৮০’র দশকের শঙ্কার মেঘ আবার জমাট বাঁধছে পাঞ্জাবে। আবার উঠতে শুরু করেছে বিচ্ছিন্নতার দাবি। ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি। ফের এই প্রবণতার সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মেই জড়িয়ে রয়েছে রক্তপাত এবং অস্থিরতার আশঙ্কা। ঠিক কী কারণে পাঞ্জাবে আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যা’? এই অস্থিরতা তৈরির নেপথ্যেই বা রয়েছেন কারা? কারা লাভবান হতে চাইছে এই অস্থিরতা থেকে? অনুসন্ধান করেছেন অনিন্দ্য হাজরা।
----
দেশজুড়ে হঠাৎ আলোচিত হচ্ছে একজনের নাম, বলা যায় হঠাৎ করেই সংবাদে উঠে এসেছেন তিনি, তাঁর নাম অমৃতপাল সিং। বর্তমানে এই খালিস্তানপন্থী নেতাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পাঞ্জাব পুলিশ এবং জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ’র আধিকারিকরা। অমৃতপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি খালিস্তান ইস্যুতে পাঞ্জাবে নতুন করে অশান্তির আগুন জ্বালাতে চাইছেন। ইতিমধ্যেই অমৃতপালের দল ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দি’র বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান শুরু হয়েছে। সংগঠনের বহু শীর্ষস্থানীয় নেতা সহ ১১২ জনের বেশি ওয়ারিশ কর্মী সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই আবহে গোটা দেশের মানুষ জানতে চাইছেন কে এই অমৃতপাল সিং? কোথা থেকে তাঁর উৎপত্তি? এবং হঠাৎ এতদিন পরে এখনই কেন পাঞ্জাবে ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে খালিস্তান সমস্যা?
সবার প্রথমে নজর দেওয়া যাক, খালিস্তান ইস্যুর দিকে।
ভারতের স্বাধীনতার নামে ভাগ হয়েছিল পাঞ্জাব এবং বাংলা। পশ্চিম পাঞ্জাবের কয়েক লক্ষ মানুষ এক কাপড়ে বাধ্য হয়েছিলেন নিজেদের ‘পিন্ড’ ছেড়ে পূর্ব পাঞ্জাব কিংবা দিল্লির ‘রিফিউজি কলোনি’গুলিতে আশ্রয় নিতে। সেই ক্ষত এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে শিখ সাম্প্রদায়িক শক্তিদের একাংশ খালিস্তানের দাবিকে জোরালো করে। তাঁদের দাবি ছিল, দেশভাগের ফলে মুসলমানরা পাকিস্তান এবং হিন্দুরা হিন্দুস্থান পেয়েছে। বঞ্চিত হয়েছেন কেবলমাত্র শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাই শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের নিজের দেশ প্রয়োজন, যার নাম হবে খালিস্তান।
এই উগ্র সাম্প্রদায়িক জিগিরের অন্যতম হোতা ছিলেন জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়াল। তিনি খালিস্তান ইস্যুতে ৭০’র দশকের শেষ থেকে পাঞ্জাব জুড়ে কার্যত আগুন জ্বালান। ১৯৮৪ সালে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে ভারতীয় সেনা, কেন্দ্রীয় পুলিশ এবং পাঞ্জাব পুলিশের বিশেষ বাহিনী। যদিও ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর পরেও খালিস্তান সমস্যা শেষ হয়নি। বরং অশান্তির রেশ রয়ে গিয়েছিল ৯০’র দশকের মাঝামাঝি অবধি। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টার মাধ্যমে অশান্তির আগুন কমানো যায়। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বামপন্থীরা। বিশেষত হরকিষেণ সিং সুরজিৎ সহ সিপিআই(এম) সংগঠকরা। বহুক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শহীদও হতে হয় বামপন্থী কর্মীদের। এই অশান্তির নেপথ্যে গুরুতর ভূমিকা নিয়েছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ভারত থেকে পাঞ্জাবকে আলাদা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ‘বদলা’ নিতে চেয়েছিল পাক সেনা।
ধীরে ধীরে পাঞ্জাবে অশান্তির আগুন স্তিমিত হয়ে আসে।
