সুকল্যাণ ভট্টাচার্য
সমতলে থেকে, নেট দুনিয়া দেখে, খাপছাড়া খবর পড়ে বিধ্বস্ত সিকিমকে, তার বীভৎস ভয়াবহতাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা এককথায় অসম্ভব। 'মেঘভাঙা বৃষ্টি, হিমবাহ পুষ্ট হ্রদ ফেটে যাওয়া, পাহাড় ধ্বংস ইত্যাদি নিয়ে পরিবেশবিদ, ভূগোলবিদ, ভূতাত্ত্বিক, নদী বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধীও বটে। সাধারণ মানুষের কাছে সিকিমের ভয়াবহতা, তিস্তা বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ, তার স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল কি কি হতে পারে, সেই সম্পর্কে সম্যক কোনও ধারণা বলতে গেলে নেই। ভাবতে অবাকই লাগে এই রকম প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়ের পরও গোটা দেশ যেন চুপ। সিকিম পাশ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পঙ জেলার একটা বড় এলাকার ভবিষ্যৎ অস্তিত্বও প্রশ্ন চিহ্নের সামনে! সামগ্রিকভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। সবকিছু নিয়ে এক অদ্ভুত গোপনীয়তা! কেন? এতগুলো মানুষের প্রাণ চলে গেল, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি শেষ তারপরেও এত নির্বিকল্প নীরবতা কেন?
বিধ্বস্ত সিকিমের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আর্থিক সাহায্য কি পর্যাপ্ত?
আজ এই অপ্রিয় সত্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে , সুদীর্ঘকাল ধরে সিকিমের উন্নয়নের নামে, গোটা রাজ্যের জল, জঙ্গল, জমি জলের দরে কর্পোরেটদের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। আলঙ্কারিক উন্নয়ন আর প্রকৃত বিজ্ঞানসম্মত সুসংহত উন্নয়নের ফারাক কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ আজকের প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিকিম।
এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট ছাড়া একের পর এক দৈত্যাকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমতি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পাইয়ে দেওয়ার ভেতরের গল্পটা ভেতরেই থেকে যাবে। এটাই প্রথা। এই প্রথা ভাঙার খেলা যাদের করবার কথা তাদের নীরবতাও বিষ্ময়কর! রাজনৈতিক ভাবে সিকিমের ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে দের আওয়াজ খুব ক্ষীণ। ভৌগোলিক অবস্থানগত বিচ্ছিন্নতার দরুন কি ভারত জুড়ে এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ীদের শাস্তি উঠছে না? ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এরকম বিপর্যয় হলে সংসদ থেকে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় 'ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম' হিসেবে। এইক্ষেত্রে সব একেবারে চুপচাপ! মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে সিকিমে লোকসভার আসন সংখ্যা যদি বেশি থাকত, তাহলে হয়ত গণতান্ত্রিক তাগিদ তৈরি হতো!
৪৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিস্তা নদীর ১৫১ কিলোমিটার সিকিমের মধ্যে। এই ১৫১ কিলোমিটারের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই উন্নয়নের জাঁতাকলে আর প্রাকৃতিক নেই! এই সহজ অথচ নিষ্ঠুর সত্যটাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করবার সময় এসেছে। সিকিমের বিদ্যুতের যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা রয়েছে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মধ্য দিয়ে, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করে সিকিমের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সামাল দিতে গিয়ে প্রকৃতি, মানুষ সকলকে মৃত্যু মুখে পাঠানোর নীতির পরিণাম এইভাবে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে নীতি প্রণেতারাও ভাবেননি।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় স্তরে নিয়ম অনুযায়ী নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করতে হলে তা অবশ্যই ' রান অন দ্য রিভার ' করতে হবে। অর্থাৎ যে নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি করা হচ্ছে, সেই নদীর জল কোনোভাবেই সরানো যাবে না, সেই নদীর ওপরেই ফেলতে হবে। সিকিমে একের পর এক বাঁধ, জলাধার, প্রকল্প তৈরি করবার সময় এই মৌলিক নীতি কতদূর পালিত হয়েছে তা নিয়ে ও প্রশ্ন উঠছে। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে এই বিষয় নিয়ে তথ্যগতভাবে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক জল বৈঠকে প্রশ্ন উঠিয়েছিল! স্বভাবসিদ্ধ দাদাগিরি করার মানসিকতা নিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই অভিযোগ!
