RSS

দেশপ্রেম কী, ঠিক করবে আরএসএস?

জাতীয়

প্রতীম দে

‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে অংশ নেয়নি আরএসএস এবং অনুগামী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি। 
তখনও বিজেপি তৈরি হয়নি। কিন্তু বিজেপি যে ফ্যাসিবাদী লক্ষণসম্পন্ন শক্তির রাজনৈতিক শাখা, সেই আরএসএস রয়েছে পুরোদমে। আরএসএস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে অংশ কেবল নেয়নি তা নয়, সব স্তরে আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে তা-ও কেবল নয়, আরএসএস ব্রিটিশকে সহায়তা করেছে। সেই আরএসএস আজকের ভারতে দেশদ্রোহী আর দেশপ্রেমিক ঠিকও করে দিচ্ছে! দেশপ্রেম কিভাবে দেখাতে হবে, তা-ও হবে এদের কথায়!
বিজেপি’র আরাধ্য বীর সাভারকর, প্রধানমন্ত্রীরও। কিন্তু সাভারকর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেননি কেন, সেই ব্যাখ্যা দেননি তিনি। আবার এই বিজেপি এবং আরএসএস-ই নিয়মিত দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দিচ্ছে সবাইকে, বিশেষ করে বিরোধী এবং প্রতিবাদীদের। ৮ আগস্ট ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে নরেন্দ্র মোদীই আবার বিরোধীদের বলছেন ‘ঘমাণ্ডিয়া’ মানে অহঙ্কারী।  
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সাভারকর আরএসএস’র কর্মীদের তাঁর দেওয়া বার্তায় বলেছিলেন, ‘‘স্থানীয় প্রশাসনিক স্তরে যারা যেই স্থানে রয়েছেন তাঁরা তাঁদের পদ থেকে কোন ভাবে যেন ইস্তফা না দেন।’’ নিজেদের পদে বহাল থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল সাভারকার। 
বিজেপি একাধিক সময়েই বলে যে কমিউনিস্টরা ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেয়নি। যেটা বলে না তা হলো সেই পর্বেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী জার্মান বাহিনী আক্রমণ করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে। ব্রিটিশরা দূর থেকে দেখলেও নাৎসীদের পক্ষে ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশকে সহযোগিতা তো দূর, কমিউনিস্ট পার্টিকেই বারবার ব্রিটিশের দমনের মুখে পড়তে হয়েছে। আন্দামানের সেলুলার জেলে সাজা পাওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যোগ দিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টিতেই। 
সাভারকারের ব্রিটিশ প্রীতি
সাভারকর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে যান। ৫০ বছর জেলের সাজা হয় তাঁর। ১৯১০ সালে সাজা পাওয়ার পর থেকেই সাভারকার চেষ্টা চালাতে থাকেন কী ভাবে জেলের বাইরে আসবেন। দশ বছর জেলে থাকাকালীন একাধিক বার শাস্তি মকুব করার আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখতে থাকেন তিনি। প্রতিটি চিঠিতে সাভারকর দাবি করে এসেছেন যে, সে সরকারের যে কোন আনুগত্য মানতে তৈরি। দীর্ঘ ক্ষমাভিক্ষার পর পর ১৯২৪ সালে জেল থেকে ছাড়া হয় সাভারকার এবং তাঁর ভাইকে। সেই সময়েই সহবন্দিরা ব্রিটিশের অত্যাচারে মাথা নোয়াননি। 
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জায়গা থেকে সরিয়ে ধর্মের বিভাজনে ভেঙে ফেলার কৌশলের অন্যতম প্রধান রূপকার সাভারকর এবং সমগ্র হিন্দু মহাসভা। সাভারকর জেলের বাইরে এসে ব্রিটিশদের চরের ভূমিকা পালন করেছে। তারা যাতে শাসন চালিয়ে যেতে পারেন তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছাড়া আরও একটি আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে দেশের বাইরে। ইংরেজ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে ভারতের বাইরে গিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন সুভাষ চন্দ্র বসু। তৈরি হয় আইএনএ বা আজাদ হিন্দ ফৌজ। সেই সময় জাপানের সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই সংগঠিত করছেন সুভাষ বসু তেমন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। 
স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল পর্বে যখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দরকার তখন মুসলিম লিগ এবং হিন্দু মহাসভা দুই সাম্প্রদায়িক শক্তি মানুষের মধ্যে ভাগাভাগি করতে উদ্যত হয়। 
স্বাধীনতার ৭৬ তম বর্ষে এই বিভাজনের রাজনীতিকে বিশৃষভাবে মনে রাখা দরকার। বেকারত্ব যখন বাড়ছে। জিনিসের দাম যখন আকাশ ছোঁয়া। গরিব মানুষ যখন আরও গরীব হচ্ছে। কাজের জন্য একটা ছেলেকে বাইরে যেতে হচ্ছে নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্য। কৃষক যখন ফসলের দাম পাচ্ছেন না। শ্রমিক যখন নিজের শ্রমের অধিকার পাচ্ছেন না। ঠিক তখনই ফের রাম মন্দির বা জ্ঞানবাপী মসজিদের নাম করে মানুষের মানুষের ভাগ করা হচ্ছে। কখনও ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে বা সিএএ, এনআরসির নাম করে মানুষের মধ্যে ভাগ করা হচ্ছে। মণিপুরে অশান্তি ছড়ানো হচ্ছে জাতের দোহাই দিয়ে।
