চেকমুড়ি-তৃণমূলের পাঁঠা
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশ হয়ে যায় ‘চেকমুড়ি রহস্য।’ ১৭এপ্রিল, শনিবার, সাংবাদিক সম্মেলন করে তা ফাঁস করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেব। তৃণমূল অসংখ্য পোড়া, নষ্ট, ফেলে দেওয়া বিলের সন্ধান মেলে। অভিযোগ ওঠে রহস্যময় উৎস থেকে তৃণমূলকে টাকা দেওয়া হয়েছে। যা প্রকাশ করা যায় না বলেই তার বদলে বিল কেটে তা নষ্ট করা হয়েছে। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে হারাতে প্রচুর বেআইনি টাকা সংগ্রহ করেছিল মমতা ব্যানার্জির দল। এই অভিযোগের কোনও জবাব তৃণমূল দিতে পারেনি।
মমতা ব্যানার্জি ২০১১-র ১৯ এপ্রিল খড়দহে বলেছিলেন,‘‘আমরা যদি আমাদের কুপন পোড়াই তাতে কার কী? আমাদের পাঁঠা ল্যাজে কাটবো না মাথায় কাটবো, তাতে কার কী বলার আছে?’’ ১৮এপ্রিল নলহাটিতে বলেন,‘‘মুম্বাই, চেন্নাই থেকে বহু লোক টাকা দিতে দিতে চেয়েছিল।’’ কারা সেই ‘বহু লোক’ সেদিনও মমতা ব্যানার্জি গোপন রেখেছিলেন।
সারদা-‘যা গেছে তা গেছে’
সারদা কেলেঙ্কারিতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাজার লুট হলো। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো। ১৪০ জনের বেশি এজেন্ট, আমানতকারী আত্মঘাতী হলেন। কয়েক লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হলেন। মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘যা গেছে তা গেছে।’ ‘চিট ফান্ডের টাকা ফেরত দাও’ — তৃণমূল কংগ্রেস একবারও বলতে পারেনি। কারণ— সে কথা বললেই টাকা ফেরত দিতে বললেই মমতা ব্যানার্জির ছবি বিক্রি করে পাওয়া ২ কোটি টাকা ফেরতের প্রশ্ন চলে আসবে। পরবর্তীকালে জানা গেছে, সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের যোগাযোগ শুরু ২০০৯-এ। প্রবল বিক্ষোভের মুখে ২০১৩-র ২৩ এপ্রিল সারদাকাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী শ্যামল সেন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ২৪ এপ্রিল গেজেট নোটিফিকেশন জারি হয়। সুপ্রিম কোর্ট সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের রায় দিয়েছিল ২০১৪ সালের ৯ মে। রাজ্য সরকারের শ্যামল সেন কমিশনের কাজ বন্ধ করে দেয় ২০১৪ –র ২২ অক্টোবরে। কমিশনের রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি।
২কোটি টাকার পতাকা!
পাঞ্জাবে লোকসভা ভোটের আগে পতাকা কিনতে নাকি তৃণমূল কংগ্রেস খরচ হয়েছিল ২কোটি টাকা! তাও আবার ২০১৩-১৪’ সালে। ২কোটি টাকার পতাকা কেনা হয়েছে, তা যদি বিশ্বাসযোগ্যও হয় তাহলে সেই হিসাব সংশ্লিষ্ট বছরে তৃণমূলের আয় ব্যয়ের রিপোর্টে ছিল না। বিস্মিত আয়কর দপ্তরও। আরও আছে। ২০১২-র ৭ ফেব্রুয়ারি হরিয়ানার পাঁচকুলায় একটি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা হয় ‘সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস’র নামে। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি— ১৩দিনের মধ্যে কয়েক দফায় ওই অ্যাকাউন্টে নগদে ৮৮লক্ষ ৪৪হাজার টাকা জমা পড়ে। কে সেই টাকা জমা দিল? হরিয়ানায় তৃণমূল কংগ্রেস ছিল? যদি থাকে তবে তৃণমূলের কতজন কর্মী কিংবা সমর্থক দলীয় তহবিলে এই টাকা জমা দিল? এর চেয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছিল— ফেব্রুয়ারিতে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জমা নেওয়া হলে ২০১১-১২’র সালের আয় ব্যয়ের রিপোর্ট সেই অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব থাকল না কেন?
