Jana Gana Mana

৫০ পেরিয়ে জনগণমন

ফিচার পাতা

Jana Gana Mana

ড. সায়ন্তন মজুমদার
 

বৈশাখ মানেই সত্যজিৎ, বৈশাখ মানেই রবীন্দ্রনাথ। আর এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়ে তাঁরা দু’জনেই ধরা দিয়েছেন। সূত্রটি হলো রবিরচিত জাতীয় সঙ্গীতকে বিষয় করে লেখা একটি বই।

এখন আজাদির অমৃত মহোৎসবকে কেন্দ্র করে চারিদিকে এই পঁচাত্তরের রমরমার মধ্যে হঠাৎ পঞ্চাশের কথা কেন? এর মধ্যে আবার জাতীয় সঙ্গীতের অবতারণারই বা কারণ কী? কারণটি হলো, এই বছর জাতীয় সঙ্গীত রচনা কাহিনির নাট্যধর্মী বিচিত্র আলেখ্যগ্রন্থ ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ প্রকাশের সুবর্ণ জয়ন্তীবর্ষ অতিক্রান্ত হলো। রবীন্দ্রনাথের অনুলেখক বা রবি লিপিকর সুধীরচন্দ্র কর (১৯০৬-৭৭) স্বতন্ত্রতার রজতজয়ন্তী বর্ষে এই অর্ঘ্য দিয়েছিলেন। একাধারে তিনি ‘গীতবিতান’ এর সূচি নির্মাতা, রবীন্দ্রকেন্দ্রিক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবি-কথা’, ‘জনগণের রবীন্দ্রনাথ’, ‘চিত্রভানু’ কাব্যের রচয়িতা। ৭৩ বছর আগে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে সুধীরচন্দ্র ফাটকগ্রস্ত হলে বিশ্বরবি পড়ে যান সঙ্কটে— ‘আমার বই ছাপানো সম্প্রতি লবণাশ্রু জলে পরিপ্লাবিত’।

১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বোলপুর থেকেই অস্কারজয়ী সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদশোভিত হয়ে চারশোরও বেশি পৃষ্ঠাব্যাপী এই মহানাট্য প্রকাশিত হয়। ১৯৪৯ থেকে এই নাটক রচনার সূত্রপাত, ইতি টানতে সময় লেগেছে তেইশ বছর। গ্রন্থকার প্রণামপূর্বক বইটি উৎসর্গ করেছেন ‘ভারতের মহাজাতীয় উদ্বোধনের সেই আমাদের পুরোহিতবৃন্দকে’। শব্দগুলি রবীন্দ্রনাথের ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধ থেতে উদ্ধৃত হয়েছিল। প্রথমেই রয়েছে দুটি আশীর্বাদী পত্র। প্রথমজন কবিপুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। পত্রে গ্রন্থটি সম্পর্কে তিনি ‘মহৎ’ বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন। দ্বিতীয়জন হলেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। ভূমিকা লিখেছেন আশ্রমিক তথা বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুধীরঞ্জন দাস। গ্রন্থের আদি পরিকল্পনার একটি খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫০-এর শেষে ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায়। তার কিছুটা পরিমার্জিত রূপ ১৯৬৩ সালে বিশ্বভারতীর আচার্য এবং দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর হাতে তুলে দেওয়া হয় শান্তিনিকেতনে।  ‘জনগণের রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এই মহাগ্রন্থের ক্ষুদ্রকায়া খসড়াটি প্রশংসিতও হয়েছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা (১৭/১/১৯৬৫) লিখেছিল—‘সামাজিক তাৎপর্যের ভিত্তিতে রবীন্দ্র-সমালোচনায় এই তথ্যালেখ্যর গুরুত্ব অসামান্য হয়ে রইল।’

