Tamanna Khatun

ভোটের আগে হুমকি, ছোট্ট তামান্নাকে,খুন করে নেতার কথা রেখেছে তৃণমূল

রাজ্য

গত শনিবার পলাশীতে বিক্ষোভ সমাবেশ।

সুদীপ্ত বসু ও বিজন কুমার বিশ্বাস  ০  কালীগঞ্জ 
কোনও স্বতঃস্ফূর্ত বিজয় মিছিল থেকে হামলা, বোমাবাজির ঘটনা নয়। ছোট্ট তামান্না খাতুনের বাড়িতে তৃণমূলের নৃশংসতা, বোমা মেরে শিশুকন্যাকে খুনের ঘটনা একেবারেই পরিকল্পিত। গোটা রাজ্যজুড়েই উগ্র দখলদারি, একাধিপত্যের যে নেশা শাসক দলকে গ্রাস করেছে তারই নয়া নজির মোলান্দি।
পলাশীর প্রান্তে মোলান্দি গ্রামের ঘটনাপ্রবাহ অন্তত তাই বলছে।
২৮১। এই হিসেবই আরও উন্মত্ত করে তুলেছিল শাসক তৃণমূলকে। কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে বড় চাঁদঘর পঞ্চায়েতের মোলান্দি গ্রামের চারটি বুথে এক হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। তৃণমূলীদের বোমায় খুন হওয়া ১০ বছরের ছোট্ট তামান্না খাতুনের বাড়ি যে বুথে, সেখানে বামফ্রন্ট সমর্থিত প্রার্থী ২৮১টি ভোট পেয়েছিলেন। তামান্নার বাবা পরিযায়ী শ্রমিক। ওডিশা-অন্ধ্র সীমান্তে বেরহামপুরে ছিলেন তখন। তবুও ট্রেন, বাসে খরচ করেই ফিরেছিলেন গ্রামে। উপনির্বাচনে এসে ভোট দিয়ে গিয়েছিলেন সিপিআই(এম)’র ঘনিষ্ঠ দরদি হোসেন শেখ। ভোট দেওয়ার পরেই ফিরে গিয়েছিলেন। ফের বাড়িতে যখন ফিরলেন, তখন আর হোসেন শেখের আদরের একমাত্র কন্যা তামান্না আর নেই।
মোলান্দির এই বুথেই যেখানে বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস পেয়েছিল ২৮১টি ভোট, বিজেপি সেখানে মাত্র ৫টি ভোট। তৃণমূল ৪৯৩। অর্থাৎ সরাসরি তৃণমূল বনাম সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের লড়াই। বিজেপি নেই। গ্রামে শাসক তৃণমূলের বর্বরতার শিকার হতে হলো তাই সিপিআই(এম) সমর্থকের পরিবারকেই। 
মোলান্দির মসজিদ মোড় পেরিয়ে, পুকুরের ধার দিয়ে কাদামাখা রাস্তা পেরিয়ে শেষপ্রান্তে তামান্নার বাড়ি। উঠোনে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা সেই জায়গা যেখানে মায়ের সামনেই রক্তাক্ত দেহ পড়েছিল তামান্নার। তার পাশেই বাঁশের মাচা। সেখানেই বসেছিলেন তামান্নার জেঠু আবুল কাশেম। গত ছ’দিনেই ভেঙে পড়েছে শরীর, ক্লান্ত মুখে তার ছাপ স্পষ্ট। বলছিলেন, ‘‘কীই বা বলতে পারি  বলুন! তখন ঘরে কোনও পুরুষমানুষ ছিল না। আমার স্ত্রী, মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে তামান্না, আর ওর মা। মেয়েটা বড় ভালো ছিল। পড়াশুনোতেও ভালো ছিল। এই গ্রামের আমাদের জ্ঞাতিগুষ্টির সব লাল পার্টির সমর্থক। তাই হিসেব করেই হামলা। দেখছেন না আমাদের পাড়ায় রাস্তার কী হাল। সিপিএমের লোকজন থাকে তো, তাই।’’ 
এই পাড়ায় আজও সেভাবে তৃণমূলের জোটে না ভোট। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই এই মোলান্দির ২০০ জন সিপিআই(এম) কর্মীকে ঘরছাড়া করা হয়। ১৭ মাস ধরে পার্টির সংগঠক, কর্মী, গরিব পরিবারের সমর্থক ২০০ জন বাড়ি ফিরতে পারেননি। ভয়াবহ সন্ত্রাস। বোমা, বন্দুক মজুত থাকে এখানে তৃণমূল নেতাদের গোয়ালঘরে। এর আগে খুনও হয়েছিল এই গ্রামে। তারপরেও এই মোলান্দি পঞ্চায়েতে পাঁচটির মধ্যে দু’টিতে সিপিআই(এম) জিতেছে। দু’টি তৃণমূল। একটিতে বিজেপি। সেখানে মূলত হিন্দুদের বাস। আর ঐ বুথেই বাড়ি এই তল্লাটের সবথেকে দাপুটে তৃণমূল নেতা দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। মোলান্দির গ্রামেরই বাসিন্দা বাদশা শেখ স্পষ্টভাষায় বলছিলেন, ‘‘তৃণমূলের ব্লক সভাপতি দেবব্রত মুখার্জির নির্দেশে ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগেই বোমা ছোঁড়া শুরু হয় গ্রামে একের পর এক বাড়ি। ওই তো মাথা।’
