আবেল গাঁস, গত শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক লিখেছিলেন, মহাকবি হোমারের সময়ে যদি সিনেমার জন্ম হতো তবে তিনি তাঁর ‘ইলিয়াড-ওডিসি' সেলুলয়েডেই রচনা করতেন। ঐ সময়টায় যখন অনেকেই তর্ক জুড়েছেন সিনেমা এসে সাহিত্যের এবং ধর্মের সর্বনাশ করল, গাঁস তখন উলটো পথে হেঁটে সবাইকে নিশ্চিন্ত করে বলেছিলেন, আগামীতে পুরাণ এবং মহাকাব্যের পুনরুত্থান হবে সিনেমার হাত ধরেই।
কথাগুলো স্মৃতির তাক থেকে আর একবার পাড়তে হলো বাংলাদেশের ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ দেখতে বসে। বাংলাদেশের এই ছবিটি সাহিত্য-থেকে-সিনেমা নয় , বরং চরমভাবেই সিনেমা-সাহিত্য। অর্থাৎ মৌলিক একটি চিত্রনাট্য থেকেই তার জন্ম। কিন্তু সে চিত্রনাট্য গড়ে উঠেছে উচ্চমানের সাহিত্যের সবক’টি উপকরণকে আত্তীকৃত করে।
রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’,তপন সিংহের ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’,ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’,গৌতম ঘোষের ‘পদ্মানদীর মাঝি’...বাংলা সিনেমায় নির্মাণজনিত চারটি মাইলফলক শুধু নয় ,এই চারটি ছবিই ছিল ধ্রুপদী উপন্যাস থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিনেমায় আসার মধ্যবর্তী চতুষ্কোণ প্রস্তাব। সময় গড়িয়েছে।এই বঙ্গের উপন্যাস তথা সিনেমা অনেকটাই এখন প্রকৃতির সঙ্গে সহবাসের এই দুঃসাহসী ‘অ্যাডভেঞ্চার’ হারিয়ে ‘ড্রয়িংরুম ড্রামা’য় বন্দী। চলচ্চিত্রের আঙিনা থেকে প্রায় সম্পূর্ণ মুছে গেছে প্রান্তিক জনজীবন। সিনেমার সমস্ত নবতরঙ্গ আজ অবসিত।শুধুই উচ্চবিত্ত জীবনের ভোগের আকাঙ্ক্ষার বৃন্দগান সেখানে।
কিন্তু সূর্য অস্ত যায়নি এখনও। বাংলা সিনেমার সূর্যোদয় হচ্ছে এখন সীমান্তের ওপারে। সেখানেই অর্পিত তপন-ঋত্বিক-রাজেনদের উত্তরাধিকার। এবং বাংলাদেশের সিনেমা এখন নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষার পথ বেয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী,স্বনির্ভর যে তাঁকে আর উপন্যাসের কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। সেই নিজগুণে যেন হয়ে উঠছে সাহিত্য। আবেল গাঁস’র মতোই আমাদেরও মনে হচ্ছে একালে জন্মালে মানিক বা তারাশঙ্কররা তাঁদের ‘পদ্মা’ বা ‘হাঁসুলি’র আখ্যানগুলো সিনেমাতেই ছাপাতেন।
বাংলাদেশের সিনেমা জলকে এখন দারুণ কাজে লাগাচ্ছে। প্রায় নিজস্ব ‘মোটিফ’এর মতো।এই জলকে কাজে লাগিয়েই কিছুদিন আগে সেখানে তৈরি হয়েছে ‘হাওয়া’ নামক ঝড়টি।মাঝসমুদ্রে ট্রলার ভাসানো মাঝিদের গল্প। থ্রিলার। কিন্তু নিছক ‘হু ডান ইট’এর ফর্মুলায় আটকে না থেকে চিত্রনাট্যে নিখুঁত উপাদানে মিশিয়ে নেওয় জাতির শিকড়কে । মঙ্গলকাব্যকে। যা আসলে মধ্যযুগের গল্পে বাঁধা ইতিহাস, যখন বাণিজ্যপ্রবণ বাঙালি জলে বাঁচত।মনসামঙ্গলের চাঁদ(এ ছবির চানমাঝি) সওদাগর আর সর্পদেবীর লড়াইয়ের নবকৃত আখ্যান দেখি ‘হাওয়ায় জলের ওপরে। হাওয়া মূলধারার ছবি। সেখানে বাণিজ্য আছে।