কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্ত এবার দক্ষিণ কলকাতার বৃত্তে ঢুকল। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রে। কয়লা কেলেঙ্কারিতে টাকা পাচারের রুটেই সামনে এল এবার সেই পটুয়াপাড়ার একাধিক চরিত্রই। এলেন ‘অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা’ থেকে এক ‘মন্ত্রী’ও!
বুধবার বিকাল থেকে বালিগঞ্জের গড়চায় ৫এ, আর্ল স্ট্রিট ঠিকানায় গজরাজ গ্রুপের সংস্থার অফিসে আচমকা হানা দিয়ে তল্লাশি শুরু করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র দিল্লি দপ্তরের আধিকারিকরা, সঙ্গে ছিলেন কলকাতার ইডি’র আধিকারিকরাও। কয়লা পাচারের টাকা বিভিন্ন ভুয়ো, শিখণ্ডী সংস্থা, নির্মাণ সংস্থার মাধ্যমে খাস কলকাতা শহরের বিনিয়োগ হচ্ছে, তদন্তের গতিপথে এই সূত্র ধরেই সেই তল্লাশি অভিযান। ভোররাত চারটে পর্যন্ত চলে তল্লাশি, তাতে উদ্ধার হয় নগদ ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকাও।
এবার সেই তল্লাশি অভিযানের সূত্রে ধরেই যেন খুলে গেছে কেউটের ঝাঁপি!
তাৎপর্যপূর্ণ এদিন দুপুরেই ইডি’র তরফে সরকারিভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। কার্যত তা এক বিস্ফোরক বিবৃতি। এর আগে কোনও বিবৃতিতে এত নির্দিষ্টভাবে প্রভাবশালী মহলের পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
কী বলা হয়েছে বিবৃতিতে? একেবারে শুরুতেই ইডি’র তরফে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে— নির্দিষ্ট সূত্র মারফত ইডি যে তথ্য সংগ্রহ করেছিল তাতে দেখা গেছে এক অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি (‘হাইলি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পলিটিক্যাল পার্সন’) তাঁর ঘনিষ্ঠ মনজিৎ সিং গ্রেওয়াল ওরফে জিট্টি ভাইয়ের মাধ্যমে কয়লা পাচারের টাকা নয়ছয় (লন্ডারিং) করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই জিট্টি ভাইকে ভবানীপুরের লোকজন সক্রিয় তৃণমূল নেতা হিসাবে শুধু চেনেন তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবেও পরিচিত।
সেই সূত্র ধরেই আবার বিবৃতিতে ইডি’র আরও দাবি, এক মন্ত্রীর ‘বেআইনি’ টাকা ‘হ্যান্ডল’ করতেন ঐ গজরাজ গ্রুপের সংস্থার মালিক বিক্রম সাকারিয়া। তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আঁতাত ছিল, জিট্টি ভাইয়ের সঙ্গেও যোগ ছিল।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে কে সেই ‘অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা’ এবং কোন সেই ‘মন্ত্রী’ যার বিপুল পরিমাণ কালো টাকা হ্যান্ডল করল ঐ নির্মাণ সংস্থার মালিক?
৫এ, আর্ল স্ট্রিট ঠিকানায় বুধবার বিকাল থেকে ভোর রাত পর্যন্ত তল্লাশির কারণের সঙ্গেই লুকিয়ে রয়েছে সে রহস্য?
ইডি’র তরফে বৃহস্পতিবার জানানো হয়েছে নির্দিষ্ট সূত্রে খবর পেয়েই ফাঁদ পাতা হয়েছিল। তদন্তকারী আধিকারিকরা সম্প্রতি খবর পেয়েছিল শরৎ বোস রোডে চক্রবেড়িয়ায় সালাসার গেস্ট হাউস নামে একটি অতিথিশালা কিনেছেন মনজিৎ সিং ওরফে জিট্টি ভাই। বুধবারই সেই সম্পত্তির রেজিস্ট্রি হয় আলিপুরে সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে। ঐ গেস্ট হাউসের বাজারমূল্য এখন ১২ কোটি টাকা। ৯ কোটি টাকা নগদ দিয়ে সেই সম্পত্তি কেনা হয়। যদিও খাতায়-কলমে ডিডে সম্পত্তির মূল্য মাত্র ৩ কোটি টাকা দেখানো হয়। আর সেই নগদ টাকা লেনদেনের খবর মিলতেই ইডি হানা দিয়েছিল ৫এ, আর্ল স্ট্রিট ঠিকানায় গজরাজ নির্মাণ গ্রুপ সংস্থার অফিসে। সেখানেই হানা দিয়ে নগদ ১কোটি ৪০ লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়। ইডি’র দাবি কয়লা পাচারের টাকাই খেটেছে এখানে নগদে।
অর্থাৎ কয়লা পাচারের টাকা সরাসরি এখন খাটছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রে। কয়লা পাচারের অবৈধ টাকা চলে এসেছে এক অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার মাধ্যমে মনজিৎ সিংয়ের কাছে। যিনি মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ পরিচিত এবং একইসঙ্গে তৃণমূলের হিন্দি সেলের পদাধিকারি। অভিষেক ব্যানার্জির নির্দেশেই পদও পেয়েছেন।
