সুবিনয় মৌলিক
৫ নং স্বপ্নময় লেনটা ঠিক কোথায় সেটা মানসী সিনহার ছবি বলেনি। কিন্তু কালীঘাট, ভবানীপুর , আহিরীটোলা বা সিমলা স্ট্রিটের যে পুরানো পাড়াগুলোর স্মৃতি শহরপ্রান্তে ও শহরতলিতে ফ্ল্যাটবাড়ির পায়রার কোটরের মতো ঘরগুলোতে সরে আসা বহু মানুষজনের বুকে বসত করে, এই ফিল্মটি প্রথম পর্ব নিঃসন্দেহে সেটিকে উস্কে দেয়। ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক এক সাদা-কালো কুয়াশাময় ছেঁড়াফাটা তালিমারা অতীতে। সেই জমাটি যৌথ পরিবারের মায়ায়, ছায়ায় বেড়ে ওঠা। বাবা-মা-ভাই - বোন- জ্যাঠামশাই-জ্যাঠাইমা-কাকা-কাকিমা- ননদ-জা-ভাসুর-ভাসুরঝি জ্ঞাতি-কুটুম্ব—- সকলেই একান্নবর্তী পরিবারভুক্ত। সারা দিনে বাড়ির লোক, অতিথি অভ্যাগত, ঠাকুর, চাকর, ঝি নিয়ে এলাহি আয়োজন। তিনতলা পুরনো বাড়িটায় গায়ে সেঁটে থাকা অদ্ভুত মাদকতা, পুরু দরজা , রেলিং ঘেরা লম্বা টানা বারান্দা, মোটা মোটা দেওয়াল, কড়ি বড়গা দেওয়া বিশাল ঘর,লম্বা লম্বা জানলা, পাঁচিল ঘেরা মস্ত ছাদ– অনেকের কাছেই সে এক স্বপ্নের ভুবন। ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, ছোটরা লাটাই ধরতে গেলেই বাবা কিংবা কাকাইয়ের চিৎকার " মাঞ্জাসুতোয় হাত কেটে যাবে ,রেখে দে” পুজো পার্বণে নাচ গানের অনুষ্ঠান, নিষিদ্ধ চাহনি বিনিময়, টুকরো কথা, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাই-ভোল্টেজ হাসি, শরীরে অদ্ভুত শিরশিরানি, বন্ধুদের সঙ্গে লুকিয়ে সিগারেট কিংবা আরও বেশি কিছু।
অনেকের কাছেই এসব এখন অতীত, স্বপ্নভঙ্গের ছায়া। কারণ এইসব মন কেমন করা ন্যারেটিভের অন্তিমে প্রায় স্বতঃসিদ্ধের মতো সর্বত্র, সর্বদা ঝুপ করে নেমে আসে বিপর্যয়। পরিবারের সর্বময় কর্তার অকস্মাৎ মৃত্যু, আর্থিক টানাপোড়েন, প্রোমোটার প্রবেশ, বাড়ির হাতবদল। যৌথ বাসাবাড়ি ভেঙে পরিবার ছত্রখান। ‘শুধু মায়া রয়ে গেলো’ আউড়ে, ব্যক্তিগত বিবর্ণ আর্তস্বর এক দীর্ঘনিঃশ্বাসে জড়ো করে দূরতম লংশটে এলোমেলো কিছু স্থিরচিত্র ফেলে রাখার সাহসী সিদ্ধান্ত, তারপর নটে গাছটি আমূল মুড়িয়ে সমাপ্তি-দ্য এন্ড।
এখানেই মানসীর ছবিটা শেষ হয়ে গেলে হয়তো আর বিশেষ কিছু বলার থাকতো না। খানিক গত শতাব্দীর শেষ দশকের সন্ধে নেমে আসা ‘পারিবারিক’ বাংলা ছবির অস্পষ্ট রিমেক হয়েই থেকে যেত এই ফিল্মটিও। কিন্তু স্বপ্নময় লেনের বৈশিষ্ট্য হলো এই স্মৃতিবিধুর সাদাকালো পর্বটি মিটে গেলেই বরং বলা যেতে পারে আসল ছবিটির শুরু। হৃদয়জলে আবার উদ্দীপনার জোয়ার। সেই পেছনে ফেলে আসা রোদের গন্ধমাখা দিনগুলোকে পুনরুদ্ধার করার স্বপ্ন দেখে আরেক প্রজন্ম। দুই অবিচ্ছেদ্য মাসতুতো-পিসতুতো বোন দুষ্টু আর মিষ্টি (অন্বেষা হাজরা আর পায়েল মুখোপাধ্যায় ), যারা মালিকানা পরিবর্তনের সময় নেহাতই নাদান ছিল, তারাই হাড়পাঁজরের মধ্যে পুষে রেখে দিয়েছিল ভালোবাসার