অলীকতা আছে। কিন্তু পরিচালক মহম্মদ কায়ুমের অন্যধারার ‘আভা গাঁর্দ’ ছবি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’তেও দেখি সেই জলের কবিতা।এখানে অবশ্য মঙ্গলকাব্য নয়। বরং কখনও আধুনিক উপন্যাসের মানবিক ধারাবর্ণনা, অর্থনীতি আর ডিটেলিংস, আবার কখনও জীবনানন্দ কিংবা জসিমউদ্দিনের করুণ সবুজ ভিজে এক ডাঙার কাব্যকে মিলেমিশে যেতে দেখি পর্দা।আর এই মেশাটাকে মসৃণ করে এ'ছবির সংগীত আয়োজন। কোথাও বিষাদঘেরা লোকগানে। কোথাও আবার বুকচেরা তারসানাইয়ের বেজে ওঠায়। প্রখর বাস্তবের ছবি এসব জায়গায় যেন আবহমান গীতিকার ‘স্যুররিয়াল’ উড়ান পায় মিথের কুড়া পাখির মতো। চেনা যায় ভালো সিনেমা আসলে অর্থনৈতিক ভাষ্যের সংস্কৃতিলিপি হয়ে ওঠার প্রস্তাব।
নদীকেন্দ্রীক ট্র্যাজেডিগুলির শেষে থাকে ঐ নদী ঘিরে সৃষ্ট জনপদের ভেঙে পড়া,বদলে যাওয়া। নিজের চিত্রনাট্যে সেই বড় ‘ডায়াসপোরিক' মুহূর্ত তৈরি করেন মহম্মদ কায়ুম।তাঁর ছবিতে ভাতের খোঁজে নেত্রকোণা'র এক হাওড়-চরে কাজ করতে আসে এক কৃষিশ্রমিক সুলতান (উজ্জ্বল কবীর হিমু’র অতুলনীয় অভিনয়ে যেন মানিক বাঁড়ুজ্জের কুবের ভর করেছিল)। পেটভাতামাত্র চুক্তিতে। যে পরিবারের শ্রমিক হয় সে, সে বাড়িতেই থাকা-খাওয়া। মালিক-শ্রমিকের নিয়ম ছাড়িয়ে এই সম্পর্ক পায় মানবিক বিস্তার। ভালোবাসার বাঁধনে ধরা পড়ে সুলতান ঐ বাড়ির কিশোরী মেয়ে রুকু ও তার মায়ের সঙ্গে। দু-দু’বারের চাষের ফসল তোলার প্রয়াস বিনষ্ট হয় পাহাড় ভেঙে নেমে আসা জলে। হাওড়ের চর তখন যেন সাগরের মোহানা। চূড়ান্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এক দিনে ভাঙনে পড়া জলেঘেরা জমিতে এক বটগাছের তলায় এই তিনজনের কাছাকাছি আসা আর তার অব্যবহিত আগে মৃত শিশুর স্বপ্নে ফিরে আসা...এক স্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টি করে। আবার ভেঙে পড়া জমিতে বাঁধ দিতে উত্তাল জল বেবে বাঁশ নিয়ে আসা, ছবির শেষে নতুন জনপদে কাজের খোঁজে পাড়ি দেওয়া ভয়াবহভাবে দোলায়মান নৌকায় বসে...এসব দৃশ্য শ্রমজীবনের কান্নাঘামরক্তকে আধুনিক ‘ইউলিসিস’এর যাত্রার মর্যাদা দেয়।এর মাঝে মাঝেই আসে নদীর ধারের মেলা, হাসিকান্নার ঘরগেরস্থালি। একটি মহৎ শিল্পের মূল কাজ কী? আপাত তুচ্ছ জীবনের মধ্যেও উচ্চতার শিলালিপি খোঁজা। জীবনকে ভালোবাসতে শেখানো।প্রতিটি শ্রমেঘেরা জীবন এক একটি রূপকথা। এই সিনেমা সেই ‘প্রলেতারিয়েত’-বোধের জলছবি।
এ‘সিনেমা বানানোয় একশো শতাংশ সৎ থেকেছেন পরিচালক। যে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা,ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার মধ্যে এর চিত্রগ্রহণ করেছেন তিনি জীবন বিপন্ন করে,তা অচিন্ত্যনীয় ! হলিউডের ভিএফএক্সসর্বস্ব দর্শনের প্রতিও এ‘যেন এক গরিব দেশের সাহসী শিল্পীর জেহাদ। কুর্নিশ মহম্মদ কায়ুম ও তাঁর গোটা দলকে।
'...বাংলাদেশের উপকূলের দিকে আসন্ন ঝড় ঘুরে গেছে’...এ’খবর শুনে আর স্বস্তি পাবেন না, বরং এ‘বাংলার মানুষেরও চোখ জলে ভরে উঠবে, এ’ছবি দেখার পর। এটাই সিনেমার আন্তর্জাতিকতা।
Comments :0