নাম বাপ্পা নস্কর। ভোটার তালিকা তাই বলছে। একবার নাম রয়েছে ২২৯ নম্বরে। আর একবার নাম রয়েছে দু’জনের পরে, ২৩২ নম্বরে! কেন্দ্র যাদবপুর, পার্ট নং-৯০।
তালিকায় ‘২২৯’ নম্বরের বাপ্পার ক্ষেত্রে উল্লেখ আছে তার বাবার নাম। পরের বাপ্পার নামের নিচে মা’র নাম। আর প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, সেই ‘বাবা’ এবং ‘মা’ আসলে স্বামী স্ত্রী। তাহলে মোদ্দা কী দাঁড়ালো? এক দম্পতির দুই সমবয়সি ছেলে। তা হতেই পারে। যমজ তো কতই হয়। কিন্তু দুই ছেলেরই তাঁরা নাম রেখেছেন বাপ্পা! তৃণমূল কতটা বেপরোয়া— দু’জনের নাম রেখেছে একই পার্টে! প্রায় পর পর।
সেই ব্যক্তির দুটি আলাদা ভোটার কার্ড। একটির নম্বর— এসসিজি ২৯৪৬২০০। দ্বিতীয় ভোটার কার্ডের নম্বর এসসিজি ৩৫৭২১৩৮। দুজন কি আলাদা লোক? কার্ড, সিরিয়াল নম্বর তাই বলছে। কিন্তু ছবি তা বলছে না। দু’বারই এক বয়স— ২৯। তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য ঠিকানায়। প্রথমবার, ঠিকানা ১৫/১/এ। দ্বিতীয়বার— ১৫/এ।
অর্থাৎ পাশাপাশি বাড়ির বাসিন্দা এমন দুই বাপ্পা নস্কর, যাঁদের বয়স এক। দেখতে এক। বাবা, মাও এক!
এমন মজা শুধু যাদবপুরের সন্তোষপুরের ওই এলাকার ভোটের তালিকাতেই আছে, তা নয়। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি বিধানসভায় এমন ‘বাপ্পা’দের ছড়াছড়ি। সিপিআই(এম) কর্মীরা যখন বুথে বুথে ভোটার তালিকাকে ‘বাপ্পা’ মুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন মিডিয়ার দৌলতে তৃণমূল আর বিজেপি হিন্দু-মুসলমান খেলা খেলছে। ভোটার তালিকা নিয়ে একবার মমতা ব্যানার্জি, একবার অভিষেক ব্যানার্জি বিস্তর হাঁকডাক করে সভা করেছেন। নানা নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দু’জনের কেউই রাজ্যের ভোটার তালিকায় এই ‘বাপ্পা’দের নাম কাটার দাবি জানাননি। আর শুভেন্দু পড়ে আছেন ‘হিন্দুদের’ ভোট নিয়ে।
কিন্তু ‘বাপ্পা’রা আছে। মৃত ‘বাপ্পা’, জীবিত ‘বাপ্পা’। অন্যত্র চলে যাওয়া ‘বাপ্পা।’ প্রমাণ অনেক। যেমন রানাঘাটে হয়েছে। রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভার একটি পার্ট নং ৮৯। সেই পার্টে ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে গত কয়েক বছরে, কিন্তু তাঁদের নাম আছে ভোটার তালিকায়। বিডিও’র কাছে তালিকা দিয়ে নামগুলি কেটে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আবেদন করা হয়েছে। কাজের কাজ হয়নি। কেন? দুটি কারণ আছে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। বিজেপি আবেদন করেনি। তাদের আশা সেই নামগুলির কিছু অংশ তারা জাল ভোট দিতে পারবে। আর তৃণমূলেরও একই আশা। ভোটের দিন তারা গায়ের জোরে, পুলিশের সাহায্যে ওই নামে ভোট দিতে পারবে। তাই অভিযোগ জানাচ্ছে শুধু সিপিআই(এম)। এমনকি সেই পার্টের সিরিয়াল নং ৬ এবং ৭-এ পর পর দুটি নাম আছে গৌরাঙ্গ আইচ এবং সাবিত্রী আইচ। দুজনেই প্রয়াত। দু’জনেরই