প্রসূন ভট্টাচার্য: মাদুরাই
জনতার থেকে শিখতে হবে, জনতার কাছে পার্টির চিন্তা পৌঁছে দিতে হবে। আমরা এই পথেই সংগঠনের শক্তি বাড়াবো, শক্তি বাড়াবে সিপিআই(এম)।
রবিবার মাদুরাইয়ে পার্টি কংগ্রেসের সমাপ্তির দিনে বিশাল জনসভা থেকে এই লক্ষ্য জানিয়েছেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ।
নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এম এ বেবি বলেছেন, আজকের বিশ্বেও বামপন্থীদের প্রভাব রয়েছে। এটা ঠিক যে সাম্প্রতিক সময়ে এদেশে বামপন্থীদের শক্তি হ্রাস হয়েছে। তার কারণ বাংলায় সব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এক সঙ্গে হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের একাংশও তাতে শামিল। বাংলা এবং ত্রিপুরায় অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আক্রমণ চলছে সমানে। কিন্তু দুই রাজ্যেই বামপন্থীরা লড়াই চালাচ্ছে।
বেবি জানিয়েছেন, জনতার কথা কী, পার্টির বক্তব্যকে কিভাবে বিবেচনা করছেন, তা নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে পার্টি কংগ্রেসে। হয়েছে গঠনমূল সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনা।
বক্তব্য রাখেন পলিট ব্যুরো সদস্য কে বালকৃষ্ণণ, রাজ্য সম্পাদক কে সম্মুগম, সাংসদ এস বেঙ্কটেশনও। বক্তব্য রাখেন পলিট ব্যুরো সদস্য এবং কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। এদিন বেবির আগে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম)’র প্রবীণ নেত্রী বৃন্দা কারাত। তিনি বলেন, এই পার্টি কংগ্রেসে ঐক্যের সম্মেলন, এই পার্টি কংগ্রেস শপথের মঞ্চ। সারা দেশে লড়াই এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষণা হয়েছে।
কারাত বলেছেন, শপথ এই যে বিজেপি’র বুলডোজারকে থামাতে হবে। এই বুলডোজার ধ্বংস করছে সংবিধানকে, শ্রমজীবী-কৃষিজীবীর জীবনকে। এই বুলডোজার নারীর অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, আদিবাসী-তফসিলি জনতাকে বিপন্ন করছে।
কারাত বলেন, ২২ শহীদকে স্মরণ করে আমরা পার্টি কংগ্রেস শুরু করেছি। তার মধ্যে ১১ জন কর্মী এবং নেতাকে গত তিন বছরে আমরা হারিয়েছি কেবল বাংলায়। তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণে শহীদ হয়েছেন তাঁরা। ৪ কর্মী শহীদ হয়েছেন কেরালায়। তার মধ্যে ২ জন আরএসএস-বিজেপি’র আক্রমণে নিহত হয়েছেন। বিহার এবং ঝাড়খণ্ড মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে শহীদ হয়েছেন পার্টিকর্মীরা। এই মাদুরাইয়ে শহীদ হয়েছে একাধিক পার্টিকর্মী। তাঁদের স্মরণ করে শোষিত জনতার পক্ষে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাব।
তামিলৃ ‘সেঙ্গুডি’ মানে লাল পতাকা। কারাত বলেন, ‘সেঙ্গুডি’ কাঁধে নিয়েই চলবে লড়াই।
পলিট ব্যুরো সদস্য এবং কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেন,
তামিলনাডু স্বাধীনতা লড়াই, কমিউনিস্ট পার্টির লড়াইয়ের ঐতিহ্য বয়ে চলেছে। পি রামমূর্তি, এন শঙ্করাইয়া, আর উমানাথের মতো কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ এ রাজ্যকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সামাজিক সমন্বয়ের পক্ষে, জাতপাতের শোষণের বিপক্ষে সমাজসংস্কারের লড়াইয়েরও মাটি তামিলনাডু।
তিনি বলেন, এই পার্টি কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