সিকিম রাজ্যে অবস্থিত ১৪টি হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদই পরিবেশগত দিক থেকে বিপজ্জনক জায়গায় রয়েছে। এই সতর্কবার্তা ছিল। বিশেষ করে ' লোনাক ' হ্রদ নিয়ে বারংবার বিপদের সম্ভাবনা বিভিন্ন এজেন্সি থেকেই ছিল। লোনাক হ্রদের অতিরিক্ত জল কমানোর জন্য সাইফন প্রযুক্তি গত পাম্প বসানো হয়েছিল। কিন্তু যে গতি তে এই পাম্প অতিরিক্ত জল নিষ্কাশন করছিল তার থেকে কয়েক গুণ বেশি মাত্রায় জল হিমবাহ গলে আসছিল। যে তৎপরতা র মধ্য দিয়ে এগুলো করার কথা ছিল তার বিন্দু মাত্রও করা হয়নি এবং এই সংক্রান্ত স্বয়ংক্রিয় ওয়ার্নিং ব্যবস্থাপনা ও ভেঙে পড়ে ছিল আগেই। লোনাক হ্রদের মতো একটি বিপজ্জনক পয়েন্টের কয়েক কিলোমিটার ডাউনস্ট্রিমে কিভাবে ' চুংথাম ' প্রকল্প অনুমোদন পায় সেটাই তো আজ এক জিজ্ঞাসা!
গোটা পৃথিবী জুড়ে এখন বড়, উচু দীর্ঘ ড্যাম, দৈত্যাকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কারিগরি দিক থেকে প্রযুক্তি বিদরা পরিত্যাগ করবার পরামর্শ দিচ্ছেন। সিকিমে অদ্ভুতভাবে এই বাতিল হওয়া প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে, এটাই নিষ্ঠুর সত্য।
যোশী মঠ, কেদারনাথ, হিমাচলের হিমালয়ের একের পর এক বিপর্যয় থেকে পরিবেশবিদরা বারংবার সতর্ক করেছেন। কিন্তু লাভ, মুনাফার পাটিগণিতের কাছে, চটজলদি কিছু করে দেখানোর প্রচলিত ছকের কাছে বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞদের সতর্ক বার্তার কোনও মূল্য কি? পাহাড় অত্যন্ত ভঙ্গুর। মাটির নিচে টেকটোনিক টান, প্লেট গত টানাপোড়েন সিকিম পাহাড়ে প্রবল। সিসমিক জোন ফোর/ ফাইভে র বিপজ্জনক এলাকায় সিকিমের পাহাড়। এই রকম পরিস্থিতি জেনে, বুঝে সিকিম সরকার ও কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা দিনের পর দিন অনুমোদন দিয়ে গেছেন বেসরকারি ব্যাক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিকে জল লুট করে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের। বিদ্যুৎ কিনতেন হিন্দী বলয়ের বিদ্যুৎ ঘাটতি যুক্ত উন্নত রাজ্যগুলি।
সিকিমের সিভিক সোসাইটির আন্দোলনের মাত্রা অন্যান্য স্থানের তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া গ্রামীণ দারিদ্রের হার এমন একটা জায়গায় আছে, একেবারে প্রান্তিক মানুষ এই সমস্ত প্রকল্পে নানা ধরনের নির্মাণ কাজে কাজ করে আর্থিক সঙ্গতির মুখ দেখতে পেয়েছেন। খুব সঙ্গত কারণেই প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সিকিমে চূড়ান্ত জায়গায় এই সমস্ত প্রকল্প সূচনা লগ্নে অর্থাৎ আশির দশকের শেষদিকে ছিল না। তাছাড়া সর্বভারতীয় মিডিয়াতেও এই সমস্ত বিষয় নিয়ে সেই ভাবে আলোচনাও উঠে আসেনি। পাশাপাশি একটা প্রচ্ছন্ন গোপনীয়তাও ছিল। পাহাড়, জঙ্গলে র দুর্গম জায়গায় এই সমস্ত প্রকল্প গুলো স্থাপনা র দরুন এই সম্পর্কিত তথ্য ও ব্যাপক ভাবে উঠে আসেনি।
