চব্বিশ ঘণ্টা আগেই জামিনের আবেদনে সুপ্রিম কোর্ট তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করে বলেছিল- আপনি মন্ত্রী, লজ্জা করে না! অন্যদের সঙ্গে নিজের তুলনা করছেন কীভাবে?’ তারপরেও নিম্ন আদালতে বৃহস্পতিবার ফের নিজের জামিনের আবেদনে ভার্চুয়াল শুনানিতে অংশ নিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে যে কোনও শর্তে জামিন চাইলেন শিক্ষক নিয়োগকাণ্ডে ধৃত পার্থ চ্যাটার্জি।
তাঁর আইনজীবী আরও একধাপ এগিয়ে এদিন আদালতে জানায়-মন্ত্রী হিসেবে তাঁর মক্কেল এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। নিয়োগকাণ্ডে তাঁর কোনও ভূমিকাই ছিল না। যদিও এদিন বিচারভবনে সিবিআই পালটা সওয়ালে বলে-পার্থ চ্যাটার্জির মদতেই গোটা দুর্নীতি হয়েছে। নিয়োগকাণ্ডে ১৫২ জন যোগ্য চাকরিপ্রার্থীর নাম তালিকাভুক্তই করা হয়নি কিন্তু তার আগেই বিভিন্ন এজেন্ট মারফত টাকা তুলে ৭৫২ জন অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীর নামের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। আর এই তালিকা পার্থ চ্যাটার্জির নিজেই পাঠিয়েছিলেন। সেই তালিকায় নাম থাকা অযোগ্য ৭৫২ জনের মধ্যে ৩১০ জন অযোগ্যের চাকরি সুনিশ্চিত করা হয়। টাকার বিনিময়ে যোগ্যদের বঞ্চিত করে খোদ মন্ত্রী অযোগ্যদের চাকরি দিয়েছেন। এটা সামাজিক ভাবেও গুরুতর অপরাধ।
এর আগেও একাধিকবার পার্থ চ্যাটার্জির জামিনের আবেদনের বিরোধীতা করে সিবিআই আলিপুরে বিশেষ আদালতে বলেছিল, ‘তদন্তে একের পর এক তথ্য সামনে আসছে। পার্থ চ্যাটার্জি মন্ত্রী হিসাবে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত এই কেলেঙ্কারিতে। তাঁর নাকতলার বাড়িতে বসেই লিস্ট তৈরি করতেন প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি। নাকতলার বাড়িতে বসেই অযোগ্যদের নিয়োগের তালিকা তৈরি করা হতো। এরজন্য বাড়ির একতলায় একটি অফিস বানিয়েছিলেন প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী। সেখানেই সুবীরেশ ভট্টাচার্যকে ডেকে তালিকা দিতেন তিনি। মূলত যাদের কাছ থেকে টাকা তোলা হয়েছে জেলায় জেলায় বিভিন্ন এজেন্টদের মাধ্যমে তাঁদের নামের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হতো সুবীরেশ ভট্টাচার্যের কাছে। প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রীর নাকতলার বাড়িতে যেতেন নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত প্রসন্ন রায় ও প্রদীপ সিংহও। এটা এমন একটা মামলা যেখানে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয়েছে শিক্ষকতার চাকরি।
সুপ্রিম কোর্টে তীব্র ভর্ৎসনার পরেও এদিন পার্থ চ্যাটার্জি ভার্চুয়াল শুনানিতে অংশ নিয়ে যে কোনও মূল্যে নিজের জামিনের জন্য সওয়াল করেন। তিনি বিচারককে বলেন, ‘ আমাকে জামিন দিন। আমি কিছুই করিনি। যা করেছে বোর্ড করেছে। আমাকে বাঁচান। আমাকে জামিন দিন। ট্রায়াল শুরু হচ্ছে না। আর কতদিন আটকে থাকব?’ একইভাবে তাঁর হয়ে আইনজীবী বলেন-পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গে এই দুর্নীতির কোনও সম্পর্ক ছিল না। গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। নিয়োগকাণ্ডে জড়িত সংস্থা এস বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গেও পার্থের কোনও যোগাযোগ নেই।
