Salim harihorpara

শহীদের খুনীদের শাস্তির জন্য লড়াই আইনি পথে, সংগ্রাম হবে রাস্তাতেও

রাজ্য

অনির্বাণ দে: হরিহরপাড়া, 
 

‘‘আমি বিচার চাই। আমার বাবাকে যারা মেরেছে, তাদের শাস্তি চাই, ফাঁসি চাই।’’
রবিবার সকালে হরিহরপাড়ায় শহীদ কমরেড রিন্টু শেখের পুত্র সপ্তম শ্রেণির ছাত্র জসিমুদ্দিন ইসলাম মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে এই কথা বলে চুপ করে যাওয়ার পরেই তার কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে নিয়েছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তারপর সেই মাইক টেনে নিয়েই তিনি বলেছেন, ‘‘ফাঁসি কি না বলতে পারবো না, সেটা আদালতের ব্যাপার। কিন্তু আমরা এই থানা, জেলার পুলিশ সুপার হয়ে উপরতলা অবধি দাবি জানাচ্ছি। দরকার হলে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবো। কিন্তু রিন্টু শেখের খুনীদের আমরা শাস্তি দেওয়াবোই, এই কথা আমরা দিচ্ছি।’’ সেলিম বলেন, নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের জন্য এই লুটেরাদের রাজত্বের অবসান ঘটাতেই হবে।
রবিবার সকালে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার নিয়ামতপুরে শহীদ কমরেড রিন্টু শেখের বাড়ি যান সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। কথা বলেন তাঁর স্ত্রী জান্নাতন বিবি, মেয়ে আরিফা খাতুন, ছেলে জসিমুদ্দিন ইসলাম সহ পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা, পার্টির নেতা বদরুদ্দোজা খান, ইনসার আলি বিশ্বাস। সেখানেই মাইক লাগিয়ে মঞ্চ বেঁধে গ্রামবাসীদের উপস্থিতিতে দাবি উঠলো তৃণমূলের খুনীদের শাস্তির। কমরেড রিন্টু শেখের কন্যা একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী আরিফা খাতুন মাইকের সামনে কাটা কাটা উচ্চারণে বললো, ‘‘যারা আমার বাবাকে খুন করেছে, তাঁদের শাস্তি চাই।’’ এরপরেই তার গলা আটকে আসে, আর কিছু বলতে পারেনি আরিফা। কিন্তু গোটা নিয়ামতপুরের মানুষের দাবি সেখানেই উচ্চারিত হয়ে গিয়েছে। শহীদের বাড়ির সামনের জমায়েত থেকে সোচ্চারে আওয়াজ উঠেছে, ‘‘রেন্টু শেখের খুনীদের শাস্তি চাই, তৃণমূলের শাস্তি চাই।’’ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের ভোট লুটেরা বাহিনীর হাতে নিহত কমরেড রিন্টু শেখের খুনীদের শাস্তির দাবিতে এখন এককাট্টা নিয়ামতপুর।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন ভোট দিতে গিয়ে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক ও সিপিআই(এম) কর্মী রিন্টু শেখ। দুপুরেই তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রাতে সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয় কলকাতায়। ১৬ জুলাই এনআরএস হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কেন খুন করা হলো রিন্টু শেখকে?
নিয়ামতপুরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পাড়ার বুথেই ভোট দিতে গিয়েছিলেন রিন্টু শেখ। সেই সময়ে সেখানে পৌঁছায় হরিহরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক নিয়ামত শেখের কনভয়। তখনও শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল ভোট। বিধায়ক এলাকা থেকে যাওয়ার পরেই তৃণমূলের বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুথে হামলা চালায়। বুথ দখল সুনিশ্চিত করার জন্য সিপিআই(এম) কর্মীদের উপর নামিয়ে আনা হয় আক্রমণ। মাথা লক্ষ্য করে বাঁশ ও লাঠির বারি মারা হয় ৯ জন সিপিআই(এম) কর্মীকে। গুরুতর আহত হন তিন জন। কমরেড রিন্টু শেখ যখন গুরুতর আহত অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, সেই সময়ে থানায় গিয়ে তাঁরই নামে এফআইআর-ও দায়ের করে তৃণমূল।
ভোটের দিনে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার কথা এদিন পার্টির নেতাদের কাছে তুলে ধরেন কমরেড রিন্টু শেখের বৌদি, স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে সিপিআই(এম) প্রার্থী রাশিদা বিবি। তিনি জানান, খুনের ঘটনায় ২২ জনের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে হরিহরপাড়া থানায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ। এখনও গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুনীরা। হুমকি দেওয়া হচ্ছে সিপিআই(এম) কর্মীদের।
পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত দখলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করেই কমরেড রিন্টু শেখকে খুন করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দলের বিধায়ক নিয়ামত শেখের নির্দেশে হামলা হয়েছে। প্রার্থীর উপর হামলা হয়েছে, কমরেড রিন্টু শেখকে চিহ্নিত করে খুন করা হয়েছে। এখন নিহতর সন্তানদের দায়িত্ব কে নেবে? ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে মুর্শিদাবাদে শুভেন্দু অধিকারী, মমতা ব্যানার্জি একযোগে দামাট দিয়ে পঞ্চায়েত দখল করেছিল। এবারে মানুষ জবাব দেবে বুঝতে পেরে এখানে মানুষকে ভোটই দিতে দেয়নি তৃণমূল। হরিহরপাড়ায় বিধায়কের বাহিনীর হামলায় এই গ্রামেই ১০ জন আহত হয়েছেন।’’
সেলিম প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘‘পুলিশ যদি ব্যবস্থা না নেয়, যদি খুনীদের গ্রেপ্তার না করে, তাহলে আদালতে তো পার্টি যাবেই, সেই সঙ্গে লড়াই হবে ময়দানেও। লুটের মাধ্যমে জেতা পঞ্চায়েতের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। লড়াকু মানুষকে নিয়ে আমরা গণপঞ্চায়েত তৈরি করবো।’’
মহম্মদ সেলিম বলেন, লুটেরাদের সরাবেন বলে মানুষ মনস্থির করেছিলেন। তৃণমূল তা বুঝতে পেরেই পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে মানুষের অধিকার লুট করেছে। তবে ইতিহাসের শিক্ষা এটাই, যারা খুন করে, সন্ত্রাস করে তাদের কথা ইতিহাস মনে রাখে না। অপরাধের পক্ষে নয়, অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও মানুষকে শামিল করতে হবে।
খুনের ঘটনার পরেও পুলিশ খুনীদের গ্রেপ্তার না করে বরং মিথ্যা মামলায় আসামী করছে সিপিআই(এম)’র নেতা ও কর্মীদের। সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান মহম্মদ সেলিম। এদিন নিয়ামতপুরে কমরেড রিন্টু শেখের বাড়ির বাইরে সমবেত হয়েছিলেন গ্রামের মানুষ। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এক লক্ষ টাকার চেক ও পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির পক্ষ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক তুলে দেওয়া হয় শহীদ পরিবারের হাতে। জমায়েতে মহম্মদ সেলিম বলেন, শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে সাধারণ মানুষকে। মানুষকে সঙ্গে নিয়েই এই পরিবারের পাশে থাকবে পার্টি। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে লড়াই চালানো হবে। 

Comments :0

Login to leave a comment