স্বাধীনতার পর সাড়ে সাত দশক কেটে গেলেও এবং নিজেদের আধুনিক সভ্য সমাজের অংশ মনে করলেও ভারতের বুক থেকে অসভ্য-বর্বরতার যুগের নিদর্শন মুছে ফেলা যায়নি। শাসকরা নিজেদের সভ্য, উদার ও মানবিক বলে দাবি করলেও মানসিকতায় ও বোধে থেকে গেছে সেই বর্বর যুগে। যদি তা না হতো তাহলে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসে দেখতে হতো না মানুষ অন্য মানুষের মলমূত্র বহন করে। পেটের দায়ে জীবন বিপন্ন করে কাজ করতে নামে সেপটি ট্যাঙ্কে বা ম্যানহোলের মাধ্যমে গভীর নর্দমায়। আর একাজ করতে গিয়ে প্রতিবছরই মৃত্যু হয় বেশ কয়েক শত দরিদ্র মানুষের। এই শ্রমজীবী মানুষগুলির নিরাপত্তার দায় কোনও সরকার নেয় না, তাদের মৃত্যুতে সরকারের বিবেক দংশন হয় না। অথচ মানুষকে দিয়ে একাজ না করানোর আইন আছে। আছে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক কড়া নির্দেশ। কিন্তু কেউ শোনে না, পাত্তাও দেয় না। এধরনের কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি পরিসরেই হয়ে থাকে। ফলে সরকারি কর্তৃপক্ষই আইন ভঙ্গকারী, আদালতের নির্দেশ অমান্যকারী। এরপরও দাবি করা হয় এদেশে আইনের শাসন আছে। নরেন্দ্র মোদীর এসবকে সঙ্গী করেই উন্নত ভারতের দিবাস্বপ্ন দেখান।
ছ’মাস আগে সংসদে দাঁড়িয়ে মোদীর মন্ত্রী দাবি করেছিলেন দেশে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ মানুষকে দিয়ে মলমূত্র বহন করানো হয় না, ম্যানহোলে নেমে নর্দমা পরিষ্কার করানো হয়। অথচ সেই মন্ত্রীই জানান মোদীর দ্বিতীয় জমানার প্রথম চার বছরে এই কাজ করতে গিয়ে ৩৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর দু’দিন আগে কলকাতায় ম্যানহোলে নেমে প্রাণ হারিয়েছেন তিন জন শ্রমিক। এই ঘটনা পরম্পরা থেকে পরিষ্কার আইন-কানুন, আদালতের নির্দেশ কাগজে কলমে থাকে। সরকার মন ভোলানো, মনজোগানো মিথ্যে কথা বলে। বাস্তবে যা হবার তাই হয়ে থাকে। বছর চারেক আগে টালিগঞ্জের কাছে কুঁদঘাটে এইভাবে গভীর নর্দমায় কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছিল চার জন শ্রমিককে।
আইন অনুযায়ী এধরনের কাজে সরাসরি শ্রমিকদের নিয়োগ করা নিষিদ্ধ। বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি কাজ করাতেই হয় তাহলে আগে ভেতরে বিষাক্ত ক্ষতিকর গ্যাস আছে কিনা যাচাই করতে হবে। সর্বাঙ্গে বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হবে। অক্সিজেন রাখতে হবে। অর্থাৎ নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব যে কিছুই করা হয় না, শ্রমিকদের যে সরাসরি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয় চার বছরের ব্যবধানে কলকাতায় দু’টি ঘটনায় মোট সাত জনের মৃত্যুই তার প্রমাণ। কুঁদঘাটের ঘটনার পর সরকারি তরফে অনেক অঙ্গীকার করা হয়েছে। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এবার বানতলার ঘটনায় বোঝা গেল আইন-আদালত উভয়কেই বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। মন্ত্রী নির্বোধের মতো বললেন শ্রমিকরা নাকি নিজেরাই কথা শোনে না। কাজটা সরকারের। করাচ্ছে ঠিকাদার। সরকারের যদি নির্দেশ থাকে নিরাপত্তা ছাড়া কোনও শ্রমিক কাজ করে কি করে? আসলে দায় এড়াবার বাহানা। মন্ত্রী ঘোষণা করলেন মাথাপিছু দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ। তিনি সম্ভবত খোঁজ রাখেন না সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবার। আমাদের দুর্ভাগ্য এরাই দেশের শাসক।
Editorial
শুধু অমানুষিক নয়, অমানবিকও
×
Comments :0