শমীক লাহিড়ী
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছেন। গুপি-বাঘা সিনেমার হাল্লার রাজার মতো যুদ্ধ যুদ্ধ করে শুধু লাফালফি নয়, যুদ্ধের সময় দিনক্ষণ সব ঘোষণা করেই যুদ্ধের ঢ্যাঁড়া পেটাচ্ছেন তিনি। তবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এই যুদ্ধ নয়। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ হবে কিনা সেটা বুঝতে আরও খানিকটা অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত এই যুদ্ধের নাম শুল্ক যুদ্ধ (Tariff War) বা বাণিজ্য যুদ্ধ।
মূলত ভারত, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধ শুরু করেছেন ট্রাম্প। তার অভিযোগ, এই সব দেশ নিজেদের দেশে মার্কিন পণ্যের ওপর প্রচুর শুল্ক চাপায়, তাই এইসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করতে পালটা চড়া হারে শুল্ক চাপাবে মার্কিন সরকার। এই যুদ্ধের প্রভাব শুধু বিশ্ব অর্থনীতি, বাণিজ্যের মধ্যেই সীমিত থাকবে না, এর সুদূর প্রসারী প্রভাব ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেবে। এর খানিকটা পরিচয় এইসব দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেছে।
ইউরোপের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকিতে আটলান্টিকের দু’পাড়েই বাণিজ্য উত্তেজনা প্রবল। ইইউ এই পদক্ষেপকে ‘অন্যায়’ আখ্যা দিয়ে 'কঠোর ও তাৎক্ষণিক' প্রতিক্রিয়ার পালটা হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা ইউরোপীয় গাড়ি ও অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ট্রাম্পের অভিযোগ, ইইউ আমেরিকান গাড়ি ও কৃষিপণ্যের প্রবেশে বাধা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক সুবিধা পেয়েছে। এদিকে ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র ওলোফ গিল সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলেছেন, ইউরোপে বিনিয়োগ করে আমেরিকান ব্যবসায়ীরা উল্লেখযোগ্য মুনাফা অর্জন করছে। ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির প্রতিক্রিয়ায়, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রবার্টা মেটসোলা খোদ ওয়াশিংটন দাঁড়িয়েই বলেছেন, ইইউ 'মুক্ত ও ন্যায্য বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যে কোনও পফক্ষেপের বিরোধিতা করবে’।
ফ্রান্স ও স্পেন ইইউ’র এই অবস্থানকে সমর্থন করেছে এবং ইউরোপের স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে। ফরাসি অর্থমন্ত্রী এরিক লম্বার্ড বলেছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আমাদের স্বার্থ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের মতোই পদক্ষেপ নিতে হবে।’ স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের বক্তব্য, ইইউ ‘প্রস্তুত’ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় ‘অনুপাতিক ব্যবস্থা’ গ্রহণ করবে। মানে আপাতত রণংদেহী মেজাজেই আছেন ইইউ ভুক্ত রাষ্ট্রপ্রধানরা। তবে এই দম কতদূর থাকবে এখনই তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
ইতালিতে অতি দক্ষিণপন্থী মেলোনির সরকারের শিল্প মন্ত্রী অ্যাডলফো উরসো বাণিজ্য উত্তেজনা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাণিজ্য যুদ্ধ এড়ানোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন। তবে, ইতালির শিল্পগোষ্ঠীগুলো সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়েই চলেছে আরও অনেক বেশি কঠিন প্রতিক্রিয়ার জন্য। ইমানুয়েল অর্সিনি, ইতালীয় শিল্পপতিদের সংগঠন ‘কনফিন্ডাস্ট্রিয়া’র সভাপতির কঠোর প্রতিক্রিয়া, ‘আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য আমাদের মহাদেশে শিল্পহীনতা’।
এদিকে বিদায়বেলায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই পদক্ষেপকে 'খুবই বোকামি' বলে উল্লেখ করে কানাডার অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য ‘নিরলস লড়াই’ চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রুডো পালটা ব্যবস্থা হিসাবে মার্কিন পণ্যের ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন, যা কার্যকর করা শুরুও হয়েছিল। আবার ট্রুডোকে 'গভর্নর' অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রদেশের প্রধান বলে কটাক্ষও করেছেন ট্রাম্প। অবশ্য ট্রাম্প এই ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ এক মাসের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা করেছেন, ফলে কানাডাও প্রতিশোধমূলক শুল্কও চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মার্ক কার্নি একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন কানাডা ভেঙে পড়বে। কিন্তু আমরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়াব, পিছু হটব না। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা পালটা ব্যবস্থা নেব।’