‘ভারতবিধাতা’ নামক কবিতাটির প্রথম স্তবক যা আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতরূপে পরিগণিত হয়েছিল তা লেখা হয়েছিল ১৯১১ সালে। এই জাতীয় সঙ্গীত রচনার ইতিহাসকে ভিত্তি করেই সুধীরচন্দ্র এই ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছিলেন। এর গান ও সংলাপ রচনা কিন্তু তিনি করেননি, সমগ্র গ্রন্থটির ভাষ্য রচিত হয়েছে ১৯১১ সাল পর্যন্ত রচিত রবীন্দ্ররচনার উদ্ধৃতি দিয়ে। চন্দ্র যেমন রবিজ্যোতিকেই প্রতিফলিত করে তেমনই সুধীরচন্দ্র ভানুসিংহের রচনার সার্থক ও সুপ্রযুক্ত গ্রন্থনা করেছিলেন যা তৎকালের পাশাপাশি বর্তমানের নিরিখে এক অভূতপূর্ব প্রয়াস। সেইসঙ্গে দুঃসাহসিকও বটে কারণ তখনও রবীন্দ্ররচনা গ্রন্থস্বত্বমুক্ত হয়নি। তবে এক্ষেত্রে উপাচার্য তথা ভূমিকাকারের সহায়ক ভূমিকা থাকতে পারে। নাট্যঘটনার বৃত্তে দেশের ইতিহাস, স্বদেশী আন্দোলন, স্বদেশী সঙ্গীতকার রবীন্দ্রনাথ, পরাধীন দেশে জনগণমনের প্রথম পরিবেশনা, স্বাধীন দেশে তাঁর স্বীকৃতি, ভারতভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রভূমিকা ইত্যাদি বিষয়গুলি উঠে এসেছে। ছন্দোগুরু প্রবোধচন্দ্র সেন তাই যথার্থই বলেছেন, ‘সুধীরচন্দ্র গঙ্গাজলেই গঙ্গাপূজা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উক্তি দিয়েই রবীন্দ্র-চরিত্র-চিত্রণে তিনি ব্রতী হয়েছেন। নাট্য-প্রয়োজনেও কবির মুখে নিজের উক্তি বসাবার সহজ পথ তিনি সন্তর্পণে পরিহার করেছেন। এই গ্রন্থের কবি-চরিত্র বস্তুত কবিরই স্বকৃত বাণীময়-আত্মচিত্র।’ গ্রন্থের ‘দিক্-স্পন্দন’ পর্বটি প্রবোধচন্দ্রকৃত। নাট্যরীতিতে রবিলিপিকর অনুসরণ করেছেন রবিনাট্য ‘চিরকুমার সভা’, ‘মালঞ্চ’ নাটককে। এমনকি লেখক গ্রন্থভূমিকার অন্তিমাংশের ইতি করেছেন রবীন্দ্রপত্রের দীর্ঘ উদ্ধৃতির মাধ্যমে। সপ্তকাণ্ড রামায়ণের মতো মহাকাব্যোপম এই নাটকেরও সপ্ত পর্ব। প্রথম পর্ব ‘মুক্তি- ক্রন্দন’-এর সূচনায় ‘সুকঠিন-পীড়ন’ নামপূর্বক ১৮৫৫ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্য পর্বে সংঘটিত সাঁওতাল-সিপাহী বিদ্রোহ, ন্যাশনাল মেলা, কলকাতার গুপ্তসভা ইত্যাদি পর্ব উদ্ভাসিত হয়েছে রবীন্দ্রবয়ানে। বীরভূমবাসী লেখক স্বদেশমোহে নাট্যারম্ভ করেছেন এই জেলারই মাধ্যমে। নাট্যনির্দেশে ব্যবহৃত হয়েছে নেপথ্য পাঠ, মূকাভিনয়, ক্রুদ্ধ স্বর বা ব্যঙ্গ স্বরে পাঠ, প্রতিকৃতি প্রদর্শন পদ্ধতি। এটিই নাটকের ক্ষুদ্রতম পর্ব।