কিন্তু ফের একবার এই সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে, বা সমস্যাকে জাগানোর চেষ্টা চলছে। ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে পথে নামেন কৃষকরা। সেই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন পাঞ্জাবের কৃষকরা। একাংশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, সেই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতেই খালিস্তানপন্থীদের ময়দানে নামায় কেন্দ্রীয় সরকার। ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি দিল্লির লালকেল্লায় খালিস্তানের পতাকা টাঙানোর অভিযোগ ওঠে মুষ্টিমেয় আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে। কেন্দ্রের তরফে এই ঘটনার জন্য সমস্ত কৃষক সংগঠনকে দায়ী করার চেষ্টা করা হলেও কৃষক নেতৃবৃন্দ ও বামপন্থীদের তৎপরতায় সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে ‘খালিস্তানপন্থী’দের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে বাকি কৃষক সংগঠনগুলি। নিজেদের মুখ বাঁচাতে কেন্দ্র দীপ সিধু নামের এক অভিনেতা, যিনি নিজেকে প্রভাবশালী কৃষক নেতা বলে দাবি করছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
পাঞ্জাবে খালিস্তান সমস্যা নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পায় আম আদমি পার্টি পাঞ্জাবের ক্ষমতায় বসার পরে। পাঞ্জাব জুড়ে ‘ওপেন সিক্রেট’, আম আদমির ভগবন্ত মান প্রশাসন চালাতে পারছেন না। সামান্য থেকে সামান্য বিষয়ের সিদ্ধান্তও নেওয়া হচ্ছে দিল্লি থেকে। এর সুযোগে রাজ্যজুড়ে দুষ্কৃতীদের রাজত্ব শুরু হয়েছে। অবাধে সীমান্ত পেরিয়ে পাক মদতপুষ্ট ড্রাগ কারবারিরা নিজেদের ব্যবসা চালাচ্ছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঞ্জাবের বাড়তে থাকা বেকারত্বের সমস্যা। সব মিলিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের উপযুক্ত চারণভূমি। এই উর্বর জমিতে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে একের পর এক সমাজবিরোধী ‘গ্যাং’, যাঁদের অধিকাংশই মদত পাচ্ছে কানাডার মতো পশ্চিমী দেশগুলিতে বসবাসরত কিছু অভিবাসীদের হাত ধরে। পাঞ্জাবের জনপ্রিয় গায়ক তথা কংগ্রেস নেতা সিধু মুসেওয়ালা খুনেও নাম জড়িয়েছিল তেমনই এক দুষ্কৃতী গোষ্ঠীর। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই গোষ্ঠীগুলিকে ঢালাও অস্ত্র, টাকা এবং জাল নোটের জোগান দেয় আইএসআই।
এবার নজর দেওয়া যাক অমৃতপাল সিংয়ের দিকে। ২০২১ সালে দীপ সিধু ক্লাবহাউস নামের সোশাল মিডিয়ায় কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত একটি গ্রুপ খোলেন। সেখানে প্রথম আবির্ভাব ঘটে অমৃতপালের। তিনি পাঞ্জাবের রাজনৈতিক আঙিনায় প্রবেশের আগে দুবাইতে ট্রাক চালক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। দীপ সিধুর গ্রুপে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয় পাঞ্জাবের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হিসাবে। এবং অমৃতপালের হয়ে ‘ওকালতি’ করেন ‘এনআরআই’ গোষ্ঠী।
তারপর দ্রুত উত্থান হতে থাকে অমৃতপালের। এক সাধারণ ট্রাক চালক হয়েও তিনি কিভাবে সশস্ত্র বাহিনী এবং বিলাসবহুল গাড়ির কনভয় নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন, কারা জোগালো সেই অর্থ, উঠতে শুরু করে সেই প্রশ্ন। অমৃতপালের গতিপ্রকৃতি দেখে দীপ সিধুও তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেন। কিন্তু ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রহস্যজনক ভাবে প্রাণ হারান দীপ সিধু। এবং তার নবনির্মিত দল ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দি’র ফেসবুক পেজ থেকে দলের নতুন নেতা হিসাবে ঘোষণা করা হয় অমৃতপালের নাম। যদিও সিধু’র সমর্থকদের দাবি, গোটাটাই চক্রান্ত। ফেসবুক পেজ হ্যাক করিয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ নেন অমৃতপাল।
এরপর শুরু হয় অমৃতপালের ভিন্দ্রানওয়ালে হয়ে ওঠা। প্রাথমিক ভাবে অমৃতপাল দীক্ষিত শিখ ছিলেন না। তিনি দাড়ি রাখতেন না। মাথায় পাগড়িও ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে আনন্দপুর সাহিবে তিনি দীক্ষা নেন। দীক্ষার সময় তিনি কার্যত ভিন্দ্রানওয়ালের মতো পোশাক পরে তাঁর স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এবং তখন থেকেই কার্যত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ফের একই পদ্ধতিতে পাঞ্জাবে অশান্তি তৈরির একটি চরিত্র হাজির হয়েছে।
