গৌতম দেব 
 
বুথ কমিটিগুলি নির্বাচনী সংগঠনের প্রাণভোমরা। সারা বছর ধরে এই কমিটিগুলিকে সমানভাবে সক্রিয় রাখার ইচ্ছা থাকলেও নানা কারণে সর্বত্র সমানভাবে রাখা যায় না। সেটা হয়ে ওঠে না। এছাড়া বুথ কমিটির সভাগুলি কার্যকর এবং প্রাণবন্ত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পার্টির যাবতীয় আহ্বান বুথ এলাকায় মানুষের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত করার দায়িত্ব বুথ কমিটির। আর একাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য কমিটিগতভাবে দায়িত্ব নির্দিষ্ট থাকে। সমস্ত এলাকায় এই কাজ ঠাসবুননি সংগঠনের মতো গড়ে তুলতে হবে। সমস্ত প্রকার গণসংগঠনে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের পূর্বে আলোচনায় এবং কাজে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  
মাও জে দঙের নেতৃত্বে  লঙ মার্চ বাহিনী আর আমাদের ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর বাহিনী এক নয়। তত্ত্বগতভাবে এটা যেমন ঠিক তেমনি রূঢ় বাস্তবতার নিরিখেও এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষই সর্বেসর্বা এই বিষয়টি আমাদের নীতিগত অবস্থানের মূল চাবিকাঠি এটা ভেবেও বলা যায় লঙ মার্চের নেতারা যেমন গ্রামের পর গ্রাম দখল করতে করতে এগিয়েছেন এবং শাসনভার নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছেন তেমনই লঙ মার্চের বাহিনীর শাসনের বৈশিষ্ট্য, মূলগত বিষয়সমূহ, প্রবহমান ব্যবস্থা থেকে অনেকটাই মৌলিকভাবে ভিন্নতর এবং জনস্বার্থে নিবেদিত, তা দেখার পর চালু রাজত্বের জিম্মাদাররা দেখেছেন কীভাবে লঙ মার্চের বাহিনীর দিকেই জনসমর্থন বিপুল পরিমাণে প্রকাশ পাচ্ছে– কী সে ম্যাজিক যার দ্বারা শ্রেণি শত্রুর পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সমর্থন সেভাবে লঙ মার্চের কমরেডরা নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে নিলেন। সোজা কথা মানুষের সমর্থন, ভোট আমাদের বাড়াতে হবে। দক্ষিণপন্থী দলগুলির ভোট কমাতে হবে। ইতিমধ্যে তারা বিগত ভোটগুলিতে যথেষ্ট ভোট এবং মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। অবশ্য পরবর্তীতে জনবিরোধী সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মের জন্য ভোটের হিসাব না পেলেও এটা কারো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা যে তাদের ভোট কমের দিকে যাচ্ছে এবং সেই পতনটা দ্রুত হচ্ছে। 
                        
                        
সাম্প্রদায়িক বিজেপি এখন দেশের সামনে জ্বলন্ত বিপদ। দেশ বিশেষে ভারতের বাস্তবতা আমাদের মাথায় রেখে চলতে হয়। ভারতে আছে বিপুল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ সহ আরও অন্যান্য ধর্মমতের মানুষজন। আর বিজেপি যা করছে আর গত দশ-এগারো বছরে যা করেছে তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি ভীত সন্ত্রস্ত হয় তাহলে কি দোষের হবে? বিজেপি যে আদর্শ সামনে রেখে চলছে তা হিন্দুত্বের ভাবাবেগ উসকে দিয়ে সংবিধানের মূল ভিত্তি বদলে দেওয়া। তৃণমূল সে তুলনায় গতকালের পার্টি, আগামীকাল উঠে যাবে। বিজেপি-তৃণমূলের ভোট কমানো, পরিকল্পনামাফিক  জেদ নিয়ে লড়লে সম্ভব। 
বুথ কমিটি গঠনের সময় সতর্ক থাকতে হবে যে পার্টির কয়েকজন নেতাকে নিয়ে শুধুমাত্র কমিটি না তৈরি হয়। এমন হতে পারে যে সেখানে এক মুদির দোকান আছে এবং দোকানদার ভদ্রলোক বেছে বেছে বাইরে থেকে জিনিসপত্র কিনে আনেন এবং সঠিক দামে বিক্রি করেন। শহরের মতো না হলেও কয়েকজন ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক মহাশয় বসবাস করেন। কমবয়সি ছেলেমেয়েরা পছন্দ করেন একজন খেলাধুলার ব্যাপারে তৎপর যুবককে, কিন্তু তার রাজনীতিতে টান নেই। হয়তো বা তখন যা চলছে দেখে বা জেনেশুনেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে ঠেলে নিয়ে গেছেন নিজেকে। অথচ তাঁকে পছন্দ করে গ্রামের বেশির ভাগ যুবক-যুবতী। এই মনোভাবের সম্প্রসার ঘটবে ক্লাবগুলিকে যুক্ত করার প্রশ্নে।
                        
