Baharampur

বাম-কংগ্রেস বনাম তৃণমুলের দুই ফুল

জেলা লোকসভা ২০২৪

 

 ঘুষ নিয়ে শিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে বড়ঞার বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা জেলবন্দি। চুরি লুকোতে পুকুরে সেই বিধায়কের মোবাইল ছুঁড়ে ফেলার ঘটনা কী লোকসভা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে? তৃণমূলের দু’পক্ষের দু’রকম মনোভাব। 
বড়ঞা বহরমপুর লোকসভার মধ্যে। মমতা ব্যানার্জি সেই বড়ঞা ‘দেখে নেওয়া’র দায়িত্ব দিয়েছেন কান্দির বিধায়ক ডেভিডকে। ডেভিড মানে অপূর্ব সরকার। প্রশ্ন শুনে সরকার বললেন,‘‘আমি সব বিষয়ে জবাব দেব। জিজ্ঞেস করুন। কিন্তু ওই বিষয়ে কোনও কথা আমি বলব না। যা বলার স্টেট লিডারশিপ বলবেন।’’
অর্থাৎ ডেভিড ডিফেন্সে। কিন্তু অফেন্সে হুমায়ুন কবীর। সন্দেহ সেখানেই।
ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন এবার বহরমপুরে ইউসুফ পাঠানকে দলের প্রার্থী ঘোষণার পরই ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। তাঁর কথায় ছিল আরও অনেক তৃণমূল নেতার কথা—‘আর কী কোনও প্রার্থী ছিল না দলের? বাইরে থেকে ইউসুফ পাঠানকে আনতে হলো?’ এখন সেই ‘বিক্ষুব্ধ’ হুমায়ুন নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গে ‘স্টেট লিডারশিপ’র ধার ধারলেন না। দাবি করে ফেললেন,‘‘আপাতদৃষ্টিতে এর কোনও প্রভাব পড়বে না। কেন প্রভাব পড়বে? বড়ঞার বিধায়ক অন্যায় করেছেন বিধায়ক হওয়ার আগে থেকে। মানুষের মধ্যে চাকরি দুর্নীতির কোনও প্রভাব নেই। আমাদের প্রার্থী জিতবেন। দ্বিতীয় থাকবেন বিজেপি’র প্রার্থী।’’ বিজেপি দ্বিতীয় হবে? হুমায়ুনের বক্তব্য,‘‘হ্যাঁ, বিজেপি প্রার্থী ডাক্তারবাবু। ওরা বেশ এগিয়ে এসে দ্বিতীয় হবে।’’
বিজেপি সম্পর্কে হুমায়ুনের বেশ ভরসা!
হুমায়ুন তৃণমূল থেকে বিজেপি’তে গেছিলেন। ২০১৯-এ জঙ্গীপুর লোকসভা আসনে বিজেপি’র প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে আবার তৃণমূলে ফেরেন। এবার বহরমপুর আসনে প্রার্থী হওয়ার আশা করেছিলেন। 
বহরমপুরে এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দিক কী? ‘জোট সলিড।’ মনোজ চক্রবর্তীর প্রথম প্রতিক্রিয়া তাই। 
বহরমপুর লোকসভা আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী অধীর চৌধুরি। বামফ্রন্ট কংগ্রেসকে সমর্থন করছে। রাজ্যে এবার বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে লড়ছে। মুর্শিদাবাদ জেলার বাকি দু’টি আসনেও সেই সমঝোতার ভিত্তিতে লড়াই। জঙ্গীপুরে কংগ্রেস প্রার্থী মুর্তজা হোসেন। মুর্শিদাবাদ আসনে কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
বহরমপুর লোকসভা আসনে কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনা করছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘জোট’ শব্দটিতে সমঝোতাকে বোঝানো সহজ হয়। জেলার গ্রামগুলিতেও মানুষ তাই ‘জোট’ই বলছেন। বহরমপুরের বারাক স্কোয়ারের কাছে কংগ্রেসের অফিসে বসে মনোজ চক্রবর্তী বললেন,‘‘এবার এই জোট একদম নিচুতলা থেকে হয়েছে। বামকর্মীরা নেমেছেন। আমাদের কর্মীরাও নেমেছেন। একসঙ্গে কর্মসূচি হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে তা এক ভালো পরিবেশ তৈরি করেছে।’’ অধীর চৌধুরীকে বিভিন্ন জায়গায় বাধা দিচ্ছে তৃণমূল। এটাতে কী প্রভাব পড়বে? মনোজ চক্রবর্তীর কথায়,‘‘ভয় না পেলে কেউ এমন করে? ভয় পেয়েছে বলেই আটকানোর চেষ্টা, উত্তেজিত করার চেষ্টা। তারপর মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার চেষ্টা করছে। দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টাও করেছে তৃণমূল, বিজেপি। জোটটা সলিড হওয়ায় ওরা ভয় পেয়েছে।’’