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের নীতির উল্টোপথেই হাঁটছেন ট্রাম্প, এটা প্রতীয়মান। এনিয়ে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি’র সাথে বিসদৃশ্য কথা কাটাকাটির ভিডিও দুনিয়াজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে এনিয়ে বিরোধও শুরু হয়েছে। আবার রাষ্ট্রপতি হয়েই ট্রাম্প একাধিকবার চরম আগ্রাসী বক্তৃতায় বলেছেন, কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম প্রদেশ করা হবে, গ্রিনল্যান্ডের দখল নেওয়া হবে ইত্যাদি।
শক্তির পুনর্বিন্যাস
এদিকে ট্রাম্পের নাকের ডগায় বসে ওয়াশিংটনস্থিত চীনের দূতাবাস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে বলা হয়েছে, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধই চায়, এটা হতে পারে শুল্কযুদ্ধ, বাণিজ্যযুদ্ধ অথবা যেকোনও ধরনের যুদ্ধ, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে প্রস্তুত আছি।’ বার্ষিক ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে অংশ নিতে চীনের নেতারা এখন বেইজিঙেই রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৩৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার ফলে এমনিতেই বেকায়দায় আছে মার্কিনীরা। ইতিমধ্যেই আবার ব্রিকসের সাম্প্রতিক সম্মেলনে ভারত, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে আরও ২২/২৫ টা দেশ যোগ দিয়েছে সাধারণ মুদ্রা তৈরি করে পারস্পরিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে চলার ভাবনা নিয়ে। নতুন চেহারা নিচ্ছে ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে দুনিয়ার চেহারায় কি ধরনের পরিবর্তন আসবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। দুনিয়া জুড়ে যে চারটি প্রধান দ্বন্দ্ব রয়েছে, তার মধ্যে ‘সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’ এই কথা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে বলে অনেকেই ধারণা পোষণ করেন। ট্রাম্প আসার পর বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে স্তিমিত আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের ঢাকনা খুলছে, তবে কতটা খোলে আর কতটা অগ্ন্যুৎপাত হয়, সেটা দেখার বিষয়। এখন অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে, যার ফলে কয়েকদশক ধরে চলে আসা অনেক ভাবনা ওলটপালট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। আগামীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক-মোড় পরিবর্তনের সাক্ষী হতে চলছে বিশ্ববাসী।
লগ্নিপুঁজির নয়া কৌশল
বিগত সাড়ে তিন দশকে লগ্নিপুঁজি নয়া উদারবাদের রাস্তায় খোলামেলা ইচ্ছেমতো চলতে পেরেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণে। প্রায় প্রতিরোধহীন বিশ্বে উন্মত্ত লাগামহীন ঘোড়ার মতো অবাধ লুটের মাধ্যমে লগ্নিপুঁজি এখন শুধু ফাটকা পুঁজিতেই (Speculative Capital) আটকে নেই, লুটেরা পুঁজিতে (Crony Capitalism) পরিণত হয়েছে। ১০০ বছর আগে লগ্নিপুঁজি যে চেহারা নিয়ে যে কৌশলে চলত, এখন তা চলে না।
১৯৩০ -এর দশকে তৎকালীন কর্পোরেট সংস্থাগুলির কার্যকলাপ যেহেতু ছিল দেশ ভিত্তিক, আজকের মতো আন্তর্জাতিক নয়, তাই কর্পোরেটগুলির স্বার্থ রক্ষার্থে সেই দেশের শাসকরা বাজার দখলের উদ্দেশ্যে সর্বগ্রাসী যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য ছিল। ১৯৩০-এর ফ্যাসিবাদ যুদ্ধ করে একদিকে যেমন পৃথিবীর বহু দেশকে ধ্বংস করেছিল, তেমনই নিজেরাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানের নয়া ফ্যাসিবাদের পৃথিবীব্যাপী সামগ্রিক যুদ্ধের রাস্তায় চলার সেই প্রয়োজন আজ নেই। তাই কর্পোরেটের স্বার্থ রক্ষার কায়দা ও চেহারাটাও অনেক পালটে নিয়েছে। আজকের লগ্নিপুঁজি গভীর সঙ্কটে থাকলেও তার থেকে মুক্তির রাস্তা খোঁজার জন্য পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ বাঁধাবেই, এমন মনে করবার কারণ নেই, বরং অন্য কৌশল অবলম্বন করে চলছে।
ভারতবর্ষের ফ্যাসিবাদী মনোভাবের শাসকদল বিজেপি কখনও পাকিস্তান কখনও চীনের সাথে যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করলেও যুদ্ধের রাস্তায় হাঁটছে না। যেহেতু আজকের ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রভিত্তিক যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে না, তাই এর স্থায়িত্ব অতীতের অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে বলে আবার অনেকে অনুমান করছেন।
ডোনাল্ডের ট্রাম্পের ব্যবসার হাতেখড়ি জমিজমা, বাড়ি ইত্যাদি স্থাবর সম্পত্তি কেনাবেচায় অর্থাৎ ফাটকা পুঁজির ব্যবসায়। আবার বাবার রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়েই তার ব্যবসার সম্প্রসারণ। ফলে ফাটকা পুঁজি ও লুটেরা পুঁজির স্বার্থে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি দেশ-দুনিয়া শাসন করার চেষ্টা করবেন, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে!