অমৃতপালের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, ২৩ ফেব্রুয়ারি নিজের দলের কয়েকজন কর্মীকে ছাড়াতে অমৃতসর শহর লাগোয়া আজনালা থানায় হামলা চালান। সেই ঘটনায় এসপি পদমর্যাদার এক অফিসার সহ ৬ পুলিশকর্মী আহত হন। অভিযোগ ওঠে, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের পবিত্র গ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিব হাতে নিয়ে তাণ্ডব চালান অমৃতপাল এবং তাঁর সহযোগীরা। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, ৮০’র দশকের উত্তাল সময়েও গুরু গ্রন্থ সাহিব হাতে নিয়ে এই ধরনের কীর্তি হয়নি।
এই ঘটনার পরে প্রায় ৩ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও সুনির্দিষ্ট এফআইআর করে উঠতে পারেনি আম আদমি সরকার। বরং খালিস্তানপন্থী আদর্শ ঠেকানোর পালটা কোনও আদর্শগত ভিত্তিই নেই আপ সরকারের। তারফলে সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
যদিও ১৮ মার্চ থেকে অমৃতপাল এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। কিন্তু পাঞ্জাব পুলিশের অকর্মন্যতায় আসরে নামার সুযোগ পেয়েছে এনআইএ’র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা। এককথায় এই ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ভগবন্ত মান সরকার। এবং সেই সুযোগকে পুরোদমে কাজে লাগাচ্ছে অমিত শাহ’র নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
যদিও অমৃতপালের এই অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টাকে প্রতিহত করেছে শিখ সমাজ। অধিকাংশ গুরুদ্বারা এবং জাঠেদাররা তাঁর বিরোধিতা করেছেন। ৮০’র দশকের আন্দোলনের সময় পাঞ্জাবের যুব সমাজের একটা অংশ বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে যুব সমাজের সিংহভাগ এই অশান্তি থেকে এখনও পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। যদিও সমস্যা দমনের নামে দমনমূলক বাড়তি শক্তি প্রদর্শন করছে আপ সরকার। তারফলে অমৃতপালের সমর্থনে না হলেও সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হচ্ছে।
এই আবহে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বিজেপি’র ভূমিকাও। পাঞ্জাবে বিজেপি দুর্বল শক্তি হলেও আরএসএস যথেষ্ট সক্রিয়। মূলত শহরাঞ্চলগুলিতে তাঁদের প্রভাব উল্লেখজনক রয়েছে। এই অস্থিরতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু বনাম শিখ সমীকরণ তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছে আরএসএস’এর তরফে। এবং সেই সুযোগকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাচ্ছে আপ সরকারের দুর্বলতা।
এরইমধ্যে ৩ মার্চ সিপিআই(এম)’র পাঞ্জাব রাজ্য কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় চণ্ডীগড়ে। বৈঠক থেকে সর্বদলীয় বৈঠকের দাবি জানায় পার্টি।
এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু জানান, ‘‘এই সমস্যা কেবলমাত্র আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা নয়। এর পিছনে বহিরাগত এজেন্সি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে আদর্শগত একটি দিক। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ড্রাগ সমস্যা এবং বেকারত্বের সমস্যাও। সব মিলিয়ে এটি একটি জটিল সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির একজোট হওয়া প্রয়োজন। সেই জন্য আমরা সর্বদল বৈঠকের দাবি জানিয়েছি সরকারের কাছে।’’
নীলোৎপল বসু আরও বলেছেন, এই মুহূর্তে পাঞ্জাবে সম্প্রীতি রক্ষা এবং মেরুকরণ রোধ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দি’ শব্দের অর্থ পাঞ্জাবের উত্তরাধিকারী। কিন্তু পাঞ্জাব তো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিগুলির অন্যতম ঘাঁটি ছিল। এটা তো ভগৎ সিংয়ের মাটি। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক এবং বামপন্থী ভাবধারার মাটি। সেই মাটির উত্তরাধিকার কীভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি দাবি করতে পারে? ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে জোরদার করেই উগ্র সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
Comments :0