শুদ্ধসত্ব গুপ্ত
তর্ক চলছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে। খানিক তর্ক, খানিক বিতণ্ডা। বাঙালির আড্ডায় চিরাচরিত যে বিষয়টি নিয়ে কথার যুদ্ধ হয়েই থাকে। ‘পিঠে কাঁটাতারের দাগ’ বা ‘মাচা’ এসব চলেও আসে, সামনাসামনি বা সোশাল মিডিয়ায়। কিন্তু এবারের আড্ডায় এল একেবারেই অন্য কথা। ‘ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা’, ‘কাপুরুষ’ এমনকি মা-বোনের সম্মান রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা। সমবয়সি স্কুলের বন্ধুদের কোনও আড্ডায় অতীতে এমন সব কথা থাকত না।
সেই ‘আতঙ্ক’ এবং ‘ত্রাতার’ ধাঁধা
ভোটের মুখে ফের ফিরেছে নাগরিকত্ব বিবাদ। রাজ্যের সাংসদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে বিধানসভার বিরোধী দলনেতারা বলতে শুরু করলেন কবে থেকে চালু হবে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিধি। তার পরপরই খবর মিলল রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে নাগরিকদের অনেকের। ঠিক কত, কোন জেলায় কারা— এসব তথ্য সামনে না এলেও শোনা গিয়েছে ওপার বাংলা থেকে সীমান্ত টপকে আসা হিন্দুরাও রয়েছেন এর মধ্যে। অন্তত মুখ্যমন্ত্রীর কথায় তা-ই মনে হয়েছে অনেকের।
আধার নাগরিকত্বের চিহ্নিতকরণ নয়। কিন্তু নথি তো। নাগরিকত্ব আইনের ঘনঘন প্রতিশ্রুতি আর সময়সীমার মধ্যে অচল করা হয়েছে আধার কার্ড। ফলে জুড়ে গিয়েছে নাগরিকত্বের আইন চালুর প্রসঙ্গও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহও বলছিলেন যে পাঁচ বছর আগে পাশ আইন এবার চালু হবে। ‘এবার’, মানে আসলে ভোটের আগে। মুখ্যমন্ত্রীও পড়লেন ঝাঁপিয়ে। গত কয়েকটা ভোটের আগে যেমন আমরা দেখছি। এনআরসি-সিএএ-এনপিআর আর নাগরিকত্বের মিশেলে আতঙ্ক তৈরি হবে। এবার ত্রাতার খোঁজ! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তুনু ঠাকুরের বয়ান অনুযায়ী ফরম ভরে তাঁকে জমা দিতে হবে। বিজেপি দপ্তরেও ফর্ম নেওয়া হবে। আর মুখ্যমন্ত্রী একেবারে সটান ‘বিকল্প কার্ড’ বিলিতে পৌঁছে গিয়েছেন।
আধার মানে আঙুলের ছাপের মতো ‘বায়োমেট্রিক’ তথ্য সংরক্ষণ করে যে প্রতিষ্ঠান, সেই ইউআইডিএআই’র বক্তব্য, নাগরিকদের থেকে সময়ে সময়ে তথ্য চাওয়া হতে পারে। তবে কারও আধার কার্ড বাতিল হয়নি।
কিন্তু নিষ্ক্রিয়করণ হলো কেন? আগাম কোনও তথ্য চেয়ে না পাঠিয়ে একতরফা আধারের স্বীকৃতি স্থগিত রাখা হলো কেন? ব্যাঙ্কের লেনদেন আটকে রাখতে হলো কেন? এসব কোনও প্রশ্নেরই জবাব নেই।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ক্ষমা-টমা চেয়ে বললেন, ভুলবশত হয়ে গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মানে ইউআইডিএআই কিন্তু সেকথা বলল না। প্রশ্ন আরও রয়েছে, কোনও আইনে আধার কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে আধার কার্ড? যে তথ্য চাওয়া হয়েছে তা জোগাড় করতে কিছু সময় লাগতেও পারে। মাঝে জরুরি দরকার হলে, যেমন হাসপাতালে ভর্তি করতে হলে বা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে হলে কী করবেন। ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দেবেনই বা কে?