তবে ইচ্ছে থাকলেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে পারবেন না। এক অদ্ভুত বিচিত্র ধন্দে এখন আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি। বিশ্বজুড়ে লগ্নিপুঁজির কারবার, আর এদিকে ট্রাম্প শুল্কের প্রাচীর তুলে তাকে একটা দেশ বা মহাদেশ বা উপমহাদেশের মধ্যে আটকে রাখতে চাইছেন। অবশ্য এই শুল্ক যুদ্ধ কতটা বাজার দখলে রাখার দর কষাকষির নার্ভের লড়াই, আর কতটা মার্কিন সুবৃহৎ ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর পৃথিবী জুড়ে নিজেদের চুড়ান্ত আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া চেষ্টা, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে মার্কিন এই আধিপত্য বাকি দুনিয়ার লগ্নিপুঁজি পরিচালিত দেশগুলো কি অত সহজে মেনে নিতে পারে?
আজকের লগ্নিপুঁজি যুদ্ধবিমান-সাবমেরিন-অ্যা টম বোম-হাইড্রোজেন বোম নিয়ে মারপিট করে মানব সভ্যতার সাথে নিজেদেরও ধ্বংস করে ফেলবে, এটা মনে করাটাও চুড়ান্ত বোকামি, বরং নতুন কায়দায় আরও বেশি মানুষকে আরও বেশি শোষণের জাঁতাকলে কীভাবে পেষা যায়, সেই পরিকল্পনাতেই ব্যস্ত। সম্পদের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন এবং সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ক্রমহ্রাসমান প্রকৃত আয়, বাজারের চাহিদাকে কমিয়েছে। যার অবশ্যম্ভাবি ফল হিসাবে অর্থনৈতিক সংকট গভীরতর হয়েছে। এর ফলে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হয়েই চলেছে বিশ্বজুড়েই। বাজার ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। লগ্নিপুঁজি তাই এখন নিজেদের ক্রমবর্ধমান মুনাফার হার বজায় রাখার জন্য সরকার এবং রাষ্ট্রকে দখল নিতে চায়। তাই তাদের কাছে অতি দক্ষিণপন্থীদের সরকারে এবং ক্রমান্বয়ে এই শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
নেপথ্যে লুটেরা পুঁজি
বিশ্বজুড়ে ২০০৭-০৮ সালের মন্দার পরেই লুটেরা লগ্নিপুঁজি উঠেপড়ে লাগে সেই রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সামনের সারিতে আনতে, যারা তাদের অবাধ লুটকে বাধাহীনভাবে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করতে পারে। সেই কারণেই ট্রাম্প আবার ৪৭ তম রাষ্ট্রপতি এলন মাস্কদের দাক্ষিণ্যে। এরাই ইতালির জর্জিয়া মেলোনি, ব্রাজিলের বোলসেনারো, আর্জেন্টিনার জাভিয়ের মিলেই-দের রাষ্ট্ররধান বানিয়েছে। আমাদের দেশের নরেন্দ্র মোদীকে সরকারে এনেছে আদানি-আম্বানি মতো লুটেরা পুঁজির মালিকরাই। জার্মানিতে ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ (এএফডি) দল, ফ্রান্সে ল্যি পেনের দল ‘ন্যাশনাল র্যারলি’, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, ক্রোয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে এইসব অতি দক্ষিণপন্থী দলগুলি সংসদে নিজেদের শক্তি প্রচুর বাড়িয়েছে, কোথাও সরকারকে নিয়ন্ত্রণে আনার অবস্থাতেও চলে এসেছে।
আজকের বিবর্তিত লগ্নিপুঁজি এখন গায়ের জোরে তাদের পেটোয়াদের সরকারে বসায় না। সংসদ ভেঙে দেয় না, যা ১৯৩০- এর দশকে হিটলার বা মুসোলিনি করেছিল। বরং আমরা দেখেছি ট্রাম্প বা বোলসেনারোকে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী সর্বশেষ নির্বাচনে কোনোক্রমে সরকার রক্ষা করতে পেরেছেন। এটা ১৯২০-৩০ দশকের ফ্যাসিস্ত শাসকদের সময়ে ভাবাও যায়নি।
তফাৎ শুধু কৌশলে
ফ্যাসিবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদ উভয়ই একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা নিয়ে চলে, তবে নয়া-ফ্যাসিবাদ আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করে। এরা খোলাখুলি স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দেয় না, বরং গণতন্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস না করে, সেগুলিকে পঙ্গু বা দুর্বল করে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