নাম আছে। এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে সেই তালিকায়। এই বিধানসভার আর একটি পার্টি নং ১৮৩। এই পার্টে মৃত ৫৩ জনের নাম আছে। নাম বাদ দেওয়ার আবেদন শুধু করেছে সিপিআই(এম)। শুধু এই দুটি পার্টই নয়। রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভার মোট ৩০৮টি বুথ। এই বিধানসভার মধ্যে ১৪টি পঞ্চায়েত আছে, আছে একটি পৌরসভা। তিনশোর বেশি বুথের ১৪১টিতে পরীক্ষা করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সিপিআই(এম) কর্মীরা ১৫১৯ জন মৃত ভোটদাতার নাম চিহ্নিত করেছেন, যাঁদের নাম এখনও রয়েছে ভোটার তালিকায়। তাছাড়া প্রায় ৬০টি বুথে এমন ৫২১ জনের নাম চিহ্নিত করা গিয়েছে, যাঁরা এলাকায় আর থাকেন না। কিন্তু মৃত অথবা এলাকাত্যাগী, এই প্রত্যেকের নাম ভোটার তালিকায় রয়েছে। আরএসএস অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় দাবি করেছে, নদীয়ায় তাদের অগ্রগতি খুব ভালো। কিন্তু ভোটার তালিকায় এই বিপুল ‘জাল’ নিয়ে তারা কোনও কথা বলেনি। বলেনি বিজেপি-ও। আর তৃণমূল বলছে ভিন রাজ্যের মানুষের নাম আমাদের তালিকায় ঢুকে আছে। কিন্তু আমাদের রাজ্যের মৃত, অন্যত্র চলে যাওয়া মানুষের নাম ভোটার তালিকায় থাকবে কেন? অন্যত্র চলে যাওয়ার তালিকাও ছোট নয়। উদাহারণস্বরূপ ওই বিধানসভার ১০০ নং পার্টে ১৭ জন সেই এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের নাম রয়েছে। ১৩৭ নং পার্টে অন্যত্র চলে যাওয়া ভোটদাতা নাম আছে ৬১ জনের। কারও নাম কাটা যায়নি।
সিপিআই(এম)-র বিধানসভা এলাকা কমিটির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে যে, ‘‘আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে বিএলও অফিসারদের কাছে নির্বাচন বিধি প্রোফর্মায় নির্দিষ্ট করে জমা দেওয়ার পরেও সঠিক সুরাহা পাওয়া যায়নি।’’
কারণ— এই নামগুলি দু’দলেরই জাল ভোট দেওয়ার অস্ত্র।
বিজেপি’র কাণ্ড স্পষ্ট হয়েছে যাদবপুরের একটি ঘটনায়। সেই ভোটদাতার নাম আছে দুটি জায়গায়। বারাসতে আর যাদবপুরে। সিপিআই(এম) কর্মীরা নানা সূত্রে তা জেনেছেন। জানার কথা তৃণমূলের, প্রশাসনের। তাঁরা হয়তো জানেনও। কিন্তু কিছু বলেননি।
তাই বিজেপি’র সক্রিয় কর্মীর বাড়িতে ভোটার তালিকা সঙ্গে নিয়ে পার্টিকর্মীরা ওই বছর পঞ্চাশের মহিলার কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘‘আপনি যে কোনও একটি জায়গায় নাম কাটুন।’’ মহিলার স্বামীও বিজেপি’র নেতা। মহিলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘নাম কাটার অভিযোগ হলে বুঝে নেবো।’
ঘটনা এমন অনেক। ভোটার তালিকায় ‘ভুতুড়ে নাম’ নিয়ে তৃণমূল-বিজেপি জোর লড়াই চলার ভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কেউ কাউকে ঘাঁটাচ্ছে না।
Trinamool is silent along with BJP
বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলও চুপ, নির্বিকার কমিশন

×
Comments :0