গল্প
চাঁদ-ভৈরবের কিসসা
সৌরভ দত্ত
নতুনপাতা
আষাঢ়ের মেঘ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এনেছে–চল আমরা আমপাতার ভেঁপু বানাই–হাঁটতে হাঁটতে চাঁদ বলছিল ভৈরবকে–চাঁদ আর ভৈরব কুসুমপুরের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়–দয়াময়বাবু দিকুদের বিরুদ্ধে
সিধো-কানু-চাঁদ-ভৈরবদের হুলের বীরত্বের স্মরণ করে নাম রেখেছেন আদিবাসী নাম রেখেছেন নিজ পুত্র দ্বয়ের।বছর পনেরো বনবিভাগের রেঞ্জার অফিসারের চাকরি সূত্রে এই কুসুমপুরে ঘরবার।থাকেন একটি বন বাংলোয়। অনেক আগে এই গাঁয়ে লব মান্ডি একবার জেলে গিয়েছিল বনবিড়াল মেরে পুড়িয়ে খেয়ে ।তারপর অনেক কান্নাকাটি, পীড়াপীড়িতে দয়াময় বাবুর সৌজন্যেই মুচলেকা দিয়ে কোনক্রমে ছাড় পেয়েছিল সে যাত্রায়।সেই থেকে লব মান্ডির পরিবার দয়াময় বাবুকে খুব সম্মান করে। কৃতজ্ঞতা দেখায়।মধু ভাঙলে কাঁচের শিশিতে পাঠিয়ে দেয় চাঁদ-ভৈরবের মাকে।
আসলে আদিবাসীদের কোনো দেশ নেই–গ্রাম নেই–বানজারারা তাঁবু খাটায় এক সময় পাশের কলোনিতে মেয়ে-মদ্দ ঠেসাঠেসি করে থাকে। আকাশের মিহিন চাঁদের আলো বাচ্চাদের চোখের উপর পড়ে।
ওরা পিঁপড়ের ডিম খায়,জঙ্গলের মধু সংগ্রহ করে। কাঠবিড়ালি,ভাম শিকার করে।বনবিভাগ ওদের জোর করে তুলে দেয়। পুলিশ দেখলেই খেদায়। ওদের পাট্টা নেই-জমির কাগজ নেই ।ওরা প্রকৃতি মায়ের সন্তান।সেবার এক বাচ্চাকে দেখে চোখে জল চলে এসেছিল দয়াময় বাবুর।বাদুড়ের মাংস দিয়ে ওকে ভাত খাওয়াচ্ছিল ওর মা।পরনে ছেঁড়া কাপড়,মাথার চুল পরিচর্যা হীন। অফিসাররা ঠেলে উঠিয়ে দিল এলাকা ছাড়া করল।পড়ে রইল অভুক্ত ভাতের থালা।
ফলহারিনী অমাবস্যা তিথিতে সেঁদরা পরবে তারা তীর-ধনুক-ছোরা-বল্লম নিয়ে শিকারে বেরোত দলবেঁধে। ইদানিং বেশ কিছুদিন জঙ্গলগড় বনবিভাগের সক্রিয় উদ্যোগে শিকার উৎসব বন্ধ। মহাশ্বেতা দেবীর অরণ্যের অধিকার পড়েছেন দয়াময় বাবু। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কিছু কিছু জিনিস তিনি মেনে নিতে পারেন না।ধরতি আবা বীরসার রক্ত বমির দৃশ্য তার চোখে জল আনে।সেই কবে বন্ধ হয়ে গেল স্থানান্তর চাষ। হারিয়ে গেল সাঁওতালদের বনভূমির স্বীকৃতি।জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার।
চাঁদ-ভৈরব মহুয়া গাছকে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখে সাঁওতাল বিদ্রোহের–আগুনে ভরে ওঠে অক্ষিগোলক–
ভাগলপুরের বুকে সিধো-কানুর অমর আন্দোলনের কথা দাদুর মুখে শুনেছে–ইতিহাস বইয়ে পড়েছে তীর ধনুক নিয়ে জোরদার লড়াইয়ের গল্প।ওরা হাত ধরাধরি করে হেঁটে যায় লালমাটির পথে। কিছুটা দূরে শালগাছের নিচে মারাং বুরুর থান।সাহারায় উৎসব হয়। মাটির ঘোড়া বসানো থাকে। গাছে বাঁধা হয় খড়ের শিখলি।এখানেই ওরা মাঝেমাঝে ইংরেজ আর সাঁওতাল সেজে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে।নিজেদের মধ্যে বাঁখারি আর দড়ি দিয়ে তীর ধনুক বানায়।পাঁকাঠির মাথায় বিশেষ কৌশলে তৈরি করে হুলের ফলা। জঙ্গলে বহু পাখির ডাক শুনতে পায়।
চাঁদের মনে পড়ে যায়– বাবা কাল খেতে খেতে বলছিল– লব কাকুদের বাড়িতে আজ হুল উৎসব।তাই ওদের দুজনের নিমন্ত্রণ।চাঁদ বলে ভৈরবকে– তাড়াতাড়ি চল–ওরা পা চালায় দ্রুত।ঝিলের সাঁকো টপকায়।খাটিয়ায় বসে শাল পাতায় চাঁদ-ভৈরব বনমোরগের ঝোল খাবে। গ্রামের মুখিয়া বৃদ্ধ দুর্জন সোরেনের সাঁওতালি গান শুনতে শুনতে হুলের আমেজে মেতে উঠবে সারাদিন। ভাঙা ভাঙা গলায় দুর্জন গাইবে দুর্ভিক্ষের গান–
“সেদায় আকালদ
নাসে নাসে দঞ দিশায় গেয়া।।
সিঞ দলে জমা সিঁজ বিলি
ঞিদা দলে জমা মাতকম লাঠে।”
Comments :0