কয়লা পাচারের টাকা যা আসলে ঐ ‘অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা’র তা মনজিৎ সিংয়ের মাধ্যমে অতিথিশালায় বিনিয়োগ হয়ে বেবাক সাদা টাকা খাটতে চলেছিল এবং তা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি লাগোয়া, তাঁরই ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে।
এখানেই শেষ নয়। এরপরেই সামনে এসেছে আরও বিস্ফোরক তথ্য। ঐ সালাসার গেস্ট হাউস কেনার পরে নগদ টাকার লেনদেন হচ্ছিল বালিগঞ্জের ঠিকানায় ঐ গজরাজ নির্মাণ সংস্থার অফিসে। ইডি ওখানেই তল্লাশি চালিয়ে নগদ টাকা উদ্ধার করে। ঐ সংস্থার কর্ণধার বিক্রম সাকারিয়ার সঙ্গেই আবার রাজ্যের এক ‘মন্ত্রী’র কালো টাকা লেনদেনের অবৈধ আঁতাত রয়েছে। মন্ত্রী মশাইয়ের টাকা হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্বে এই ব্যক্তি। শুধু দক্ষিণ কলকাতার ঐ মন্ত্রী নয়, ওই মন্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আর্থিক সম্পর্ক বিক্রম সাকারিয়ার।
কে এই বিক্রম সাকারিয়া? তাঁরা দুই ভাই। বিক্রম ওরফে ভিকি ও ববি সাকারিয়া। এই বিক্রম সাকারিয়া ১৯৯৬ সালে বিদেশি মুদ্রা লেনদেন সংক্রান্ত দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়েছিল। তাঁর আইনি বিচারও হয়েছিল। হাওলা কারবারে অভিযুক্ত দীর্ঘদিন ধরে। বালিগঞ্জের ঐ ঠিকানাতেই আবার তৃণমূলপন্থী আইনজীবী তমাল মুখার্জির অফিস। দক্ষিণ কলকাতার দাপুটে মন্ত্রী ও তাঁর ভাই যার সঙ্গে টলিউডের যোগ আছে— তাঁদের সঙ্গেই আঁতাত এই বিক্রম সাকারিয়ার, দাবি ইডির। মূলত মন্ত্রীর কালো টাকা সামলানোর দায়িত্ব পালন করে। মনজিৎ সিং ওরফে জিট্টি ভাইয়ের সঙ্গেও যোগ বিক্রম সাকারিয়ার। কয়লাকাণ্ডে ঐ অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক টাকারও জিট্টির মাধ্যমে পার্কিং করত বিক্রম সাকারিয়া।
এই বিক্রম সাকারিয়া মোট ২৮টি সংস্থার ডিরেক্টর যার অধিকাংশ গজিয়ে উঠেছিল মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই।
তার মধ্যে শুধু মাত্র বালিগঞ্জে ৫এ, আর্লে স্ট্রিটের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ঠিকানাতেই রয়েছে ২৭টি সংস্থা। গজরাজ আবাসন, গজরাজ টাওয়ার, গজরাজ প্রোমোটার, গজরাজ ভাটিকা, গজরাজ গৃহ, গজরাজ ভিলা, গজরাজ নিবাস, গজরাজ হাইটস, গজরাজ প্রপার্টিজ প্রাইভেট লিমিটেডের মত ২৭টি সংস্থা একটি মাত্র ঠিকানাতেই।
সারদাকাণ্ডে যেমন মিলেছিল বেহালায় একটি ঠিকানায় সারদার ৪২টি সংস্থার অফিস যার ট্রেড লাইসেন্সের অনুমোদন দিয়েছিল তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা কর্পোরেশন!
এবার কয়লা পাচারের তদন্তে সামনে এল একই ঠিকানায় ২৭টি সংস্থা। সবকটিই প্রায় রিয়েল এস্টেট সংস্থা। প্রায় সবকটির বোর্ড অব ডিরেক্টর্সে রয়েছেন বিক্রম সাকারিয়া, তাঁর স্ত্রী সুচি সাকারিয়া ও পুত্র সিদ্ধার্থ সাকারিয়া। এর মধ্যে একাধিক সংস্থা আবার কোভিডের সময় তৈরি হয়। সুচি সাকারিয়া একসঙ্গে ২৩টি কোম্পানির ডিরেক্টর, ছেলে সিদ্ধার্থ সাকারিয়া ৮টি কোম্পানির ডিরেক্টর!
আসলে এগুলোই হলো সেল কোম্পানি বা শিখণ্ডী সংস্থা। কয়লা পাচারের টাকা, লালার টাকা খেটেছে এমন সব শিখণ্ডী সংস্থাতেই। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ভাগের টাকা এমন সব রিয়েল এস্টেস কোম্পানিতে ঢুকেই বেমালুম সাদা হয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, কয়লা পাচারের মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তেই শাসক তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ অতি প্রভাবশালী নেতা অভিষেক ব্যানার্জি কলকাতা ও দিল্লির ইডি দপ্তরে ইতিমধ্যে চার দফায় ম্যারাথন জেরার মুখে পড়েছেন।
Comments :0