দ্বিতীয় পর্ব ‘রাখী-বন্ধন’-এর ভূমিকায় রাখীসঙ্গীত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ ব্যবহৃত হয়েছে। ষোলোটি দৃশ্যের অধিকাংশ স্থান কলকাতায়, দুটি দৃশ্যান্তর রয়েছে ঘোষপাড়া ও ঘোষপুরে। এ পর্ব থেকে পঞ্চম পর্ব পর্যন্ত উপস্থিত রয়েছেন বিশ্বকবি, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অরবিন্দ ঘোষ, বিশ্ববান্ধব নামে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বাঁড়ুজ্যে নামে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতকার মুকুন্দ দাস, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, ভগিনী নিবেদিতা, ফরিদা-তমিজ-ফরু, লর্ড কার্জন সহ মিশনারি-সার্জেন্ট-পুলিশ-চাষি-বস্তিবাসিনী-উদ্বাস্তু নারীশিশু-মহাজন-নাপিত-জেলে-শ্রমিক-মেথর-জেলার-ম্যাজিস্ট্রেট- গ্রামবাসী-গুপ্তচর-দারোয়ানরা। এই পাঁচ পর্বের কালসীমা ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত। একাধিক দৃশ্যান্তর সহ ১৩টি দৃশ্যে বিভক্ত ‘মাল্য-চন্দন’ পর্বটিতে রয়েছে স্বদেশীদের কার্যকলাপ। চতুর্থ পর্ব হল ১১টি দৃশ্য সংবলিত ‘জয়-স্যন্দন’। এর মূল ঘটনা বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার। পঞ্চম পর্ব একটি মাত্র দৃশ্যের ‘অভিবন্দন’-এ রয়েছে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম পরিবেশিত সম্পূর্ণ জাতীয় সঙ্গীতটি। গ্রন্থে একমাত্র ষষ্ঠ পর্ব ‘দিক-স্পন্দন’-কেই ‘তথ্যচিত্র’-রূপে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকিগুলি উল্লিখিত নাট্যরূপে। উপজীব্য হলো স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাজধানী দিল্লিতে জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতিপ্রাপ্তি।

স্বাধীনতার উত্তরকালীন অন্তিম পর্ব ‘মর্ত্য-নন্দন’ অংশটি দ্বিবিভক্ত— লোকমাতা ও ভুখা ভগবান। এটিই দীর্ঘতম পর্ব। প্রারম্ভিক নিবেদন-সহ লোকমাতার ১৯টি দৃশ্য ও ভুখা ভগবানের সাতটি দৃশ্য রয়েছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটকে কেন্দ্র করে রাজাপ্রজার সংঘাত সত্ত্বেও ‘রাজার সনে’ প্রজার আনন্দলোকে সম্মিলনের কাহিনি রয়েছে। এই কাহিনি রূপকাশ্রিত। এর স্থানকাল প্রতিস্থাপিত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম গণতান্ত্রিক বৃজি ও বিদর্ভ রাজ্যে। পাত্রপাত্রী হলেন বৈশালীরাজ, বিদর্ভরাজ সহ অমাত্যবর্গ, বৈশালী রাজকন্যা তথা বিদর্ভমহিষী ঐন্দ্রিলা, মহাজন, বিদর্ভের কৃষক কুঞ্জলাল, তাঁর ভগিনী চন্দ্রা, কুঞ্জস্ত্রী মানদা, উদাসীন খ্যাপাচাঁদ, অনাথ হারু সহ জনতা, গ্রামবাসী, নর্তকীদল। এই পর্বের ঘটনায় শ্রীনিকেতনের ব্রতীদলের ছায়া ও ‘দীনদান’-‘নগর লক্ষ্মী’ নামক রবিপদ্যদ্বয়ের প্রভাব রয়েছে। ঐক্যসূত্রে বেঁধে বেঁধে থেকে দেশের সর্বাত্মক উন্নতির মূলমন্ত্র নিহিত রয়েছে এখানে—ভাবী ভারতের কাম্যরূপ ভাস্বর হয়ে উঠেছে। রচয়িতার মতে, ‘এটিকে সমাজ পরিকল্পনায় রবীন্দ্রনাথের বাণীকে ভিত্তি করে রূপকথার একটি রূপায়নী-উপকরণ- রূপেও দেখা চলবে আশা করি।’ সর্বান্তে ‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে’-র মাধ্যমে ধরণীর জয়গান করে নাটকের যবনিকাপতন ঘটেছে।