ঠিকানা ফেরত পাওয়ার দুর্বার জেদ। আর তাদের, বিশেষ করে দুষ্টুর কোমর কষে ৫ নম্বর স্বপ্নময় লেনে ফিরে যাওয়ার প্রকল্প নিয়েই ছবিটির মোক্ষম কাহিনি। তবে এটুকু পড়েই ভুল করবেন না। শুধু একটা বাড়ি ফেরত পাওয়ার গল্প নয়, ৫ নং স্বপ্নময় লেন যেন আদতে আপাতত বাতিল, নাকচ, সেকেলে পরিত্যক্ত বলে নির্ধারিত সম্পর্ক আর মূল্যবোধকেও ফিরে পেতে চায়। আর এটাই এই ছবির ঝলমলিয়ে দেওয়া ইউএসপি। পুরোটাই একটা লড়াই, এবং সব লড়াইয়ের মতোই এটাও লম্বা, জানকবুল ও শেষতক।
সাদা কালো অতীত পেরোনো আজকালের গল্পে ঢোকার মুখেই মানসী তাঁর ছবিতে প্রবেশ করিয়েছেন তিনটি ব্যতিক্রমী চরিত্রকে, যারা জীবনের হেমন্তবেলায় পৌঁছেও অতুলনীয় সজীব ও প্রাণবন্ত। তারা হলেন দুষ্টু-মিষ্টি দুজনেরই হবু শ্বশুর গজপতি ওরফে গজু দত্ত (খরাজ মুখোপাধ্যায়), তাঁর স্ত্রী মোহর (অপরাজিতা আঢ্য) এবং তাঁদের পারিবারিক বন্ধু আইনজীবী নয়নমণি সেন (চন্দন সেন)। এই তিন চরিত্রের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুষ্টু-মিষ্টির আপাত-অসম্ভব স্বপ্ন ডানা মেলেছে আর আমাদের মতো অনেক নিরুপায় মানুষের দৈনন্দিন স্বপ্নের মতোই ছবিটি হয়তো 'কখন কেমন করিয়া কী হইয়া গেল’ ধরনের নয়, কিন্তু কাছাকাছি ধরনের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে পরিণতি খুঁজতে চেয়েছে। বাস্তবের সমস্ত বিবর্ণ নির্দয় অপ্রেমকথা ছাপিয়ে জয়ী হতে চেয়েছে স্বপ্নময় ভালোবাসাবাসি ।
এভাবেই ৫ নং স্বপ্নময় লেন এক নিতান্ত মামুলি মধ্যবিত্ত যাপনের ছবি থেকে হয়ে উঠতে চেয়েছে একটা প্রত্যাবর্তনের উচ্ছল রূপকথা। রূপকথা হলেও তা আধুনিক রূপকথা যা তার অবয়বে ধারণ করেছে বেশ কয়েকটি নিয়ম ভাঙার নির্দেশিকা যেগুলি নিয়ে বাণিজ্যিক ছবি সচরাচর নাড়াঘাঁটা করতে চায় না। ছবির রূপকথা-মার্কা গড়নটার পূর্ণমাত্রায় সদ্ব্যবহার ঘটিয়েছেন পরিচালক। ব্রেস্ট ক্যানসার আক্রান্ত দুষ্টুকে অপারেট করে অঙ্কোলজিস্ট গজু দত্ত তাকেই পুত্রবধূ বলে গ্রহণ করেছেন, কথাটা সহজ কিন্তু বলতে সাহস লাগে। ব্রেস্ট ক্যানসার সার্ভাইভার তো ‘খুঁতো’ তার সঙ্গে প্রেম বা তাকে বিয়ে— এগুলো যে কোনও কারণেই হোক মূলস্রোতের বাংলা ছবির কাছে দুষ্পাচ্য ভাবনা। একইভাবে মঙ্গলানুষ্ঠানে এমনকি সন্তানের বিয়েতে বিধবাদের অনুপস্থিত থাকার যে সময়বিদ্ধ লোকাচার সেটুকু অগ্রাহ্য করার কথা সামনে আনাটাও এই মুহূর্তে এক রকমের দুঃসাহস তো বটেই। কিন্তু মানসীর দ্বিতীয় ছবিটি আগেরবার মতোই এ নিয়ে সাবলীল ও দ্বিধাহীন। পুরানো বাসাবাড়ি ফেরত পাওয়ার টাকা জোগাড় করতে দুই মেয়ে বেচে দিচ্ছে তাদের আশীর্বাদী গয়না, হয়তো অবাস্তব, কিন্তু বুক দিয়ে আগলে রাখার মতোই ব্যাপারস্যাপার।
