মণিপুর বিধানসভা, যার মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত ছিল, তাকে জিইয়ে রেখেই সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। এর মাধ্যমে বিজেপি’র জন্য সেখানে আবার সরকার গড়ার চেষ্টা চালাবার সুযোগ রেখে দেওয়া হল। রাজ্যের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং অবেশেষে পদত্যাগ করেছেন, ২১ মাসের দাঙ্গায় প্রায় ৩০০ মানুষের মৃত্যু, ৬০ হাজার মানুষের বাড়ী-সম্পত্তি ধ্বংস হওয়ার পর।
২০১৪ সালে দিল্লিতে মোদি’র নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই, সব রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি’র স্লোগান ডবল ইঞ্জিনের সরকার। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য দুই সরকারেই বিজেপি থাকলে নাকি রাজ্যের উন্নয়ন হবে দারুণ এবং আসবে সুস্থিতি ও সুশাসন। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি মণিপুরে ক্ষমতায় আসে, যদিও নির্বাচনে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিজেপি ওই নির্বাচনে ৬০টি আসনের মধ্যে ২১টি আসন পেয়েছিল। বিজেপি এরপর অন্যান্য ছোট দল এবং নির্দল প্রার্থীদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। ২০২২ সালের নির্বাচনে, বিজেপি মণিপুর বিধানসভায় ৬০টি আসনের মধ্যে ৩২টি আসন জয়লাভ করে এবং রাজ্যের সরকার গড়ে। এরপর থেকেই মণিপুর হয়ে ওঠে জাতিদাঙ্গায় অগ্নিগর্ভ। কুকি বনাম মেইতেই এই দুই জনগোষ্ঠীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই দাঙ্গায় মদত দেন। প্রায় ৩০০ মানুষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই ভাতৃঘাতী দাঙ্গায় নিহত হয়েছে।
২০২৩ সালের মে মাসে মেইতে ও কুকি বিরোধ ভয়াবহ দাঙ্গায় পরিণত হয়। এই সংঘর্ষের মূল কারণ ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, এবং সামাজিক বিভিন্ন নানা টানাপোড়েন, যাকে ব্যবহার করে আরএসএস ও বিজেপি। মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের জন্য বিশেষ আর্থিক সুবিধা এবং চাকরি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল, যার ফলে কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছিল। বিভিন্ন জাতিগত এবং সামাজিক বিষয়ে এই উত্তেজনা প্রকট হয়ে ওঠে। কুকিদের জমির অধিকার রক্কার প্রশ্নটি এর ফলে ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কারণ কুকি অধ্যুষিত এলাকায় মেইতেই ও অন্যান্যদের জমি কেনার অধিকার নেই। মেইতেইদের অধিকাংশ বাসস্থান শহরাঞ্চলে, আর কুকি সম্প্রদায় প্রধানত পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে। বীরেন সিং-এর সরকার সরাসরি মেইতেইদের ইন্ধন দিতে থাকে, যা কুকিদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক তৈরি করে এবং তা ক্রমশ জাতিগত সংঘর্ষের দিকে চলে যায়। দীর্ঘ ২১ মাস ধরে চলা এই দাঙ্গায় বহু মানুষ আহত নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। অসংখ্য মানুষ নিরাপত্তার কারণে এবং গৃহহীন হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। মণিপুর যখন দাঙ্গার আগুনে পুড়ছে, সে সময়ে বারবার দাবি ওঠা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী একবারের জন্যও সেখানে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাই অনুভাব করেননি।
রাষ্ট্রপতি শাসন আরোপ করা হয়েছে মনিপুরের মানুষের স্বার্থে নয়, বরং শাসক জোটের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ মেটানোর জন্য সময় নিতে। যিনি সবসময় বিজেপি-আরএসএস দ্বারা পরিচালিত মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে কারণ তার পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ভূমিকা আদালতের নজরে ছিল, যেখানে তার পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছিল। এই কারণেই তাঁকে পদত্যাগ করাতে বাধ্য হয়েছে মোদি-শাহ সরকার।
রাষ্ট্রপতির শাসন কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। তবে এখন কেন্দ্রীয় সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। অবিলম্বে সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা শুরু করতে হবে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে, যাতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি, শান্তি ও সমঝোতা ফিরিয়ে আনা যায়, রাজ্যের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করা যায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন করা যায়।
Manipur
ফেল ডবল ইঞ্জিন
![](https://ganashakti-new-website.s3.ap-south-1.amazonaws.com/24165/67b0655e1d284_Editorial.jpg)
×
Comments :0