তবে মনে রাখতে হবে এই এনআরসি এবং সিএএ’র বীজ বপন করে গিয়েছে হিন্দু মহাসভা। বিভিন্ন দলিল ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে কখনও ‘ভারতীয়’ বলে তারা মনে করেনি। প্রথম থেকেই মহাসভা দাবি করে এসেছে যে, ভারতে যেই মুসলিমরা রয়েছেন তাঁদের আসল দেশ অন্যত্র। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের অবদান রয়েছে বহু ক্ষেত্রে। অথচ হিন্দু মহাসভা বা আজকের বিজেপি’র নির্দেশ মানলে তাঁদেরই ভারতীয় হিসেবে সমান অধিকার দেওয়া যাবে না। নাগরিকত্বে ধর্মের রঙ লাগিয়েই সংশোধিত আইন মোটেই আচমকা কোনও ভাবনা নয়। স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময়ও ধর্মের নিরিখে ভারতীয় বিবেচনার তত্ত্বকে কেবল কমিউনিস্টরা খারিজ করেননি, খারিজ করেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও।   
হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগ একই মুদ্রার দুই পিঠ
নরেন্দ্র মোদী যেই সাভারকারকে ‘ভারত মাতার প্রকৃত সন্তান’ বলে চিহ্নিত করেছেন সেই সাভারকার ছোট বয়স থেকেই প্রবল ভাবে মুসলিম বিদ্বেষী। জ্যোতিন্ময় শর্মা তাঁর ‘Hindutva : Exploring the idea of Hindu Nationalism’ বইতে লিখেছেন যে, ১৮৯৪–৯৫ সালে মুম্বাই এবং পুনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় স্কুল পড়ুয়া সাভারকার বন্ধুদের নিয়ে স্থানীয় মসজিদে আক্রমণ করেন। বাইরে থেকে ঢিল ছুঁড়ে মসজিদের দরজা জানালা ভেঙে দেয় তারা। পড়ে ওই ঘটনায় কয়েকজন মুসলিম খুন হলে উৎসব পালন করেন সাভারকর। সাভারকর যেমন মুসলিম বিদ্বেষি তেমন ভাবে খ্রিষ্টান বিদ্বেষ রয়েছে তাঁর মধ্যে। মুসলিম লিগকে সঙ্গে নিয়ে সাভারকর দাবি করেছিলেন যে ব্রিটিশরা জোর করে ভারতীয়দের খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করছে।
রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ফলে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়। এই সংস্কারেরও বিরোধী সাভারকর। সাভারকারের একটি লেখায় এই বিষয় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সরকার একের পর এক আইন পাশ করিয়ে সনাতন হিন্দু সংস্কৃতিকে শেষ করে দিচ্ছে।’
হিন্দুত্ববাদীরা আড়াল করার চেষ্টা চালালেও এটা বাস্তব যে পরাধীন ভারতে প্রাদেশিক নির্বাচনের পর বাংলা এবং একাধিক প্রদেশে মুসলিম লিগ এবং হিন্দু মহাসভা একসাথে জোট করে সরকার চালিয়েছে। সাভারকরের জীবনীতে একে আবার ‘বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাফল্য’ বলে দেখানো হয়েছে। ১৯৩০ এর অসহযোগ আন্দোলনেও দেখা যায়নি নরেন্দ্র মোদীর পূর্বজদের।
আরএসএস প্রথম থেকে দাবি করে এসছে হিন্দু রাষ্ট্র, মুসলিম লিগ দাবি করে এসেছে মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র। আরএসএস বলে এসেছে মহাত্মা গান্ধীর জন্য ভারত ভাগ হয়েছে। বিজেপি বলছে কংগ্রেসের জন্য দেশভাগ হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির ভূমিকা কী, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। 
১৯৪০ সালে লাহোরে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ প্রথম পেশ হয় মুসলিম লিগের অধিবেশনে। দ্বিজাতি তত্ত্ব, অর্থাৎ হিন্দু এবং মুসলিম দু’টি আলাদা জাতি। ফলে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্র যুক্তিযুক্ত। এই তত্ত্বকে দেশভাগের জন্য সামনে রেখেছে মুসলিম লিগ। ঠিক একই তত্ত্ব ভিন্ন চেহারায় পেশ করেছিলেন সাভারকর। লাহোর অধিবেশনের তিন বছর আগে দ্বিজাতিতত্ত্ব পেশ করেন সাভারকর।
সাভারকরের যুক্তি ছিল, ভারতীয় হতে হলে ভারত হতে হবে পিতৃভূমি এবং পূণ্যভূমি। মুসলিম এবং খ্রীস্টানদের ধর্মীয় স্থান যেহেতু ভারতের ভৌগলিক ভূখণ্ডের বাইরে, এই তত্ত্ব অমুযায়ী তারা ভারতীয় নয়। তারা একই সংস্কৃতির বাহকও নয়। 
স্বাধীনতার লড়াইয়ের ব্রিটিশের সামনে দাঁড়িয়ে লড়া সব অংশই এই তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন।  
এই দুই সংগঠন প্রথম থেকেই মানুষের মধ্যে ভাগ করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা বিজেপি দেশের ক্ষমতায়। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মানুষকে মধ্যে ভাগ করার জাল তারা বুনছে।

Comments :0

Login to leave a comment