‘আগে জানলে প্রার্থী করতাম না’
তারপর নারদ স্টিং অপারেশন। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের মন্ত্রীরা, সাংসদরা ঘুষের টাকা নিচ্ছেন— দেখলো দেশ। ২০১৬- বিধানসভা নির্বাচনের আগে উত্তর কলকাতায় দলীয় সমাবেশে মমতা ব্যানার্জি বললেন,‘‘আগে জানলে প্রার্থী করতাম না এদের।’’ ইঙ্গিত সেবার বিধানসভায় প্রার্থী হওয়া ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখার্জি, শুভেন্দু অধিকারী, থেকে শোভন চ্যাটার্জিদের দিকে। ভোটের ফল বেরোনোর পর শুধু তাঁদের মন্ত্রীই করেননি বরং স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ঘরে বসে ঘুষের টাকা নিয়ে আলোচনা করা ফিরহাদ হাকিমকে কলকাতার মেয়রের চেয়ারে বসিয়েছিলেন। দলের বারোজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদের বিরুদ্ধে সিবিআই এবং ইডি’র এফআইআর। তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও ব্যবস্থা। নাহ্।
তোলাবাজি বন্ডের নামে:
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সবথেকে বেশি টাকা রাজনৈতিক দলগুলিকে ঘুষ হিসাবে দেওয়া প্রথম ১০টি সংস্থার কাছ থেকে বিজেপি’র ঘরে ঢোকে ২১২৩ কোটি টাকা। তারপরেই তৃণমূল। নির্বাচনী বন্ডের সবথেকে বড় দশটটি ক্রেতার কাছ মমতা ব্যানার্জির দলের তহবিলে ঢোকে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা! বিজেপি’র পরে গোটা দেশে কর্পোরেটের সবথেকে পছন্দের দল এখন শাসক তৃণমূল! ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন সাত দফার ভোট পর্বে ১৬ এপ্রিল থেকে ২২মে পর্যন্ত তৃণমূল ৫১কোটি ৬০ লক্ষ টাকার নির্বাচনী বন্ড ভাঙিয়েছিল!
পশ্চিমবঙ্গ সহ তিন রাজ্যে রমরমা কারবার চালানো ডিয়ার লটারির ‘সোল ডিস্ট্রিবিউটার’ লটারির ‘কিংপিন’ হিসাবে পরিচিত স্যান্টিয়াগো মার্টিনের ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক এই সংস্থার সবথেকে বেশি টাকা ঢুকেছে শাসক তৃণমূলের তহবিলে যা বারবার বিরোধীদের আনার অভিযোগকে স্পষ্ট করেছে। ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড’ সংস্থাটি গোটা দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি টাকার বন্ড কিনেছিল। পরিমাণ ১৩৬৮ কোটি টাকা। সেই টাকার প্রায় ৪০ শতাংশ, ৫৪২ কোটি টাকা একাই পেয়েছে মমতা ব্যানার্জির দল। এই সংস্থার মাধ্যমে বিজেপি’র তহবিলে ঢোকে ১০০ কোটি টাকা। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলায় ডিয়ার লটারিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। সেই সংস্থাই কোটি কোটি টাকা বন্ডের মাধ্যমে দিচ্ছে ‘মা-মাটি-মানুষ’র সরকারকে। ঘনিষ্ঠতা এতটাই যে ডিয়ার লটারির কারবারিরা বিজেপি-কে ছেড়েও গোটা দেশে সবথেকে বেশি টাকা দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির দলকে।