তৃণমূল প্রচার করছে প্রার্থীকে নিয়ে। তবে বহরমপুর শহরে দু’দফায় ইমাম, মোয়াজ্জেমদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তাদের। সেখানে টি টুয়েন্টির হার্ড হিটারকে তাঁর পরিবারের সঙ্গে ইমাম, মসজিদের সম্পর্ক বলতে হয়েছে বিনয়ের সঙ্গে। ভোটের পিচ তো!
রেজিনগরের শক্তিপুরে সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হয়। আম্বেদকারের জন্মদিনে। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইসি’কে সরিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শক্তিপুরের ঘটনাস্থলের দুই বাসিন্দা মুজিবুর রহমান এবং অরবিন্দ বিশ্বাস। মুজিবুরের কথায়,‘‘আমরা কিছুই বুঝি না বলে দলগুলি মনে করে। দাঙ্গা যারা করল তারা সবই একপক্ষের লোক। তৃণমূলের লোক। আমরা কী গাস খাই? নির্বাচনের আগে ভোট দু’ভাগ করতে চাইছে। গত বিধানসভার আগেও শীতলকুচিতে কী হলো, তার ধাক্কা এখানে চলে এল।’’ তৃণমূল কেন এমন করবে? ব্যবসায়ী মুজিবুরের কথায়,‘‘তৃণমূল ইউসুফ পাঠানকে প্রার্থী করল কেন? তৃণমূলের কী আর নেতা নেই? গতবার তো ইন্দ্রনীল সেনকে দাঁড় করিয়েছিল। রাজ্যে তো বটেই জেলাতেও অনেক তৃণমূল নেতা আছে, যারা প্রার্থী হতে পারতেন। আমরা গাঁয়ে থাকি তো, বুঝতে পারি। ওদের অনেকেই খুশি নয়। ক্ষোভ আছে তা নিয়ে।’’ তাহলে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করবে কেন? মুজিবুরের ব্যাখ্যা,‘‘ভোট ভাগাভাগি করে বিজেপি’কে সুবিধা করে দিতে চাইছে। বিজেপি বড় হয়ে গেলে ওরা মুসলমানদের সেই ভয় দেখাবে। কিন্তু মানুষ গরিব হতে পারে, বোকা নয়।’’ 
অরবিন্দ বিশ্বাসের ‘অ্যাঙ্গেল’ পুরো আলাদা। গত বিধানসভা নির্বাচনে রেজিনগরের বিজেপি প্রার্থী ছিলেন তিনি। বাড়ি ওই শক্তিপুরেই। প্রথমেই দাবি করলেন,‘‘লড়াই তৃণমূল আর বিজেপি’র মধ্যে। অধীরদা এবার ফ্যাক্টর নন।’’ কেন? অরবিন্দ বললেন,‘‘ভোট র্যা ডিকালাইজড হয়ে গেছে।’’ কে জিতবে? অরবিন্দর জবাব,‘‘সেটা বলা কঠিন। তৃণমূল ইউসুফ পাঠানকে প্রার্থী করেছে। আমরাও লড়ছি। আমাদের প্রার্থী ডাক্তারবাবু। মিডিয়াও তো বলছে আমরা ভালো পজিশনে আছি।’’ 
বিজেপি’র রেজিনগরের এই নির্বাচনী কমিটির আহ্বায়ক হওয়া সত্বেও জোর দিয়ে বললেন না যে জিতছেন। বিজেপি বহরমপুরে দু’টি বিষয়ে ভরসা করছে। প্রথমত, ‘মিডিয়া’র রিপোর্ট। দ্বিতীয়ত,‘ভোটের র্যা।ডিকালাইজড হওয়া।’ ধর্মের নামে বিভাজনের আশায় থাকা পদ্ম-শিবির ভোট কেটে তৃণমূলের সুবিধা করতে নেমেছে বহরমপুরে। লক্ষ্য—বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের সমঝোতাকে ঘিরে যে আশা তৈরি হয়েছে, তাকে ধাক্কা দেওয়া। আর বহরমপুরে ‘অধীরদা’কে হারিয়ে রাজ্যে তৃণমূলকে এবং জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি’কে উল্লসিত করা। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউটাউন ক্যাম্পাসের অঙ্কের অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনের বাড়ি ভরতপুরের গ্রামে। কয়েকদিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। বললেন,‘‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচন। বিজেপি ভোট কেটে কংগ্রেস-সিপিএম’কে বিপদে ফেলতে চাইছে। বোঝা যাচ্ছে। তবে মানুষ বোঝেন। শান্তিপ্রিয় মানুষই ঠিক করবেন কোন পথে যাবো আমরা।’’
সেই ‘মানুষ’ ভাঙনে বিধ্বস্ত, কাজের অভাবে বিপর্যস্ত। তাঁদের কোনও ধর্ম নেই শুধু সইতে পারা ছাড়া। বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের প্রচারে সেই মানুষের কথা। ভাঙন অথবা কাজের অভাব— কীভাবে তৃণমূল এবং বিজেপি সরকার মানুষকে ঠকিয়েছে, তাই প্রচারে তুলে ধরছেন বামফ্রন্ট, কংগ্রেসের কর্মীরা।
 

Comments :0

Login to leave a comment