এই নাটকের সমনামে প্রবোধচন্দ্রের একটি প্রবন্ধ রয়েছে,যা হতে ষষ্ঠ পর্বে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন সুধীরচন্দ্র। তাহলে কি চন্দ্রসেনের দ্বারা চন্দ্রকর প্রভাবিত হয়েছিলেন? মুদ্রণগত ত্রুটির মধ্যে ‘অভিবন্দন’ পর্বের কয়কটি পৃষ্ঠার ঊর্ধ্বমার্জিনে ‘জয়-স্যন্দন’ কথাটি চোখে পড়ে। নাটকের গান সম্পর্কে সুধীরচন্দ্র কর সহায়তা পেয়েছিলেন স্বনামধন্য সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজকুমার মল্লিকের। সপ্তম পর্বের ‘সখি, কী যেন দেখেছি কবে’ গানটি কিন্তু সুধীরকৃত। অথচ সংযোজন— পরিমার্জনে এর দ্বিতীয়ার্ধটি রবীন্দ্রনাথের হয়ে গিয়েছিল। এই পর্বের অন্তিমাংশে ‘অনুগত-জনে কেন কর এত প্রবঞ্চনা’ গীতটি টপ্পাখ্যাত নিধুবাবুর রচিত। গ্রন্থের বহুল প্রচার ও পরিবেশনা বিষয়ে অত্যুৎসাহী ছিলেন রবীন্দ্ররচনার এই ভাণ্ডারী। প্রধানমন্ত্রীকে ‘জনগণেশ’ বলে বন্দনা করে গ্রন্থপ্রচারের ভারবহন তিনি করবেন বলে আশা করেছিলেন লেখক। বিবিধ প্রতিষ্ঠান, সম্মেলন, অধিবেশনে ‘পবিত্র স্মারক-উপহার-রূপে জন-সাধারণকে বিলোবার- মতো-মেলানি-হিসাবেও’ বইটিকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর হৃদয়ভাণ্ডার অপূর্ণই রয়ে যায়। পারমিতা প্রকাশনের নামে প্রকাশ হলেও গ্রন্থের প্রকাশক আদতে ছিলেন তিনিই।

স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ বর্ষপূর্তির আবেগঘন ‘বিশেষ-ফর্মুলা-তাৎপর্য প্রচারে’র বিষয় সম্পর্কেও তিনি সম্যকরূপে ওয়াকিবহাল ছিলেন। পাঁচশো প্রতিলিপি ছাপা হয়েছিল।   কিন্তু গ্রন্থের বিষয়বস্তুর ‘অমূল্য ও অনন্ত মহিমা’ সত্ত্বেও বৃহত্তর মানুষের করকমলে সুধীরচন্দ্র এই গ্রন্থ পৌঁছাতে পারেনি। যদিও সাহিত্যিক-অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী (এঁর ‘রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ’ নামক প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল), কালিদাস ভট্টাচার্যের পাশাপাশি গ্রন্থটি প্রশংসিত হয়েছিল প্রচ্ছদকর্তা সত্যজিৎ রায় কর্তৃক—’ ...গ্রন্থখানির লেখার রীতি, বক্তব্য এবং সমস্ত-জিনিসটার মধ্যে একটা সুসম্বদ্ধ-রূপ দেবার প্রচেষ্টা আমার কাছে সার্থক মনে হয়েছে। রচনাটি প্রকাশিত হলে সুনাম অর্জন করবে এ-বিশ্বাস আমার আছে।’

Comments :0

Login to leave a comment