এই সমস্ত বড় বড় প্রকল্প তৈরির কাজে নিয়োজিত বহু জাতিক কোম্পানিগুলো এজেন্ট মারফত গোটা দেশ থেকে সস্তায় পরিযায়ী শ্রমিক সংগ্রহ করে কাজ করিয়েছে , এখনও করাচ্ছেন। হাজার হাজার বাইরের অভাবী মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড় ভাঙার কাজে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ সিকিমেই স্থায়ীভাবে আস্তানা গড়ে তুলেছেন। সিকিমের জন বিন্যাস গত বিশিষ্টতা গত কয়েক বছরে ভেঙেচুরে শেষ। ১৯৭৫ এ সিকিমের ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় সিকিমের আদি বাসিন্দাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্যতা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি রক্ষা করবার জন্য সাংবিধানিক রক্ষা কবচ দেওয়া হয়েছিল। ৩৭১এফ ধারার মধ্য দিয়ে সিকিমের আদি বাসিন্দা লেপচা, ভুটিয়া ও নেপালিদের কিছু অধিকার আজ বিলুপ্ত হওয়ার মুখে। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে সিকিমের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের আগুনের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। গোটা সিকিম রাজ্যে ভবিষ্যতে এক মারাত্মক ‘এথনিক ক্রাইসিস’ তৈরি হতে পারে। সামরিক স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে সিকিমের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে বিষয়টির তাৎপর্য যথেষ্টই উদ্বেগের।
তিস্তার উচ্চগতিকে যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে বেধে রাখবার কৌশল দীর্ঘদিন ধরে চলছে তার বিষময় পরিণাম, মধ্য ও নিম্নগতিতে পড়তে বাধ্য। সিকিমে তিস্তাকে গলা টিপে ধীরে ধীরে মারবার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ও তারপর বাংলাদেশে তিস্তা বলতে গেলে বর্ষার সময় ছাড়া মৃত। জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা ব্যারেজের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব বিপন্ন। গোটা উত্তরবঙ্গের ‘লাইফলাইন’ তিস্তা এককথায় বিপন্ন। একশ্রেণির মানুষের অবিবেচনা প্রসূত কাজের পরিণতিতে লাখো লাখো সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা - অস্তিত্ব বিপন্ন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে সিকিম সহ গোটা সাব হিমালয়ান উত্তরবঙ্গকে বাঁচাতে বিজ্ঞান সম্মত সুসংহত বিকল্পের সন্ধান ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারকে সচেষ্ট করতে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের আন্দোলন মনে হয় সময়ের দাবি। বড় বড় প্রকল্প না করে পরিবেশ বান্ধব ' মিনি হাইডেল পাওয়ার প্ল্যান্ট' তৈরি করবার কথা আবার ভাবতে হবে।
সিকিমের অসহায় হতভাগ্য মানুষের পাশে, অন্য রাজ্য থেকে সিকিমে কাজ করতে যাওয়া হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের নিদারুণ যন্ত্রণা দূর করবার লক্ষ্যে পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নেওয়াই মানবতা। " সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই " — চণ্ডীদাসের বলা এই কথা মানুষ হয়েই রক্ষা করতে হবে। সিকিমের পুনর্গঠনের কাজে গতি বৃদ্ধিতে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সাহায্যের পরিণাম অত্যন্ত কম। পশ্চিমবঙ্গের থেকে নির্বাচিত সাংসদদের বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিঙ, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের সাংসদ ও নির্বাচিত বিধানসভা সদস্যদেরও ভূমিকা পালন করা দরকার। ভুলে গেলে চলবে না সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের অর্থনীতির সঙ্গে সিকিমের পরিস্থিতি অনেকটাই সম্পর্কযুক্ত।
Comments :0