                         
পাড়া বৈঠক এবং স্কোয়াডিং-এর উপর জোর দিতে হবে। পাড়া বৈঠকের ব্যাপারটিতে বিশেষ নজর দিতে হবে। চিঠি ছাপিয়ে আমন্ত্রণ করতে হবে। সব জায়গায় না হলেও কিছু কিছু জায়গায় মাইকের বন্দোবস্ত করতে হবে। আমাদের প্রধান বিরোধী পক্ষ তৃণমূল এবং  বিজেপি’র বিরুদ্ধে আমাদের প্রচার তীব্র তীক্ষ্ণ করতে হবে। কিন্তু আমরা সচেতন এবং সতর্ক থাকবো কমিউনিস্ট পার্টির মঞ্চ থেকে যা বলা যায় না অথবা নির্বাচনবিধি যার মান্যতা দেয় না সেই রকম বক্তব্য হাততালি কুড়োনোর জন্য যেন না বলা হয়।
বামফ্রন্ট সরকার যেন এখনো রাজ্য চালাচ্ছে এই মনোভাব থেকে বিরোধীপক্ষ থেকে অনবরত আমাদের পার্টির নামে খিস্তি খেউর করে যাচ্ছে এবং যাবে। বামফ্রন্ট যে কী কী কারণে চৌত্রিশ বছর সরকারে থাকলো সে প্রসঙ্গে ওরা আলোচনায় কিছু উল্লেখ করছে না। সে কারণে বুথকর্মীদের দায়িত্ব আরও বিরাট। এ প্রসঙ্গে আমাদের মূল্যায়ন যুক্তিনিষ্ঠভাবে এবং প্রয়োজনে আত্ম-সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করা। আমাদের বেশি বেশি করে বিজেপি সরকারের এবং মমতা সরকারের ব্যর্থতা এবং অপদার্থতার বিরুদ্ধে লড়াইকে তথ্য দিয়ে বোঝাতে হবে। একটা গোছানো মিটিং সফল হলো কি ব্যর্থ হলো তা শুধুমাত্র আমাদের সমর্থকরা কতবার হাততালি দিল তার উপরে নির্ভর করে না। বরং বিরোধীদলের সমর্থকরা যারা মিটিংয়ের চাটাইতে না বসলেও আশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে এবং বক্তার বক্তব্য শুনতেই তারা আসে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের মধ্যে একটা মিটিংয়ে আমরা বিজেপি এবং তৃণমূল সরকারের মিথ্যার বেসাতি, স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি, বেকারদের চাকরি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ধীরস্থিরভাবে অথচ দৃঢ় চিত্তে যে কথাগুলি বলি সেগুলি তাদের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দেয় কি না!
                        
                        
আগে আমরা নির্বাচনে কে প্রার্থী হবে না হবে সে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতাম না। বরং জমি বর্গার লড়াইতে বা কাজের বদলে খাদ্য, খেতমজুরদের মজুরি প্রভৃতি সেই সময়ে বহমান সংগ্রামগুলির প্রেক্ষাপটে জনগণের হাতে নতুন পঞ্চায়েত তুলে দেবার প্রয়াস নিতাম। এইসব কাজগুলি শুধু রাজ্যে না, সারা দেশে গরিব মানুষদের মধ্যে আমাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল। পরবর্তীকালে আমরা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিখলাম, ভোটে সিপিআই(এম) নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার, কিন্তু প্রার্থীও তাৎপর্যহীন নয়। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা তো মমতা ও তাঁর ভাইপোর মতো তাঁবু নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারব না- আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে সকলকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর পর কী হবে তা অনুমান করে গ্রাম বাংলা ভীত সন্ত্রস্ত। ভানুবাবু না থাকলেও যে বাবু বিবিদের তিনি রেখে গেছেন তারা আর একটু সাবধানতা অবলম্বন করে, প্রয়োজনীয় বোমা ও অন্যান্য রসদ যা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে দরকার হয়, তাই এবারের পঞ্চায়েতের ভোটের জন্য জোগাড় করে রাখছেন– এ ক’দিনের মধ্যে। 
প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা সহজতর পদ্ধতি আমরা বিবেচনা করতে পারি। খোলা মনে সেটা করতে হবে। অভিষেকের অভিযানের শেষে ব্যালট বাক্স সাজিয়ে লরি করে সবাইকে দেখিয়ে ওদের গোনার কেন্দ্রে যাওয়ার নাট্যাভিনয় আমরা দেখছি। বুথ কমিটিকে খেয়াল রাখতে হবে তাদের এলাকার জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক বিন্যাস। রাজনীতির দিক থেকে যেমন আমাদের দিকে বেশ কিছু মানুষ আছেন তেমন আমাদের প্রধান বিরোধী পক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি প্রভৃতির সাথেও মানুষ আছেন বেশ খানিকটা। এছাড়া কিছু মানুষ নানা কারণে নির্বাচন যত কাছে আসে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হয়। সাধারণত এরা সংখ্যায় কমই হয়। শ্রমিক,কৃষক, মধ্যবিত্ত ,কর্মচারী তো আছেই। এরা সব পরিচিত পেশায় আছেন। কিন্তু যারা আমাদের পরিচিত পেশায় নেই যেমন ভ্যান রিকশাচালক, ইটভাটা শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, তাঁত শ্রমিক, গৃহ পরিচারিকা, মৎস্যজীবী প্রভৃতি পেশার মানুষদের মধ্যে কাজ করতে হয় কমিউনিস্টদের। যানবাহন শ্রমিকদের খেয়াল রাখতে হয় যে সব যুবক-যুবতীরা এখন ডেলিভারি বয়ের কাজ করছে, র্যা পিডের সাথে যুক্ত তাদের সুবিধা অসুবিধা ও সমস্যাগুলি বিশেষ করে বুথ কমিটিকে অত্যন্ত সাহসের সাথে বলতে হবে। জ্যোতি বসু যেটা বলতেন ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো অন্যায়’ সেই কথা মনে রেখে আমাদের দল থেকে সরে যাওয়া মানুষদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতেই হবে। 
                        
