Doctor's Day

ঘোষণাই সার, বেসরকারি হাসপাতালের বেলাগাম বিলে লাগাম দিতে ব্যর্থ মমতা

রাজ্য

 

রাজ্যে বেসরকারি হাসপাতালের লক্ষ লক্ষ টাকার বেলাগাম বিলে রাশ টানতে চিকিৎসার খরচ বেঁধে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার। ঢাক ঢোল পিটিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন হয়েছিল। কিন্তু এর ১৩ মাস পরেও তার কোনও প্রতিফলন দেখতে পেলেন না রাজ্যবাসী। উলটে একইভাবে চলছে খেসারত দেওয়ার পালা। বেসরকারি ক্ষেত্রের আকাশছোঁয়া বিলে জেরবার মানুষ শরণাপন্ন হচ্ছেন আদালতের। পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনায় ধরা পড়েছে এমন ভয়াবহ চিত্র। সরকারি হাসপাতালের বেহাল পরিকাঠামোয় আস্থা না রাখতে পেরে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেও সেখানে অতিরিক্ত বিলের ভারে দিশাহারা মানুষের অভিযোগের তালিকা ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছে। সরকারি অনুগ্রহেই বাড়ছে বেসরকারি ক্ষেত্রের মুনাফার বহর, অভিযোগ ভুক্তভোগী মানুষ।  

মাস দেড়েক আগের ঘটনা, বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হন আগরওয়াল পরিবারের বাবা ও তাঁর শিশুসন্তান। তার আগে আরও দুটি হাসপাতাল ঘুরে তাঁরা সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন। মাত্র কয়েকদিনেই এই হাসপাতালে বিল হয় প্রায় ২৪ লক্ষ টাকা। বিল না মেটানো পর্যন্ত আটকে রাখা হয় দু’জনকে। এরপর কলকাতা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয় এই পরিবার। আদালতের নির্দেশে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তাঁরা। পরিবারের বক্তব্য, তাঁরা কিছুটা সময় চেয়েছিলেন, তাও দেওয়া হয়নি ওই বেসরকারি হাসপাতাল থেকে। এ বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ, টাকা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছে পরিবার, তাদের সে সময় দেওয়া হোক। 

এর ঠিক আগে মার্চ মাসেই সংবাদ শিরোনামে আসে আরও একটি ঘটনা। দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে পেটের যন্ত্রণা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জনৈক ফৈয়াজ হোসেন। কোনওরকম অপারেশন ছাড়াই মাত্র ৮ দিনেই বিল হয় প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। শুধু তাই নয়, টাকা মেটানোর জন্য একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য করা হয় এই পরিবারকে। অভিযোগ যায় স্বাস্থ্য কমিশনে। গোটা ঘটনায় পুলিশি তদন্তের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য কমিশন। এছাড়াও রোগীকে ঋণমুক্ত করার নির্দেশও দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্য কমিশনের শুনানিতে গত এক বছরে উঠে এসেছে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার বিল হাসপাতালের গাফিলতির অসংখ্য উদাহরণ।

শুধু গত এক বছরেই নয়, স্বাস্থ্য কমিশনে অভিযোগের তালিকা বেড়ে চলেছে গত ৩- ৪ বছর ধরেই। গত বছর মার্চ মাসে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে ইনডোর এবং আউটডোরে চিকিৎসার খরচ এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার খরচ বেঁধে দিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ২০২৩ সালের ২ মার্চ। বলা হয়েছিল রাজ্যের প্রায় ৪ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম যাতে খরচের ঊর্ধ্বসীমা নির্দিষ্ট করে তার জন্যেই এই কমিটি কাজ করবে। স্বাস্থ্য কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মর্মে অর্থাৎ খরচের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয় কলকাতা হাইকোর্টে। কিন্তু নবান্নের ওই কমিটি গঠনের ১৩ মাস পরেও তা কার্যত নিষ্ফলা রয়ে গেল। সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য কমিশনের শুনানিতেই ধরা পড়ছে হাসপাতালের বিলের ব্যাপক অসঙ্গতির চিত্র। 

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, সাধারণ মানুষ ঘটিবাটি, জমি বাড়ি বিক্রি করে বেসরকারি হাসপাতালের বিল মেটাতে বাধ্য হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ যাতে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকে, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে অবিলম্বে। সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, সরকারি হাসপাতালের খরচের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে তা ১৪ বছরের পুরানো একটি আইনে বলা আছে। কেন সেই আইন মানা হচ্ছে না তা আদালতকে জানাতে হবে। অর্থাৎ বেসরকারি হাসপাতালের অত্যধিক খরচ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই কেন তা জানতে চায় সুপ্রিম কোর্ট।

এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার আছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার। কেন্দ্রীয় সরকার এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। কেন্দ্রের তরফে সাফাই দিয়ে বলা হয়, রাজ্যগুলির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলেও কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি রাজ্য সরকারগুলির তরফে। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, সরকার যদি নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হয়, অর্থাৎ চিকিৎসার খরচের কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি না তৈরি করতে পারে, তাহলে বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পের হার অনুযায়ী পরিষেবা চালু করে দেওয়া হবে।  সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বৃহৎ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর বক্তব্য, সরকারি ক্ষেত্রের পরিকাঠমো যদি ঠিক থাকত, চিকিৎসা পরিষেবা যদি ঠিকঠাক মিলতো তাহলে চতুর্দিকে এত বেসরকারি চিকিৎসা ক্ষেত্র গজিয়ে উঠত না। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ না করে, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা না করে চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থে এলাকায় এলাকায় নার্সিংহোম, হাসপাতাল খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। স্বাস্থ্যসাথি থেকে বাদ হয়ে যাচ্ছে হার্নিয়া থেকে হাইড্রোসিল সহ বেশ কয়েকটি অপারেশন। সাধারণ মানুষ তাহলে যাবে কোথায়? 

এর ওপর যোগ হয়েছে স্বাস্থ্যবিমা। চিকিৎসকদের বক্তব্য, স্বাস্থ্যবিমার জন্য সরকার যা খরচ করে তা আসে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ করদাতাদের টাকা থেকে। এই সরকারি খরচের একটা বড় অংশ যায় বেসরকারি হাসপাতালকে টাকা দেওয়ার জন্য। ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি রিপোর্ট ২০২২-২০২৩ অনুযায়ী ‘আয়ুষ্মান ভারত বিমা’ প্রকল্পের মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে টাকা খরচ করেছে, তার প্রায় ৬৬ শতাংশ গিয়েছে বেসরকারি ক্ষেত্রের কাছে। এই অর্থ অবশ্যই সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করা যেত। আসলে সরকার সাধারণ মানুষের টাকা বেসরকারি, কর্পোরেট হাসপাতাল বা সংস্থাকে পাইয়ে দেয়। সরকারি ক্ষেত্রকে বেহাল করে রেখে এইভাবেই চলছে রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা। গ্রামে গঞ্জে মানুষ দিশাহারা।


 

Comments :0

Login to leave a comment