তিনি বলেন, বিশ্বের পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে আমেরিকা চোখ রাঙানোর চেষ্টা করছে সারা বিশ্বে। চীন আমেরিকার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। আবার দক্ষিণ আমেরিকায় বামপন্থী শক্তির সাফল্য, শ্রীলঙ্কায় বামপন্থীদের সাফল্য দেখাচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত সমাজতন্ত্রের ধারণার প্রভাব রয়েছে যথেষ্টই।
তিনি বলেন, দেশে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি মারাত্মক। সরকার জনতার ওপর চাপ প্রতিদিন বাড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জনতার ঐক্যকে ভেঙে দিচ্ছে। ধান্দার ধনতন্ত্রকে পুষ্ট করছে। ওয়াকফ বিল সেই লক্ষ্যেই পাশ হয়েছে সংসদে। বৃহত্তর লক্ষ্য হলো ভারতে বৈচিত্র্য এবং বহুত্বের বৈশিষ্ট্যকে পুরোপুরি ধ্বংস করা। আরএসএস সেই লক্ষ্যেই সক্রিয়
বিভাজনের রাজনীতিতেই আজ মণিপুর জ্বলছে। আজকে ওই রাজ্যে যা হয়েছে কাল অন্য রাজ্যেও হতে পারে।
কেরালা বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার বিভাজনের রাজনীতির বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে চলছে। এ রাজ্যেও বিভাজনের শক্তি সক্রিয়।
এম্পূরম সিনেমা নিয়ে তাই হয়েছে। রাজনীতির জন্য এই সিনেমা তৈরি হয়নি। বাণিজ্যিক এই চলচ্চিত্রকেও দৃশ্য বাদ দিতে হয়েছে কারণ উগ্র হিন্দুত্ববাদী কিছু অংশ অন্ধ বিরোধ করেছে।
তিনি বলেন, সঙ্ঘ পরিবার নিজেই সেন্সর বোর্ড হয়ে উঠছে। তাদের ধারণার বাইরে কিছু থাকলেই রে-রে করে নেমে পড়েছে। মনে রাখা ভালো সিনেমা জগতের সঙ্গে বহু মানুষের রুজি জড়িত। তাঁরাও বিপন্ন হচ্ছে অসহিষ্ণুতার রাজনীতিতে। এই সাম্প্রদায়িক কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি গোবিন্দ পানসারি, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকরকে হত্যা করেছে।
পিনারাই বলেন, বিরোধী সরকার থাকলেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে। কেরালা বা তামিলনাডুর মতো রাজ্যের মানুষকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
বিজয়ন বলেন, সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা কেবল ভোটের বিচার করে অবস্থান নেয়নি। রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার বিচারে অবস্থান নিয়েছে বলেই সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা দেশের রাজনীতিতে আলাদা। কর্পোরেট আক্রমণ থেকে জনতার জীবিকার ওপর আক্রমণ বা এক দেশ এক ভোট নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছে বামপন্থীরা। শোষিত সব অংশের পক্ষে লড়াই সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে।
এম এ বেবি বলেন, জাতপাত অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে যেমন লড়াই চলবে শ্রেণি সংগ্রামের পাশাপাশি। যারা বলছেন কমিউনিস্ট, বামপন্থীদের বিশেষ সম্ভাবনা নেই। তারা ভুল বলছেন।
তাঁর ব্যাখ্যা, অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির বৃদ্ধি হয়েছে বিশ্বে এবং দেশে। কিন্তু এটিই একমাত্র বাস্তবতা নয়। আবার লাতিন আমেরিকায় বাম শক্তি জোরালো লড়াই চালাচ্ছে। দেশে কেরালায় বামপন্থীদের সরকার পরপর দু’বার নির্বাচিত হয়েছে, এটিও সত্যি।
সমাজতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল শক্তি আসীন এমন দেশগুলিতে বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ জনসংখ্যার বাস।
তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় এনপিপি জোট, জনতা বিমুক্তি পেরুমনা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শক্তি। নেপালে যদি দেখেন সেখানেও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আসীন হয়েছে প্রধানমন্ত্রী পদে।
Comments :0