Editorial

ভারতকে অপমান, মানবতাকেও

সম্পাদকীয় বিভাগ

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্বের দরবারে ভারতের মুখোজ্জ্বল করেছেন বলে শাসকদল বিজেপি নিয়মিত প্রচার করে থাকে। দেশের গৌরববৃদ্ধির পক্ষে ব্যক্তি মোদী কোনও ভূমিকা পালন করতে পারেন এমন আশা না থাকলেও আন্তর্জাতিক মহলে দেশের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রধানমন্ত্রীর আসনটিকে তিনি যথাযথভাবে ব্যবহার করবেন, এমন প্রত্যাশা ও দাবি দেশবাসী করতেই পারেন। কিন্তু ন্যূনতম সেটুকুও করতে মোদী এবং তাঁর সরকার ব্যর্থ। দেশের মানুষ অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে দেখতে পেলেন, আমেরিকা থেকে একটি মালবাহী সামরিক বিমানে বুধবার দুপুরে অমৃতসরের শ্রী গুরু রামদাসজী বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়েছে ১০৪ জন ভারতীয়কে। মার্কিন সরকারের মতে, তাঁরা ‘অবৈধ’ ভারতীয় অভিবাসী। এই কারণে টেক্সাস শহর থেকে তাঁদের বিমানে তুলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অভিবাসীদের মধ্যে যারা অমৃতসরে পৌঁছেছেন তাঁদের মধ্যে ৩০ জন পাঞ্জাব, ৩৩ জন হরিয়ানা ও গুজরাট এবং ৩ জন মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা। মোট ৪৮ জনের বয়স ২৫ বছরের কম, এবং ফিরে আসা অভিবাসীদের মধ্যে ২৫ জন মহিলা ও ১২ জন শিশু। এমনকি ৪ বছরের এক শিশকেও ঐ বিমানে ফেরত পাঠানো হয়েছে। 
‘অবৈধ’ চিহ্নিত করে ভারত সহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের অভিবাসীদের ফেরানোর ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। এই অভিবাসীরাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরের পর বছর মেহনত করেছেন, মার্কিন অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন। কিন্তু দক্ষিণপন্থীদের সবরকম চরিত্রগত লক্ষ্মণ প্রকাশ করে ট্রাম্প সরকার এই অভিবাসীদেরই এখন মার্কিনীদের দুর্দশার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিযায়ী শ্রমিককে ‘অবৈধ’ অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে মার্কিন সেনা পরিচালিত বিভিন্ন বন্দি শিবিরে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে। নারী, পুরুষ, শিশু, প্রতিবন্ধী নির্বিশেষে তাদের হাতকড়া পরিয়ে ধাপে ধাপে ‘দেশছাড়া’ করার পরিকল্পনা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। মানবাধিকারের কোনও বালাই না করে ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, ‘ভিনদেশি অনুপ্রবেশকারীদের’ জন্য মানবাধিকার বিধি মান্য করার বাধ্যবাধকতা সরকারের নেই।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রসঙ্ঘ যে মানবাধিকার ঘোষণা করেছে তাতে মানবাধিকার বিচারে জাতি ধর্ম দেশ ইত্যাদি পরিচয়ের কোনও নিক্তি হয় না, মানুষ মাত্রেই মানবাধিকারের অধিকারী। কিন্তু ট্রাম্প সরকারকে তা মানাবে কে! 
মানানোর মতো হিম্মত আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদী না দেখালেও কলম্বিয়ার বামপন্থী রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো পেট্রো দেখিয়েছেন। ভারতের তুলনায় অতি ছোট্ট দেশ হলেও সেই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে তিনি কলম্বিয়ার দেশের নাগরিকদের শৃঙ্খলিত অবস্থায় ফেরত নিতে রাজি হননি, বরং আমেরিকার চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করেছেন এবং মার্কিন সামরিক বিমানটিকে তাদের মাটিতে অবতরণ করতে দেননি। জানিয়ে দিয়েছেন, কলম্বিয়ার নাগরিকদের অসামরিক বিমানে মানুষের মর্যাদা সহকারে ফিরিয়ে আনা হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেকে বিশ্বগুরু বলে দাবি করে থাকেন, স্বদেশে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে বহু প্রচার করেছেন, উদ্যোগ নিয়ে মার্কিন দেশে মোদী মোদী আওয়াজ তুলিয়েছেন, এবং খুব শীঘ্রই ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্ব দেখাতে ফের ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। মনুষ্যত্বের প্রতি অপমান, নিজ দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার হরণ ইত্যাদি দেখেও যারা প্রতিবাদ করতে পারে না, তাদের মুখে দেশমাতৃকার নাম করে রাজনীতি মানায় না। মোদী বিশ্বের দরবারে ভারতের অমর্যাদাকে যেভাবে নীরবে হজম করেছেন, তা দেশেরই অপমান। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে ভারতের পরবর্তী রাষ্ট্রনায়করা বহুবার আন্তর্জাতিক দরবারে ভারতের যে স্বাধীন সার্বভৌম নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন তা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির চোখে ভারতকে মর্যাদার চোখে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ভারত ছিল জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির ‘নেতা’স্বরূপ। ভারতের সেই মর্যাদা মোদীর হাতে ভূলুণ্ঠিত।

Comments :0

Login to leave a comment