নাগরিককে প্রতিদিন অসুরক্ষিত করে দেওয়ার প্রেসক্রিপশন যেন! প্রতিদিন মনে করাতে হবে যে অধিকার তো অনেক পরের কথা, নাগরিকত্বই একরকম দয়ার দান। ঠিক এখানেই স্বাধীনতার লড়াই থেকে উঠে সংবিধানকে প্রতিদিন অস্বীকার করা হয়।
আধার, সুপ্রিম কোর্ট, সরকার
একশো দিনের কাজে টাকা পেতেও আধার চিহ্নিতকরণ চাই। রেশনে চাল তুলতেও আধারে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলতে হবে আঙুলে ছাপ। না মিললে রেশন দেওয়া হচ্ছে না। অথচ দেশের শীর্ষ আদালত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে সরকারি পরিষেবা বা জনকল্যাণকর প্রকল্পের প্রাপ্যের জন্য আধার কার্ড প্রয়োজনীয় নয়, বাধ্যতামূলক তো নয়ই। এমনকি গত বছরের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের তলবে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হয়েছে যে ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত বা সংশোধনের জন্য আধার বাধ্যতামূলক করা হবে না।
২০১৮’র সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে ব্যাঙ্ক, মোবাইল বা স্কুলে ভর্তির জন্য আধার কার্ডকে বাধ্যতামূলক করা চলবে না, পরিচয় চিহ্নিত করার অন্যান্য নথিও ব্যবহার করা যাবে।
বাস্তবের অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। আধার না থাকলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে না। আধার অচল করা হলে অ্যকাউন্টের টাকাও লেনদেন করা যাবে না। প্যানের সঙ্গে আধার সংযোগ থাকতে হবে। মোবাইল নম্বরের সঙ্গেও আধার সংযোগ চাই। রান্নার গ্যাসের সঙ্গে আধার লিঙ্ক করতে হচ্ছে এখন। কোনও বাসিন্দাকে নজরবন্দি করার কোনও সুযোগই ছাড়া হবে না। সংযোগের সময়সীমা পার হয়ে গেলে জরিমানা দিয়ে করাতে হবে। এক কার্ডের সঙ্গে অন্যটির সংযোগ, বায়োমেট্রিক প্রমাণ নথিভুক্ত করানোর নানা প্যাঁচে জীবন জেরবার হতে থাকবে।
রাজ্যের সরকারে আসীন তৃণমূল কংগ্রেস ভোটের মুখে হাতা গুটিয়ে নেমে পড়বে, কিন্তু সংসদে দলের সাংসদরা জনজীবনে সমস্যা আর সুপ্রিম কোর্টের রায় তুলে ধরে সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করবেন না। মাঝে পড়ে একবার দুয়ারে সরকার আরেকবার দুয়ারে বিজেপি’র শিবিরে শিবিরে দৌড় করাবে নাগরিকদের। বাস্তবে কেন্দ্রের নিয়মবিধি পালনে সরকারি কাজে রাজ্যের সরকার একনিষ্ঠ সমর্থক।
আধার, নাগরিকত্ব, ‘ক্রনোলজি’
২০১৯’র ভোটের আগে কলকাতায় বসে বিজেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন ‘ক্রনোলজি সমঝিয়ে’। পরপর কী হবে জানিয়ে নরেন্দ্র মোদীর কমান্ডার বলেছিলেন প্রথমে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন হবে। তারপর সারা দেশের জন্য জাতীয় নাগরিক পঞ্জি চালু হবে।
ভোটের পর সরকারে এসে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেও নেয় বিজেপি। প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব চালু করে। বলা হয় পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন এমন হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও পারসিদের নাগরিকত্ব দিতে এই আইন।
সেই সঙ্গে বলা হলো যে ‘ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের শিকার শরণার্থীদের’ নাগরিকত্ব দিতে এই সংশোধনী আইন। ২০১৯’র ১১ ডিসেম্বর, সংসদে বিল পেশের পরই, কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রকের অধীন প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর বার্তায় এই উল্লেখই রাখা হলো।
পাঁচ বছরেও এই প্রশ্নের জবাব মিলল না যে ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’ প্রমাণ দিতে হবে কিভাবে। এখনও অস্পষ্ট যে আইন প্রয়োগ করতে হলে যে বিধি আসবে, সেখানে ঠিক এই প্রশ্নটিতে কী বলা হবে।
আসামে বিজেপি সরকারই অনুপ্রবেশ ঠেকানোর নামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির তুমুল তৎপরতা দেখায়। খরচও হয় বিপুল। পঞ্জিতে দেখা যায় কেবল মুসলিমদের বেনাগরিক করা হয়নি, হয়েছেন হিন্দু বাঙালিরাও। আর পশ্চিমবঙ্গে, মতুয়া অংশের ভোটের জন্য নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি চলতে থাকে। যাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে রাজ্যে কোনও প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়নি।
যে বাংলা, দেশভাগের পর, উদ্বাস্তুদের কাছে টেনে নিয়েছিল, উদ্বাস্তুদের অধিকারের লড়াইয়ে উত্তাল হয়েছিল, হিন্দু মহাসভার ভোট কমছিল এবং কমিউনিস্টদের ভোট বাড়ছিল, সেই বাংলাতেই ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের আইন এখন ভোটের অস্ত্র। অস্ত্র বিজেপি’র, অস্ত্র তৃণমূলেরও। একপক্ষ শুরু করবে, আরেকপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়বে। এবারের আধার পর্বে তারই ‘অ্যাকশন রিপ্লে’।
উসকানিই শেষ কথা বলবে না
সূক্ষ্ম পরিচিতসত্তায় হাওয়া দিয়েছিল তৃণমূল। সব অংশকে জুড়ে নেওয়া নয়, এক অংশকে অন্যের থেকে আলাদা করা। পুরোটাই ভোটের অঙ্কে। যেমন ঠাকুরবাড়ি থেকে সংসদের সদস্য করা। সে খালে এখন সাঁতরাচ্ছে বিজেপি। তবে বারবারই একই ছক কাজে আসবে এমন নয়।
Comments :0