প্রজন্মের কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীদের সকল সময় মনে রেখে চলা উচিত। প্রসঙ্গত, চল্লিশের দশকের শুরুতে পার্টির কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত দুটি কমিউনের ব্যয়ভার কেন্দ্রীয়ভাবেই নির্বাহিত হতো। কাকাবাবু যে কমিউনে থাকতেন সেখানে আত্মগোপনে থাকা অন্যান্য নেতৃত্বরাও থাকতেন। সেই কমিউনের খরচ পরিচালনা করার জন্য যে অর্থ সংগৃহীত হতো তা প্রকাশ্যে কাজকর্ম করা কমরেডরাই সংগ্রহ করে সরবরাহ করতেন। কাকাবাবুর কাছ থেকে এরকম একটি কাহিনি শুনেছিলাম। তিনি তখন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অফিস ৪৯ লেক প্লেসে থাকতেন। তিনি আমার সময় আছে কিনা জেনে নিয়ে বললেন, ‘জানেন (তিনি প্রায় সবাইকে আপনি করেই সম্বোধন করতেন) একবার আমি টাকা সংগ্রহ করার জন্য কমিউন থেকে অনেক দূরে পার্ক স্ট্রিটে ম্যাকফারসন পার্কে (বর্তমানে মহারানা প্রতাপ পার্ক) কোট প্যান্ট হ্যাট টাই পরে বসে ছিলাম। হাতে ছিল ছড়ি। যিনি টাকা দিতে আসবেন তিনি আসছেন না। সম্ভবত দেরি হচ্ছিল কোনো কারণে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করে দেখলাম আমাকে একজন লোক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চলে গেলেন, তিনি আবারও এসেছেন। আমার সন্দেহ হলো, এই লোক বোধহয় পুলিশের লোক। তাই আমি সেই লোক চলে যাওয়ার পর একটা গেট দিয়ে বেরিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটা শুরু করে পিছনে কেউ আছে কিনা দেখে তারপর অন্যরাস্তায় চলে গেলাম। ধীরে ধীরে কায়দা করে আমি কমিউনে পৌঁছাই। কিন্তু কমিউনে চাল ছিল না। ডাল ছিল না। সব্জী বা ডিম কিছুই ছিল না। ফলে সেদিন দুপুরে আমাদের শুধু মুড়ি খেয়ে থাকতে হয়েছিল। যেহেতু আলু ছিল তাই রাতে আলুর দম করে মুড়ি দিয়ে তা খেয়ে কাটিয়েছি।’ আমি শুনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘পরের দিন তাহলে কীভাবে চললো?’ উনি বলেছিলেন, ‘অনেক রাতে অন্য একটা ব্যবস্থা করে সেই অর্থ সংগ্রহ করেছিলাম। তাই পরের দিনের বন্দোবস্ত করতে অসুবিধা হয়নি।’ এই বর্ণনা শুনে আমি বেরিয়ে আসার পরে অনেক দিন ভেবেছি আমাদের পার্টির যারা পথিকৃৎ তাদের জীবন থেকে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
আজ কাকাবাবুর জন্মদিন। আচ্ছা কাকাবাবুর জন্মদিন কি সবসময় পালন করা হতো? না। রাজ্যের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে ১৯৬৩ সালে পার্টির যারা জেলে বন্দি ছিলেন, যারা আত্মগোপনে ছিলেন এবং যারা প্রকাশ্যে কাজ করতেন এই তিন অংশ আলাদা আলাদা ভাবে সভা করে কাকাবাবুর ঘোরতর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁর জন্মদিন পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই বছর এই দিনে রাজা রামমোহন রায় হলে প্রথম কাকাবাবুর জন্মদিন পালন করা হয়। আমি একজন সাধারণ পার্টি সদস্য হিসাবে ঐ সভায় উপস্থিত ছিলাম।
কাকাবাবুরা যে সময়ে পার্টি গড়ার কাজে যুক্ত ছিলেন তার পরিবর্তন হয়েছে, একথা ঠিক। কিন্তু এখন যেভাবে দেশে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার এবং রাজ্যে আরএসএস’এর নির্দেশ অনুযায়ী কংগ্রেস দল ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে বর্তমানে সরকার পরিচালনা করছে সেই পরিবেশও জটিল ও কঠিন। তাই নতুন পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের উদাহরণ সৃষ্টিকারী নানা কাজে চলার মধ্যে দিয়েই শোষিত বঞ্চিত শ্রমিক কৃষক ঐক্যের ভিতকে মজবুত করা সম্ভব হবে। একথা আমাদের এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে গেলে চলবে না যে কমিউনিস্টদের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ থাকে না। তা কন্টকাকীর্ণও হতে পারে। আজকের দিনে যেভাবে জাতপাত ও ধর্মের বিদ্বেষ সৃষ্টি করে জনগণকে বিভক্ত রেখে চলার রাজনীতি অব্যহত রয়েছে তাকে পরাস্ত করার মধ্য দিয়েই জনগণের ঐক্য যথার্থ অর্থে গড়ে তোলা সম্ভব। আবার শ্রমিক কৃষক ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক হানাহানি। কাকাবাবু শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে শ্রেণি ঐক্যের জোরদার সওয়াল করতেন এবং সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন যা আমাদের সবার মনে রাখা উচিত। যে কোনো মূল্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার অকৃত্রিম কারিগর আমাদেরই হতে হবে। এই কাজ কঠিন হলেও আমাদেরই সম্পন্ন করতে হবে।
উদ্ভুত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একদিকে গণতন্ত্র বিরোধী, ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলা দেশের রাজনীতি ও রাজ্যের কুশাসনকে পরাস্ত করতে সিপিআই(এম)’র ২৩তম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক রণকৌশলগত লাইন কার্যকরী করার লক্ষ্যে দৃঢ়ভাবে পথ চলতেই হবে। আজকের দিনে আমাদের শপথ হোক আমরা কাকাবাবুর জীবন ও কর্ম অনুশীলন করে ভালো কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে উঠি।
Comments :0