কাকড়াবন বাজারে সিপিআই (এম) অফিস খোলা গেছে মাসখানেক আগে। বারেবারে হামলা, আগুন লাগানোর সাক্ষ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দপ্তর। তার থেকে কিছু দূরে তিন তলা ঝাঁ চকচকে অটল ভবন বানিয়েছে বিজেপি। গোটা বাজার এলাকা গেরুয়া পতাকায় ঢাকা। আগরতলা থেকে উদয়পুর আসার পথে জাতীয় সড়ক হোক বা মূল সড়কগুলিতে সর্বত্র বিজেপি’র পতাকা। লাল পতাকা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ভোট যেন একতরফা।
রাস্তার ধারে ছোট্ট ভাতের হোটেল বিপ্লব চৌধুরির। সঙ্গে কাজ করছেন তাঁর স্ত্রী। বিজেপি’ই আসছে তো আবার? প্রশ্ন শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘হ আইতাসে। কোনো কাম করে নাই।’ তাহলে আসছে না? ফের প্রশ্নে হঠাৎ যেন গুটিয়ে নিলেন। আর কথা বাড়ালেন না। যেন মুহূর্তের অসতর্কতায় বলে ফেলেছেন। বাজারে এক বড় দোকানদার গলার স্বর ফুলিয়ে জোরের সঙ্গে বললেন ফের বিজেপি’র সরকার আসবে। আমরা খুবই সন্তুষ্ট। যদিও জানালেন, ব্যবসার হাল খুব খারাপ। সরকারের থেকেও কিছু পাইনি। আলোচনার ফাঁকেই গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির সুদীপ। অঙ্কে এমএসসি করতে চাওয়া সুদীপ উলটো দিকের মনোহারি দোকান চালায়। সেও সুর মেলালো ওই দোকানদারের সুরেই। কিছু পরে দূরে সরে আসতেই তার বক্তব্য বদলে গেল, ‘সরকার চেঞ্জও হতে পারে!’ চাপা গলায় বললেন, ‘সবার সামনে এসব কথা বলা যায় না, বুঝলেন।’
মির্জার শামুকছড়ার বাসিন্দা বিজয় মুড়াসিং বললেন, যতক্ষণ না আশ্বস্ত হচ্ছে, কেউ আপনাকে বলবে না যে রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হতে পারে। বাইশ-তেইশের যুবক প্রতিবেশী বন্ধুদের নিয়ে রবিবার মানিক সরকারের সমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বললেন, বড় রাস্তায় পাবেন না। লাল পতাকা দেখতে হলে গলিতে ঢুকতে হবে। এখান থেকে পতাকা ফেলুক, দেখি কত সাহস! ভোট দিতে পারবেন এবার? প্রশ্নের জবাবে পালটা প্রশ্ন কে আটকাবে? আমরা, কংগ্রেস, মথা একসঙ্গে ভোট দিতে যাব। আমাদেরও তো দু’টো হাত আছে!
ছাপোষা মানুষ বিজয়ের মতো এত সুর চড়াতে পারেন না। কিন্তু ওই ‘আশ্বস্ত’ হলে ভোট দেওয়ার জেদটা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে সর্বত্রই। কাকড়াবন-শালগড়া কেন্দ্রের বিধায়ক, প্রার্থী রতন ভৌমিক বললেন, মানুষ যাতে ভয় কাটিয়ে ভোটটা দিতে পারে, শুধু সেইটুকুই নিশ্চিত করতে হবে।
কাকড়াবন থেকে মেলাঘর যাওয়ার রাস্তা আটকে সমাবেশ করছে বিজেপি। দাপাদাপি বাহিনীর অনুগ্রহে রাস্তা পেয়ে ধনপুর কেন্দ্র পেরিয়ে পৌঁছনো গেল সোনামুড়া কেন্দ্রে। এখানের বাম-কংগ্রেসের প্রার্থী, বর্তমান বিধায়ক শ্যামল চক্রবর্তীর উপরে দু’দিন আগেই হামলা করেছিল বিজেপি মেলাঘরের চর এলাকায়। অল্পের জন্য মাথা রক্ষা পায় দেহরক্ষীর তৎপরতায়। তিনি সহ সিপিআই (এম) কর্মীরা জখম হয়েছিলেন। পালটা প্রতিরোধে পালায় দুর্বৃত্তরা। সেই মেলাঘর বাজারের প্রখ্যাত মিষ্টির দোকানিও খুবই জোরালো সওয়াল করলেন বিজেপি জিতবে বলে। দোকানে ক্রেতার ভিড় আর বাইরে তখন মিছিল যাচ্ছে বিজেপি’র। তাহলে শ্যামল চক্রবর্তী এবার আর জিতবেন না? এবার বললেন, উনিও জিততেও পারেন। চান্স আছে!