নির্বাচনী বন্ডের প্রকাশিত তালিকায় দেখা গেছে একাধিক সংস্থার ঠিকানা ক্যামাক স্ট্রিট থেকে হেয়ার স্ট্রিটের। আরওসি— কলকাতাতেই সংস্থাগুলো নথিভুক্ত। যেমন কেভেন্টার্স গ্রুপ অব কোম্পানির একাধিক সংস্থা। কোভেন্টার ফুডপার্ক ইনফ্রা প্রাইভেট লিমিটেড, মদনলাল লিমিটেড- এমকেজে এন্টারপ্রাইজ। তিনটি সংস্থার ঠিকানা একই- কলকাতার ক্লাইভ ঘাট স্ট্রিট। বিপুল টাকার বন্ড কিনেছে, বিজেপি সর্বাধিক সুবিধাভোগী, পাশাপাশি তৃণমূলও পেয়েছিল প্রায় ৪৮ কোটি টাকা। আবার আরপিজি গ্রুপের লর্ড সিনহা রোডের ঠিকানায় হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড নামক সংস্থাটি মোট ৩৭৭কোটি টাকা বন্ড কিনেছিল। তার মধ্য শুধূ তৃণমূলই পেয়েছে ২৮১ কোটি টাকা! আইএফবি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড শুধু তৃণমূলকেই দিয়েছে ৪২কোটি টাকা। এই সংস্থাই সবার আগে সামনে এনেছিল কীভাবে তোলবাজি করেই নির্বাচনী বন্ড কিনতে বাধ্য করা হয়। কয়েক বছর আগে স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল যে— ব্যবসার পথ মসৃণ রাখতেই রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে চাঁদা দেবে তারা। অভিষেক ব্যানার্জির লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ডহারবারে এদের কারখানায় নির্বিচারে ভাঙচুর, হামলা চালিয়েছিল তৃণমূলের বাহিনী।
-----------------------------------
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের শেষদিন ছিল ১৬ মে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দিয়েছিলেন মথুরাপুরে, দমদমে। তিনি বলেছিলেন,‘‘মোদী সরকার শপথ নেওয়ার পরই দুর্নীতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করা, শাস্তি দেওয়ার কাজ শুরু হবে। আমাদের সরকার হলে দুর্নীতিগ্রস্তরা জেলে যাবে।’’
কী হয়েছে? নারদ স্টিং অপারেশনে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী হয়েছেন রাজ্যে বিজেপি’র প্রধান নেতা। অর্জুন সিংয়ের মতো অনেক নেতাই তৃণমূল বিজেপি’র মধ্যে ঘনঘন যাতায়াত করেছেন।
রেগায় ডাকাতি:
রাজ্যে গত ১২ বছরে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে। ভুয়ো মাস্টার রোল দেখিয়ে, ভুয়ো জবকার্ডের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা চুরি করেছে তৃণমূল। বিজেপি’র পঞ্চায়েতগুলিতেও একই কাণ্ড হয়েছে।
রেশনে চুরি:
রেশনের চাল, গম চুরি করে বিক্রি করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালু। যুক্ত শেখ শাহজাহানের মতো তৃণমূলের আরও নেতারা। রাজ্যের রেশন ব্যবস্থার অডিট হয়নি ৬ বছর। সেই সময়ে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ছিলেন রাজ্যের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী। ওই ৬ বছরে রেশনের জন্য রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার খরচ হয়েছে। কিন্তু তার কোনও হিসাব নিকাশই হয়নি।
নিয়োগ দুর্নীতি: চাকরি দেওয়ার নাম করে দেদার ঘুষ তুলেছে তৃণমূলের নেতারা। এমনকি যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে অন্যকে চাকরি দিয়ে টাকা নিয়েছে তৃণমূল। সেই অভিযোগে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি জেলে।
Comments :0