                        
সব সময় কমিউনিস্টদের উপর দায়িত্ব বর্তায় সাধারণ মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি তা সমস্বত্বরূপী জনসমষ্টি নয়,ধর্ম, জাতপাত, আঞ্চলিকতা, গণতন্ত্র ,স্বৈরতন্ত্র প্রভৃতি নানা বিষয়ে মানুষের মধ্যে মতাদর্শগত  ভিন্নতা বিবেচনা করে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে কর্মসূচি নিতে হয়। এছাড়াও চালু সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতির নিদারুণ প্রভাব তো আছেই। সমষ্টি এখানে পরিত্যাজ্য, ব্যক্তিকে সুমহান করে দেখানো হয়। 
মোদীর রাজত্বে দেশজুড়ে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে তার উত্তর দিতে পারবে না বিজেপি। গণতন্ত্রের প্রশ্নে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির কাজকর্ম চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী। এই কঠিন বাস্তবতা মানুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, শুধুমাত্র বামপন্থীদের বক্তৃতার মাধ্যমে না, যাতে বুঝতে সক্ষম হন এটা সুনিশ্চিত করতে হবে। বেকারদের গুন্ডা বানাচ্ছে তৃণমূল সরকার। কাজ নেই কম্ম নেই, লেখাপড়া অসম্পূর্ণ, ফলত লুম্পেন বাহিনী রাজ্যে তৈরি হয়েছে। প্রধানত ঝটিকা বাহিনী হিসাবে তারা কাজ করছে। এবারে পঞ্চায়েত নির্বাচন লোকসভা নির্বাচন এই দুটো খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে হওয়ায়– ছোট গ্রামের পঞ্চায়েত কার হাতে থাকবে তার সাথে ভারত চালাবে কে এই সব বিষয়ের মীমাংসা সামনে আসবে। 
এজন্য সমস্ত বিষয়টা রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করতে হবে- বিজেপি এবং তৃণমূলকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। আমাদের পোলিং এজেন্ট কে হবেন- সেটা এখন থেকেই ঠিক করতে হবে এবং পোলিং এজেন্টদের বুথে ভোটারদের অবস্থান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নির্বাচনের অনেক আগেই করে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে জোর দিতে হবে একক নয়, যৌথ সিদ্ধান্তের উপর।
সংখ্যালঘু  মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা পশ্চিমবাংলায় গ্রাম-শহরে যথেষ্ট আছে। আজ বিজেপি সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বিভ্রান্ত করে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অবিশ্বাস আর সন্দেহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে তা আরও দ্রুতলয়ে চলবে। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের মধ্যে নানা উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণপন্থীরা এদের নিয়ে সুবিধাবাদী অবস্থান নিচ্ছে। 
রাজ্যের শান্তি কীভাবে কতদিনের জন্য বিঘ্নিত হবে তা কয়েকটা দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতারা ঠিক করতে পারবেন? তাই এবারের নির্বাচন সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বঙ্গ রাজনীতি তথা আগামী দিনে দেশ বদলের রাজনীতিতে।
                        
                                               
দেশ আজ কঠিন সন্ধিক্ষণে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার  উদ্গাতা পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন যে কোনও দিন ঘোষণা হতে পারে। গণতন্ত্রের উৎসবের দিনে স্মরণ করতে হবে কত কিছু! ভয় পাওয়ার জন্য বা ভয় পাইয়ে দেবার জন্য নয়! তবে দক্ষিণপন্থীদের এটা স্মরণ করিয়ে দেবেন কমিউনিস্টরা যে ইন্দোনেশিয়ায় সমুদ্র লাল করেও মার্কসবাদী মতাদর্শ শেষ করা যায়নি। ৭ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নামানো হয়েছিল সিপিআই (এম)-কে খতম করার জন্য। ১১০০ কমরেড খুন হয়েছেন। সিআরপি-কে সেই প্রথম পশ্চিমবঙ্গবাসী চিনল। অকথ্য অত্যাচার করানো হলো পশ্চিমবঙ্গের সংগ্রামী মানুষের উপর। কিন্তু দমানো যায়নি। আমরা যে কোনও অবস্থার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। কিন্তু বাংলা আত্মসমর্পণ করবে না। জয় হবে জনগণের।
                                        
                                    
                                
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0