বাজারের উপর দিয়ে যাওয়া মেন রোড ছেড়ে গলির মধ্যে আছে লাল পতাকা। ফিসফিস কথাতে আছে লাল পার্টির কথাও। লাল ঝান্ডার মাঝারি আকারের মিছিল চলেছে সমাবেশের পথে। মিছিলের দিকে তাকিয়ে চা দোকানি স্বামী-স্ত্রীর চোখে খুশির ঝিলিক। ‘আশ্বস্ত’ হওয়ার পরে প্রৌঢ় বললেন, নগর পঞ্চায়েতে ভোট দিতে পারিনি। লোকসভা ভোটেও লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে বুথ থেকে। তাহলে এবার? কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘এবার পারবে না।’ কোথায় এত জোর পাচ্ছেন তিনিই জানেন।
সোনামুড়ার মধুবন কলেজের পাশে জমিতে সবজি চাষ করেন আবিল মিয়া। শীতে কপি চাষ করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, দাম পাননি। গরমের পটল আর কাকরোলের দাম পাবেন এই আশায় রয়েছেন। চাষ ছাড়া আর তো কিছুই পারি না, সহজ স্বীকারোক্তি তাঁর। লোকসান হলেও তাই করতে হয়। তাঁর গ্রামে হিন্দু-মুসলিম সমান সমান। ভোটে কি হবে? জবাবে বললেন, ‘এবার ভোট দিতে পারুম। প্রশাসন আছে তো।’
-যদি ভোটের দিন না থাকে? ‘তাহলেও দিমু। এবার যেইভাবে হোক ভোট দেওন লাগবে।’ আবিল মিয়ারা ‘বংশ পরম্পরায়’ কংগ্রেসী। কথোপকথনের মাঝে হাজির আরও দু’চার জন। তাঁরাও ‘বরাবর কংগ্রেস’। তাঁদের গ্রামের মুসলিম ভোট অন্যবার ভাগ হয় কংগ্রেস-বামে। ‘এবার সবটা সিপিএমে’। হিন্দু ভোট তিন ভাগ হয়। কংগ্রেস-সিপিএম’রটা পাওয়া যাবে।
মেলাঘরে বিজেপি’র মিছিলে যাচ্ছেন কিছু মুসলিম মহিলা। সাধারণত যা দেখা যায় না। যদিও ত্রিপুরায় বিজেপি মুসলিম প্রার্থী করেছে। আবিলরা যদিও বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ। বললেন, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য হবে। না গেলে নাম কেটে দেবে। ভোটের আগেই তো সব গ্রুপকে ১০-১২ হাজার দিয়েছে।
বিশ্রামগঞ্জে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সভা শেষ করে ফিরছেন বিজেপি কর্মীরা। সর্বাঙ্গে হামলার ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে সিপিআই (এম) সিপাহীজলা জেলা অফিস। কর্মীরা রওনা হচ্ছেন অফিস টিলার সমাবেশের পথে। সন্ধ্যা নামার মুখে সেখানে বলছেন মানিক সরকার। ঠাসা ভিড়ের অধিকাংশই অল্পবয়সী ছেলে। পাঁচ বছর বারে বারে হামলায় বিধ্বস্ত বিশালগড়ে দলে দলে জোয়ান ছেলেরা কাঁচা বাঁশের মোটা লাঠিতে লাল পতাকা, কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে ভিড় করেছে।
পাশের টিলায়, দূরে দূরে ঘর বাড়িতে, বাগানে দাঁড়িয়ে ভাষণ শুনছে আরও অনেকে। তেমনই এক বাড়ির গেটে দুই তরুণ। অফিস টিলা হাইস্কুলের ছাত্র দুই বন্ধুর একজনের বাড়ি। নতুন ভোটার। শুরুতে জানালো ভোটের কথা তারা বিশেষ কিছু জানে না। আলাপ বাড়তে একটু একটু কথা বেরল। নতুন মথা দলকে উপজাতিরা বেশি ভোট দেবে, তারা শুনেছে। তেমনই বাড়িতে, কোচিংয়ে, পাড়ায় ‘শুনেছে’ ভোট দিতে পারলে এবার সরকার বদলে যেতে পারে।
দুই বন্ধুর মধ্যে ভূগোল নিয়ে পড়তে চাওয়া কালো গেঞ্জি নজর করালেন মানিক সরকারের ভাষণের দিকে। মানিক সরকার তখন বলেছেন, ভোটের দিন চার-পাঁচটা পাড়ার ভোটাররা একসঙ্গে যান। বাধা দিলে দু’হাতে পরিষ্কার করুন। আর দু’দিন বাকি। অলিতে-গলিতে, ঘরে-ঘরে লাল ঝান্ডার কথা নিয়ে যান।
Tripura election people
সড়কে পদ্ম, গলিতে লাল পতাকা
×
Comments :0