সেসময়ে ফ্যাসিস্তরা মূলত রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করত অথবা সরাসরি হুমকির প্রচার করত। নয়া ফ্যাসিবাদ সামাজিক গণমাধ্যম ও অন্যান্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে ভুয়া সংবাদ, ষড়যন্ত্রের ভুয়ো তত্ত্ব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে মানুষের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মাণ করে। খোলাখুলি বর্ণবাদ ও ইহুদি বিরোধিতার (অ্যান্টি-সেমিটিজম) মতো রাস্তায় না হেঁটে, সূক্ষ্মভাবে জাতিগত ও অভিবাসীবিরোধী প্রচার, ইসলামোফোবিয়া তৈরি করে নয়া ফ্যাসিবাদ মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলে, বিদ্বেষ বিভাজন তৈরি করে। অভিবাসন বিরোধী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বিদেশিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায় এবং ‘সাংস্কৃতিক পরিচয়’বা ধর্ম রক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ নির্মাণ করে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদের মৌলিক ধারণা নিয়েই আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন চেহারায় গণতন্ত্রের মুখোশ পড়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করে নয়া ফ্যাসিবাদীরা চলতে চাইছে।
আমাদের দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়ে গেছে, একথা ভাবা রাজনৈতিকভাবে চরম ভুল। দেশে ফ্যাসিস্ত মতাদর্শের ভিত্তিতে চলা আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি এখানে সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করেই সরকার চালাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী রাস্তায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাচ্ছে। অনেক বিষয়ে সাফল্য পেলেও ফাসিবাদ কায়েম করতে সক্ষম হয়নি এখনও পর্যন্ত। কিন্তু এদের কার্যকলাপ ও নীতিগুলো ফ্যাসিবাদের নতুন চেহারায় উপস্থিতির লক্ষণ।
নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ
এত কথার প্রয়োজন হলো কারণ দু’ধরনের ভুল প্রবণতায় আমরা আক্রান্ত হতে পারি। আপাতভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশ থেকে তুলে না দেওয়ায়, বিজেপি সরকারকে শুধু সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট কিন্তু কমবেশি গণতান্ত্রিক দল মনে হতে পারে। আবার দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়ে গেছে, এটা মনে করলে, ফ্যাসিবাদকেই আসলে অনেক লঘু করে দেখা হবে। ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে গেলে সম্পূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ওদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে– বিচার ব্যবস্থা, সংসদীয় ব্যবস্থা, পুলিশ, মিলিটারি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহ, সমস্ত সংবাদ মাধ্যম ইত্যাদি রাষ্ট্রের সব অঙ্গকেই। নিষিদ্ধ হবে প্রকাশ্য সভা, সমিতি, প্রতিবাদ, বিরুদ্ধ মত, বিরোধী দল। এগুলো প্রয়োগের রাস্তায় চলছে বিজেপি কিন্তু এখনও সাফল্য পায়নি সর্বক্ষেত্রে। প্রতিবাদ প্রতিরোধ বহাল আছে। যদি আমরা ভেবে বসে থাকি, বিজেপি যা করছে তাতে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে ফেলেছে, তাহলে ফ্যাসিবাদের ক্রুরতা, ভয়াবহতা, তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল চেহারাটাকে ছোট করে দেখা হবে। ডিমিট্রভের কথায়, ‘লগ্নিপুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সবচেয়ে আগ্রাসী অংশের উন্মত্ত একনায়কত্ব।’ফলে আমাদের দেশের পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখার ফাঁদে পা দেওয়ার ভুল করা যাবে না। সদ্য প্রয়াত কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিতেন – ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ’ করে লড়াইয়ের রণকৌশল ঠিক করতে হবে।
ফ্যাসিবাদকে কায়েম করার লক্ষ্যে যে সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষ ছড়াচ্ছে ফ্যাসিবাদী আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার, তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াইকে তীব্রতর করা মূল কাজ। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদ এরিক হবসবমের আহ্বান ছিল, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেবলমাত্র সামরিক যুদ্ধই যথেষ্ট নয়, এটি একটি আদর্শগত ও সামাজিক লড়াইও বটে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, শ্রমিক সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত প্রতিরোধই একমাত্র ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করতে পারে।’
রাজ্যে ও সারা দেশে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলাই আমাদের করতে হচ্ছে, সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেই, লড়াইয়ের ময়দানে অনেক অনেক মানুষকে জড়ো করে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে, লুটেরা লগ্নিপুঁজি নিয়ন্ত্রিত শুধু নয়, আরএসএস নিয়ন্ত্রিত কোনও শক্তিকে যেন এই নয়া ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের পরম মিত্র বলে কেউ ভুল না করে।
Comments :0