এদিনের সভার মূল বক্তা ছিলেন এআইপিএসও’র অন্যতম দুই প্রধান পৃষ্টপোষক শমীক লাহিড়ী এবং ভানুদেব দত্ত। সভা পরিচালনা করেন রবীন দেব। সভায় প্যালেস্তাইনের লড়াইকে সংহতি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করেন অধ্যাপক অঞ্জন বেরা।
এদিন শমীক লাহিড়ী প্যালেস্তাইন সমস্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সবিস্তারে তুলে ধরেন। লাহিড়ী বলেন, চলতি বছরের গোড়া থেকে এখনও অবধি ৭০ জনের বেশি সাধারণ প্যালেস্তিনীয়কে খুন করেছে ইজরায়েলের জায়নবাদী বাহিনী। এই হানাদারির সাম্প্রতিক ঘটনায় মোদী সরকারের ভূমিকা লজ্জাজনক বললেও কম। কেন্দ্রীয় সরকার ইজরায়েলো হানাদারির সরাসরি নিন্দা করতেও অক্ষম। এই মুহূর্তে সংঘ পরিবার ভারতের বিদেশ নীতি নির্ধারন করতে চাইছে সরাসরি। প্রতিষ্ঠা পর্ব থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা জায়নবাদী ইজরায়েল রাষ্ট্রের ঘোরতর সমর্থক এবং আরব বাসীদের বিরোধী।
লাহিড়ী মনে করান, সাভারকর ১৯৪৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ন্যায্যত’ গোটা প্যালেস্তাইন ভূখন্ডকেই ইজরায়েলের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। ভারতের বিদেশনীতি যত মার্কিন ঘেঁষা হয়েছে, ততই ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। এই মুহূর্তে ভারত হল ইজরায়েলী অস্ত্রের সবথেকে বড় বাজার। ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ী সরকার গঠনের সময় থেকেই জায়নবাদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের মতাদর্শগত সংহতি স্পষ্ট হতে থাকে। ২০১৪ সালের পরবর্তীতে তা নগ্ন রূপ পেয়েছে। সরকারী স্তরে কিছু কূটনৈতিক মুখোশ থাকলেও, রাজনৈতিক স্তরে সংঘ পরিবার ইজরায়েলী দক্ষিণপন্থাকে খোলাখুলী সমর্থন করছে। ২০১৮ সালে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু’র ভারত সফর কিংবা ২০১৯ সালের ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর ছবি নিয়ে নেতানিয়াহুর দলের প্রচার সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।
লাহিড়ী অভিযোগ করেন, ইজরায়েলের থেকে কেনা পেগাসাস সফ্টওয়ার ব্যবহার করেই নজরদারি চালিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি বলেন, কেন্দ্রের সরকারকে ইজরায়েলের তাবেদারির পথ থেকে সরিয়ে আনতে জনমত গঠন করতে হবে। তারজন্য প্যালেস্তাইন সংহতি আন্দোলনকে গণআন্দোলনের রূপ দিতে হবে। সেই লক্ষকে সামনে রেখে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও শান্তিপ্রিয় শক্তিগুলিকে আরও জোটবদ্ধ করার কাজ চালাতে হবে এআইপিএসও’কে।
এদিন ভানুদেব দত্ত বলেন, প্যালেস্তাইন সমস্যা কেবলমাত্র সার্বভৌমত্বের সমস্যা নয়। এরসঙ্গে যুক্ত রয়েছে পুনর্বাসন, জাতিগত পরিচয়, সামাজিক পরিচয়, অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতো বিষয়গুলি। এই সমস্যাগুলির সমাধান না করে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, সাম্রাজ্যবাদ চায় প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতা দীর্ঘস্থায়ী হোক, ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোয্য। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ এবং সুয়েজ প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেই ইজরায়েলকে বোড়ের মতো ব্যবহার করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ভানুদেব দত্ত, নোবেলজয়ী পদার্থবিদ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের রাজনীতি বিষয়ক বক্তব্যকে হাতিয়ার করে বলেন, আইনস্টাইন বলেছিলেন, নবগঠিত ইজরায়েল রাষ্ট্রের উচিত জোট নিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখা। অন্যথায় শীতল যুদ্ধের আবহে বোড়েতে পরিণত হবে ইজরায়েল। বর্তমান প্রেক্ষাপট আইনস্টাইনের সেই বক্তব্যেরই যথার্থতা প্রমাণ করছে।
এদিন প্রস্তাব পেশ করে অঞ্জন বেরা বলেন, প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধান নির্ভর করছে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনকে পৃথক দুটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, অবৈধ ইজরায়েলী দখলদারি মুক্ত প্যালেস্তাইনের সীমানা নির্ধারন সহ রাষ্ট্রসংঘের ৪টি সিদ্ধান্তের উপর। এই সিদ্ধান্তগুলি ইজরায়েল এড়িয়ে গিয়েছে। এর পাশাপাশি এদিনের সভা থেকে আরও ৬টি দাবি প্রস্তাব আকারে উঠে আসে। অঞ্জন বেরা জানান, এই দাবিগুলির সমর্থনে জনমত গঠন করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত বাধ্য হয় ইজরায়েলী দখলদারী বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করতে।
এদিন রবীন দেব বলেন, ১৯৯০ সালের ২৮ মার্চ প্যালেস্তাইন মুক্তি আন্দোলনের নেতা ইয়াসের আরাফাতকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল কলকাতার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। সেই অনুষ্ঠানে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকে কলকাতা এবং ভারত প্যালেস্তাইনের লড়াইকে সংহতি জানিয়ে আসছে। এআইপিএসও সেই ঐতিহ্যকেই বজায় রাখার লড়াই লড়ছে।
এদিনের সভায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন কাজী কামাল নাসের। আবৃত্তি পরিবেশন করেন রীনা দেব। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন মন্দাক্রান্তা সেন। রাজা রামমোহন রায়ের মূর্তিতে মাল্যদানের মাধ্যমে সভার কাজ শুরু হয়।
Comments :0