যদিও বৃহস্পতিবার বিচার ভবনের বিশেষ সিবিআই আদালতে বিচারক কোন আদালতে কোন কোন বেঞ্চে মামলা শোনা হবে তা নিয়ে চলা জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে এরপর পার্থ চ্যাটার্জির আইনজীবীকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেন- বেঞ্চ নিয়ে ভাবছেন কেন? কোন আদালতে মামলা থাকবে, সেটা আপনি ঠিক করবেন না। এইসবে আপনি শুধু শুধু আদালতের সময় নষ্ট করছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবারও আদালতে সশরীরে হাজিরা দিলেন না ‘অসুস্থ’ সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু! ইডি’র হাতে ২০২৩ সালে মে মাসে গ্রেপ্তার হওয়া কালীঘাটের কাকু আপাতত জেল হেপাজতে। জেল থেকে জানানো হয়েছিল, ভার্চুয়াল মাধ্যমে শুনানিতে হাজির করানো হবে তাঁকে। আদালত জানিয়ে দেয়, সিবিআই যে হেতু তাঁকে হেপাজতে চাইছে, তাই সশরীরে আদালতে হাজির করাতে হবে তাঁকে। কিন্তু আদালতের নির্দেশের পরেও পরপর চারবার ‘অসুস্থতার’ কথা জানিয়ে হাজিরা দিলেন না কালীঘাটের কাকু।
কালীঘাটের কাকুকে নিজেদের হেপাজতে নিতে চেয়ে বিচার ভবনে আবেদন জানায় সিবিআই। সেই আবেদন মঞ্জুর করে আদালত। কালীঘাটের কাকুকে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও সিবিআই-র হাতে গ্রেপ্তার হতে পারেন, এই আশঙ্কায় আগাম জামিনের আবেদন জানিয়ে রেখেছে কলকাতা হাইকোর্টে। সিবিআই-র আইনজীবী জানান, হাই কোর্টের নির্দেশে এমন কিছু ছিল না, যেখানে বলা হয়েছে নিম্ন আদালতে মামলার শুনানি চলবে না। সেই কারণেই তারা নতুন করে ‘কাকু’র হাজিরার জন্য আবেদন করে।বিচার ভবনে সিবিআই-র বিশেষ আদালতের বিচারক জানান, উচ্চআদালতের এমন কোনও নির্দেশের কথা তাঁরও জানা ছিল না।গত বছরের ২২ আগস্ট থেকে প্রায় সাড়ে চার মাস ধরে কার্যত সরকারি আতিথেয়তায় এসএসকেএম হাসপাতালে ছিল কালীঘাটের কাকু। একাধিকবার আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও চার মাস ধরে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠতম এই ব্যক্তির সামান্য কন্ঠস্বরের নমুনা পর্যন্ত সংগ্রহ করে উঠতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কন্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করলেও তারপরে আর তদন্ত এগয়নি। সুজয় ভদ্রের ফোন ও বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ইডি’র হাতে বেশ কিছু ডিজিটাল এভিডেন্স এসেছিল। মোবাইলে মিলেছিল একাধিক অডিও ক্লিপ। সেখানে শাসক দলের এক শীর্ষ প্রভাবশালীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের ক্লিপ রয়েছে। কথোপকথন রয়েছে এক শীর্ষ প্রভাবশালীর সঙ্গেও। তার ভিত্তিতেই নিজেদের হেপাজতে নিয়ে কাকুকে জেরা করতে চাইছে সিবিআই! ইতিমধ্যেই নিয়োগকাণ্ডে চার্জশিটে ইডি কালীঘাটের কাকুর বিরুদ্ধে টাকার লেনদেনের সরাসরি অভিযোগ এনে ৭৫নম্বর পাতায় উল্লেখ করেছিল- সুজয় ভদ্র ‘সেই সময় অভিষেক ব্যানার্জির আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করতেন।’ সেই সময় অভিষেক ব্যানার্জি যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।
Partha Chatterjee
সিবিআই-র হাতে গ্রেপ্তারির আশঙ্কায় এবার ‘অসুস্থতা’র দাবি করে ফের আদালতে হাজিরা এড়াচ্ছে ‘কালীঘাটের কাকু’
×
Comments :0