আগের ছবিটার মতোই এটিতেও বেশ কিছু গুণী মানুষ অভিনয় করেছেন। বিমল চক্রবর্তী , ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়, দেবপ্রতিম দাসগুপ্ত, অর্জুন চক্রবর্তী, সুমিত সমাদ্দার তো আছেনই, বিশেষভাবে বলতেই হবে খরাজ মুখোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য আর চন্দন সেনের কথা। আমার মতে ব্যাপ্তির বিচারে খরাজ এই সময়ের বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। গজু দত্তের চরিত্রায়নে তাঁর দক্ষতাকে অবশ্য কিছুটা সীমায়িত করে দিয়েছে তাঁর মাথায় বসানো অতি বেমানান পরচুলাটি। ওটি বাদ দিলে মোহর অর্থাৎ অপরাজিতার সঙ্গে তাঁর রসায়ন আরও একটু জমতো। আর অপরাজিতাকে নিয়ে যেটা বলার সেটাতো চন্দন সেন সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এই সব দুর্দান্ত অভিনেতা কেন যে এতো কম ব্যবহৃত হচ্ছেন সেই বস্তাপচা প্রশ্নটা এ ছবির প্রতিটি নাটকীয় মুহূর্তে বারবার মনে আসবে।
একঝাঁক অপরিচিত কিংবা স্বল্পপরিচিতদের নিয়ে কাজ করাটাও মানসীর একটি বৈশিষ্ট্য। যার ফলে একটা চনমনে উদ্যমী টিমওয়ার্কের ছাপ ওঁর কাজে থাকেই। দুষ্টু বা অন্বেষা হাজরা যদিও বাংলা সিরিয়ালের পরিচিত মুখ এই ছবিতে তাঁর ভূমিকা হল থেকে বেরোলেই মন থেকে পালিয়ে যাবেনা, গ্যারান্টি । অন্যান্য বাকিরাও এক-আধজন বাদে কেউই হতাশ করেননি।
খুব একটা হি -হি , হো-হো আর হৈ-হৈ করে দেখার ছবি নয় ৫ নং স্বপ্নময় লেন। বেশ খানিকটা মন কেমন আর মন খারাপ করা সংলাপ মাঝেমধ্যে চোখে জল এনে দেবে, দেবপ্রতিমের চিত্রনাট্য এরকমই। একধরণের চাপা কৌতুকরসে অভিষিক্ত ঠিকই , হয়তো চন্দনের তৈরি করা মুহূর্তগুলো এ বিষয়ে বাড়তি তৃপ্তি দেবে, কিন্তু পরিচালকের তর্জনী-সংকেত অন্যদিকে। ছবিটি দেখতে দেখতে অন্য কথা ছাপিয়ে মনের মধ্যে পাকা ঘাঁটি গাড়তে থাকবে একটা জীবনবোধ- স্বপ্ন সফল করতে লাগে একটুখানি ইচ্ছে আর সাহস।
ছবিটার শুরু থেকে শেষ অব্দি কেমন যেন একটা তরুণ মজুমদার ঘরানার অনুসারি হওয়ার স্বাদগন্ধ আছে। আছে নিরালম্ব ফ্যান্টাসিতে ভেসে না থেকে সাদামাটা ভঙ্গিতে সমাজ, সামাজিক মননের সঙ্গে কথোপকথনের সচেষ্ট প্রয়াস। এবং আছে একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত। তার মধ্যে একটা আবার লোপামুদ্রা মিত্র ও খরাজ মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈতকণ্ঠে, যেটা নিঃসন্দেহে বাড়তি পাওনা। অবশ্যই শ্রাবনী সেন আছেন তাঁর উদাত্ত গলা নিয়ে। আছেন ইমন চক্রবর্তী ও দুর্নিবার সাহা। শিরোনামের গানটি লিখেছেন আকাশ চক্রবর্তী এবং গেয়েছেন অন্তরা মিত্র। পুরোটাই যোগ্যতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন জয় সরকার।
সব কথার শেষ কথা হলো দৈনন্দিন আলতু ফালতু এটা ওটা সেটার জীবন থেকে জীবন থেকে সময় বের করে নিয়ে এইরকম একটা পরিচ্ছন্ন ছবি দেখে আসাটা জরুরি। সে আপনি শৈল্পিক, নৈতিক বা রাজনৈতিক যে দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাবুন না কেন।
Comments :0