সঞ্জিত দে- ধূপগুড়ি
ধূপগুড়ি থানার থমথমে পরিবেশকে বদলে দিয়েছে টিয়াপাখির ঝাঁক। পাখির ডাকে মুগ্ধ থানায় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মী আধিকারিক থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা। মন ভরছে থানায় অভিযোগ জানাতে আসা মানুষদেরও। পুলিশের পাহারায় নিরাপদ আশ্রয়ে নির্ভয়ে বড় হয়ে উঠছে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখির দল। ধূপগুড়ি থানায় প্রবেশ করলেই একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাওয়া যায় গাছের মগডালে ঝুলছে সবুজ রঙের মাটির হাড়ি, আর তার মধ্যে ফুটো করে দেওয়া রয়েছে। অনেকে মনে করতে পারেন সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে কেউবা ভাবতে পারেন গাছকে সাজাতে লাগানো হয়েছে।
তবে বাস্তবে তা নয়, পাখি সংরক্ষণ করতে এই অভিনব উদ্যোগ ধূপগুড়ি থানার। ধূপগুড়ি থানা চত্বরে রয়েছে একাধিক বড় বড়প্রাচীন গাছ আর সেই গাছগুলিতেই আশ্রয় নিয়েছে বহু টিয়া পাখি, এখানে তারা ডিম পাড়ছে বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করছে তাও আবার পুলিশি পাহাড়ায়।
বর্তমানে সচরাচর শহরাঞ্চলের টিয়া পাখি দেখা যায় না বললেই চলে। এমনকি কোথাও টিয়া পাখি বাসা বেধেছে জানতে পারলে কেউ কেউ টিয়া পাখির বাচ্চাগুলোকে ধরে বাড়িতে পালার জন্য নিয়ে যায়। কেউ আবার বিক্রি করে দেয়। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে উঁচু গাছেই টিয়াপাখি বাসা বেধে থাকে। তবে ধূপগুড়ি থানাতে হাতের নাগালের মধ্যেই বাসা বেধেছে টিয়া পাখিরা। তারা হয়ত বুঝতে শিখেছে যে থানা নিরাপদ জায়গায় তাদের জন্য। তাই ছানাকে খাওয়াচ্ছে কোন টিয়া তো কোথাও আবার বাবা টিয়া বাচ্চা কে পাহারা দিচ্ছে, আবার কোন গাছে হয়ত মা টিয়া পাখি খাবার এনে বাচ্চার মুখে তুলে দিচ্ছে। এমনই ছবি এখন দেখা মেলে ধূপগুড়ি থানাতে।
ধূপগুড়ি থানা চত্বরে রয়েছে কম করে কুড়িটি গাছ। তার মধ্যে বেশিরভাগ গাছে ঝোলানো রয়েছে মাটির হাড়ি, করে দেওয়া হয়েছে সবুজ রং। যাতে টিয়া পাখি ভয় না পায়।
ধূপগুড়ি থানাতে কর্মরত পুলিশ কর্মীরা সেই গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে টিয়া পাখির কর্মকাণ্ডগুলি নজর করেন।
এদিন ধূপগুড়ি থানার আইসি অনিন্দ্য ভট্টাচার্যকেও এদিন দেখা গেল একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে উপরদিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কাছে গিয়ে ভালোমতো তাকাতেই নজরে এলো গাছের ডাল থেকে একটি টিয়া পাখির মাথা বের করে রেখেছে, আরেকটি পাখি তাকে আদর করছে ঠোঁট দিয়ে। আর তার থেকে কিছু উঁচুতে আরেকটি টিয়া পাহারা দিচ্ছে। যাতে অন্য পাখি এসে হামলা করতে না পারে।
থানা চত্বরকে টিয়া পাখিরা নিজেদের নিরাপদ আস্তানা মনে করে,তাই গাছের তলায় লোক এসে দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা ভয় পায় না। মানুষ তাকিয়ে থাকলেও উড়ে যায় না তারা। কোন কোন গাছের একদম হাতের নাগালের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। কোথাও আবার গাছে লাগিয়ে রাখা হাড়ির ভেতরে ডিম পেড়েছে। পাখির প্রতি ভালোবাসা ও টিয়া পাখি সংরক্ষণের ভাবনা থেকেই এই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে বলে এদিন জানিয়েছেন খানার কর্তৃপক্ষ।