সেই দাপুটে ব্লক সভাপতির বাড়িতে গিয়ে যদিও তাকে পাওয়া যায়নি। গ্রামের মানুষজন জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি বুঝে গা ঢাকা দিয়েছে এই নেতা। কালীগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনের প্রচারের সময় এই তৃণমূল নেতাকে প্রকাশ্যে সভা থেকে হুমকি দিতে দেখা যায়, ‘‘যারা তৃণমূলকে ভোট দেবে না, ভোট মিটলে তাদের সাট্‌ করে দেওয়া হবে।’’ কথা রেখেছে তৃণমূল। তামান্নার পরিবার তৃণমূলকে ভোট দেয়নি। পরিণাম, গত সোমবারের সেই ঘটনা।
মোলান্দির মসজিদ মোড়ের সামনেই পেল্লাই পাশাপাশি দু’টি বাড়ি। বাড়ির মালিক আনোয়ার শেখ, তৃণমূলের প্রাক্তন বুথ সভাপতি ও সক্রিয় তৃণমূল নেতা। তামান্না হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে। পরবর্তীতে তল্লাশি চালিয়ে তার বাড়ির গোয়ালঘর থেকেই উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ বোমা। পাশেই আনোয়ারের ভাই তৃণমূল নেতার আদর শেখের বাড়ি। বাড়ির ভিতরেই বিপুল বোমা, বারুদের ভাণ্ডার মিলেছে। গ্রামবাসীরাই জানাচ্ছিলেন, এরকম একাধিক গ্রাম কার্যত বারুদের স্তূপে দাঁড়িয়ে আছে।
তামান্নার বাড়ি ঢোকার গলির মুখেই মহসিন শেখ, ইজারুল শেখ, অলিম শেখদের বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে এখনও দগদগ করছে বোমাবাজির চিহ্ন। দশটা বাড়িতে চলেছিল হামলা। আরও একাধিক বাচ্চার এমন পরিণতি হতে পারতো সেদিন। ইজারুল শেখ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আতঙ্ক যেমন রয়েছে এখনও গ্রামে, তেমনি রয়েছে জমাট বাঁধা ক্ষোভ, তৃণমূলবিরোধী ঘৃণাও।
উঠোনে বাঁশের মাচায় বসে তামান্নার লাগানো সেই ফুলের গাছগুলি দেখছিলেন তখন সন্তানহারা পিতা। হোসেন শেখ বলছিলেন, ‘‘আমি আর কাজে গিয়ে কী করব? কার জন্য এত কষ্ট করে টাকা জোগাড় করব। ওই তো নেই আর। ১৫ বছর আমাদের ঘরে আলো করে এসেছিল তামান্না। আমাদের সব আলো নিভে গেছে।’’ 
এরপর তিনিই হাত ধরে নিয়ে গেলেন ঘরের ভিতর। সবুজ রঙের বিবর্ণ স্যাতস্যাতে দেওয়াল, নিভু নিভু আলো। ঘরের দেওয়ালে সাদা কাগজের ওপর তামান্নার নিজের হাতে আঁকা তিনটে ছবি পরপর করে সাজানো। একদিকে পুলিশ, আরেক ডাক্তারের ছবি, মাঝখানে একজন সবজি বিক্রেতার ছবি। নিজের হাতে এঁকেছে তামান্না। চিকিৎসক হওয়া, পুলিশ হওয়া যেমন একটা পেশা, সবজি বিক্রি করাও তেমনি একটি পেশা, বড় কাজ ছোট কাজ বলে কিছু হয় না। 
‘‘ওইটুকু মেয়ের এই বোধ এখনই ছিল। ওর খুব ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে গ্রামের ভালোর জন্য কাজ করবে। এইসব অপরাধ, মারামারি যেন বন্ধ হয়।’’ কান্নাভেজা গলায় বললেন সন্তানহারা জননী।
মেয়ের স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব এখন মায়ের। শুক্রবার মহম্মদ সেলিমের সামনেই বলছিলেন, ‘‘মোলান্দির মাটি পরিষ্কার করতে হবে।’’ সন্তানহারা জননীর এই ডাক-ই এখন মোলান্দির বার্তা।

 

Comments :0

Login to leave a comment