অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
একটানা কাশি থেকে মুক্তি পেয়ে শেষপর্যন্ত গত শুক্রবার গ্রামের বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন অনোয়ার শেখ। গত এক বছর ধরে শ্বাসকষ্টের জেরে জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল বীরভূম নানুরের বালিজুড়ির বাসিন্দা অনোয়ার শেখের। নিত্যদিনের গলার কষ্টের জেরে কোথায় না কোথায় গেছেন! বীরভূম জেলার নানান হাসপাতাল থেকে দক্ষিণ ভারতের হাসপাতাল পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন। সুরাহা হয়নি। ইদানীং সমস্যাটা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। উপায় না থাকায় শেষে কলকাতার নীলরতন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর এখানেই রেসপিরেটরি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ জয়দীপ দেবের হাতে ফিরে পেলেন নতুন জীবন।
পাঁচ বছর ধরে কফ-সর্দি-কাশিতে ভুগেই চলছিলেন এই রোগী। মাঝে মধ্যে আসতো ধুম জ্বর। গত বছর থেকে ফের আবার শুরু মারাত্মক শ্বাসকষ্ট। জ্বর-কাশি থেকে মুক্তি পেতে কম দৌড়াদৌড়ি করেননি নানুরের বাসিন্দা। নানুর হাসপাতাল থেকে ঘোরা শুরু। বোলপুর হাসপাতাল, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ঘোরার পরেও উপসম না হওয়ায় টাকা-কড়ি জোগাড় করে সোজা বেঙ্গালুরুর সাইবাবা হাসপাতাল। সেখানেও চিকিৎসকরা দেখাতে পারেননি কোন দিশা।
ফলে শেষ আশা বৈদেহী হাসপাতাল। সেখানে দিন কতক থেকে কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় চূড়ান্ত হতাশা নিয়ে বাবা অনোয়ার শেখকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন ছেলে শেখ শান্ত। বাড়িতে ফিরে ফের শ্বাসকষ্টের উপদ্রব। অগত্যা জীবন বাঁচাতেই ফের ছেলের হাত ধরে কলকাতায় আসা। দূর সম্পর্কিত আত্মীয়ের সুপারিশে ভর্তি হওয়া শিয়ালদহের এনআরএস হাসপাতালে। ভর্তি হওয়ার পর রোগীর ঘনঘন কাশি আর শ্বাসকষ্ট কেন হচ্ছে বুঝতে চিকিৎসকরা সিটি স্ক্যান করেন। ফুসফুসের সঙ্গে শ্বাসনালি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতেই দেখা যায় শ্বাসনালি দুই ফুসফুসে ভাগ হয়ে যাওয়ার ঠিক মুখে আটকে আছে দুটি নকল দাঁত।
এরপর রোগীকে প্রশ্ন করতেই জানা যায় নকল দাঁতের রহস্য। জানা যায়, ২০১৯ সালে অনোয়ার শেখ তাঁর একটা বাঁধানো দাঁত হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেই দাঁতটি যে আখেড়ে খাবারের সঙ্গে শ্বাসনালিতে (ব্রঙ্কাস) আটকে গেছে, তা রোগী বুঝতেই পারেননি। এদিকে দাঁত না থাকায় অসুবিধা। ফের তিনি ২০২৩ সালে আরেকটি দাঁত বাঁধান। সেটিও একদিন মনের ভুলে জলের সঙ্গে চলে যায় পেটে। পরে জানা গেল সেটাও আটকেছে শ্বাসনালির বিভক্ত অংশে। একটি আগেই আটকে ছিল ডান ব্রঙ্কাসে। পরেরটি বাম ব্রঙ্কাসে।
পরের দাঁতটি আটকে যাওয়ার জন্যই রোগীর সমস্যা আরও বেড়ে যায়। শুরু হয় প্রবল কাশি। লাগাতার কাফ সিরাপ খেয়েছেন, কাজ হয়নি। মাঝেমধ্যে কাশি জোরদার হতে হতে দমবন্ধ হয়ে আসতো। তখনই ছেলের হাত ধরে প্রৌঢ়ের দৌঁড়ানো শুরু হাসপাতালে। এনআরএস হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ জয়দীপ দেব জানিয়েছেন, নকল দাঁত আটকে থাকার জেরেই যে সমস্যা তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কী উপায়ে অস্ত্রোপচার করে তা বের করা হবে তা নিয়ে একটু সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। হাসপাতালে এই নিয়ে চলেছে বিস্তর আলোচনা। চিকিৎসকেরা অনেকে মত দিয়েছিলেন রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার করার। আবার কারো মত ছিল, রিজিড ব্রঙ্কোস্কোপি করার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার কোনোটাই করতে হয়নি।
জালের মতো দেখতে ডরমিয়া বাসকেট আর ফরেন বডি রিমুভাল ফরশেপ ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার দরকার পড়েনি। সাময়িক অবশ করে ৪৫ মিনিটের চেষ্টায় ফাইবার অপটিক ব্রঙ্কোস্কোপি পদ্ধতিতে বছরের পর বছর আটকে থাকা দাঁত বের করে আনা হয়েছে। ডাঃ সুকান্ত কোদালির নেতৃত্বে এই বিরল অস্ত্রোপচারটি হয়। ওই দলে ছিলেন চিকিৎসক শাশ্বত ঘোষ, সৌরিন বন্দ্যোপাধ্যায়, তন্ময় সরকার এবং চোপেল ভুটিয়া।
চিকিৎসকদের মতে, শ্বাসনালিতে কিছু আটকে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে অ্যাস্পিক্সিয়া। শ্বাসনালি একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক অক্সিজেনের অভাবে পড়ে। ফলে তা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। অবস্থা ধীরে ধীরে সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। আশার কথা এই রোগীর তেমন কিছু হয়নি। তবে ওই দাঁত যদি সময়মতো বের না করা যেতো তাহলে রোগীর প্রাণ সংশয় ঘটতে পারতো। অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছেন আনোয়ার শেখ।
Comments :0