তৎকালীন ধূপগুড়ি থানার আইসি সুজয় তুঙ্গা প্রথম এই টিয়া পাখির কথা ভেবে, গাছের মগডালে মাটির হাড়ি ফুটো করে ঝুলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। যাতে পাখিগুলি সেখানে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারে। দু'বছর আগে এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন থানার আই সি। এই উদ্যোগে সুফল এনেছে এখনকার ছবি দেখে সকলে তাই মনে করছেন।
প্রায় প্রতিদিন টিয়া পাখির খুনসুটি দেখতে গাছ তলায় ভিড় জমান আশেপাশের ব্যবসায়ী থেকে বাসিন্দারা। এমনকি থানায় অভিযোগ জানাতে আসা বাস কোন সমস্যা নিয়ে আসা মানুষেরাও গাছ তলায় দাঁড়িয়ে পাখি দেখে সময় কাটান।
বর্তমান ধূপগুড়ি থানার আইসি অনিন্দ্য ভট্টাচার্য এবং অন্যান্য পুলিশ আধিকারিকরা সব সময় পাখিগুলোর উপরে নজর রাখেন। যাতে কেউ বিরক্ত না করে বা ধরার চেষ্টা না করে। প্রায় সারাদিন ওই থানা চত্বরে মানুষ আসেন। তাই পুলিশকর্মীরা থানা পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি পাখিদের কেও পাহারা দিচ্ছেন, বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে।
পরিবেশ প্রেমী সংগঠন ন্যাসের কর্মকর্তা নফসর আলী বলেন, ‘‘ডুয়ার্সে বিভিন্ন জায়গায় মাঝেমধ্যেই দেখা যায় পাখি শিকার করছে যুবকেরা কখনো টিয়া ময়না পাখি বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছে। তবে টিয়া পাখি গুলি সংরক্ষণের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত রাজ্যের কোথাও পুলিশকে এমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। পাখিরা নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে বলেই এখানে ডিম দিচ্ছে বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করছে। রাজ্যের অন্যান্য থানার থেকে ধূপগুড়ি থানা ব্যতিক্রমী বলে আমাদের মনে হয়েছে, টিয়া পাখি সংরক্ষণের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে ধূপগুড়ি থানা।’’ তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন থানার পুলিশ আধিকারিকদের।
স্থানীয় ব্যবসায়ী অরুণ রায় বলেন, ‘‘আমরাও সকাল বিকেল কাজের ফাঁকে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি পাখিগুলোর আচরণ গুলো লক্ষ করি। খুব ভালো লাগে। নির্ভয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে খাবার নিয়ে এসে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে। টিয়া পাখির ডাক শোনা যায় সকাল-বিকেল। মন ভালো করা একটা পরিবেশ থানায় তৈরি হয়েছে।’’
ধূপগুড়ি থানার আইসি অনিন্দ্য ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পাখি গুলিকে আমরা দেখে রাখি, দু'বছর থেকে এখানে বহু টিয়া পাখি এসে আশ্রয় নিয়েছে। এখানে ডিম দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছে। সকাল বিকেল এখান দিয়ে চলাফেরা করার সময় নজর রাখি পাখিগুলোর ওপর আমরা। মাঝেমধ্যে গাছ তলায় দাঁড়িয়ে তাদের দেখি ভালো লাগে। পাখিগুলি নিজেদের নিরাপদ মনে করে এখানে হয়ত, তাই থানার ভেতরের গাছগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। এখানে কেউ বিরক্ত করে না ওদের। "
Comments :0