গাজাকে ঘিরে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধেরই রূপ নিয়েছে। শনিবার ভোরে ইজরায়েলের মাটিতে ঢুকে পড়া হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। অন্যদিকে ইজরায়েল গাজায় একটানা ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমাবর্ষণ করায় বাড়িঘর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। ইজরায়েলী সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ৬০০ ইজরায়েলী নাগরিক নিহত হয়েছেন, এদের ৪৪ জন সেনা জওয়ান। প্রায় ২ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। সাধারণত একতরফা আক্রমণে অভ্যস্ত ইজরায়েলে কয়েক দশকে এত ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। হামাস যোদ্ধারা এখনও বেশ কয়েকটি শহরে ইজরায়েলী বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে। সে দ্রত, কফর আজা, নাহাল ওজ, বেরি, মাগেন, সুফায় বন্দুকের লড়াই চলছে। হামাসের শীর্ষস্তর থেকে দাবি করা হয়েছে, নতুন করে যোদ্ধারা ইজরায়েলের মাটিতে ঢুকেছে। গাজায় নিহত হয়েছেন ৩৮০ জন। ২০ জন শিশু। গাজাতেও প্রায় ২২০০ মানুষ আহত হয়েছেন। উঁচু বাড়ি, ব্যাঙ্ক বোমা আক্রমণে ভেঙে পড়েছে। শহরজুড়ে কালো ধোঁয়া এবং আগুন দেখা যাচ্ছে। ইজরায়েল বিদ্যুৎ যোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়ায় প্রায় অন্ধকারেই ডুবে আছে গাজা। হাসপাতালগুলিতে আহতদের স্রোত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসাব, ইজরায়েল ঘেঁষা সীমান্ত এলাকা ছেড়ে পিছনের দিকে সরে গেছেন ২০ হাজার মানুষ। অনেকেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের তৈরি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু হামাস জানিয়েছে, এই যুদ্ধের শেষ দেখে ছাড়া হবে। গত ১৫ বছরে পাঁচবার গাজায় বড় আকারে আক্রমণ চালিয়েছে ইজরায়েল। এছাড়া প্রায় একটানা বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর মধ্যেই ইজরায়েলের উত্তর সীমান্তে লেবানন থেকে রকেট ও মর্টার ছুঁড়েছে হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী। ইজরায়েলের দখলে থাকা শেবা অঞ্চল লক্ষ্য করেই মর্টার ছোঁড়া হয়েছে। তিনটি ইজরায়েলী সেনা ঘাঁটিতে এই রকেট এসে পড়েছে বলে খবর। ইজরায়েলও পালটা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। হেজবুল্লাহের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ‘আমাদের সমস্ত বন্দুক ও মর্টার প্যালেস্তাইন যোদ্ধাদের জন্য ব্যবহার হবে’।
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হুঙ্কার দিয়েছেন, গাজা মরুভূমি দ্বীপে পরিণত হবে। সুতরাং ইজরায়েলের তরফে আক্রমণ যে আরও তীব্র হবে তা স্পষ্ট। ভারতীয় সময় রবিবার রাত পর্যন্ত ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী গাজা ভূখণ্ডে ঢোকেনি। আক্রমণ চলছে বোমারু বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই। কিন্তু ইজরায়েলী সেনারা মাটিতে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ বাহিনীকে সীমান্তের দিকে পাঠানো হচ্ছে। তবে, গাজার ভূখণ্ডে হামাসের সঙ্গে লড়াই কঠিন হবে বলেও ইজরায়েলের রাজনৈতিক-সামরিক মহলে আশঙ্কা রয়েছে।
মার্কিন বিদেশ সচিন অ্যান্টনি ব্লিন্কেন জানিয়েছেন, ইজরায়েলকে নতুন সামরিক সাহায্য দেবে আমেরিকা। বস্তুত, মার্কিনীদের দেওয়া অস্ত্রই ইজরায়েলের মূল সমরভাণ্ডার। পশ্চিম এশিয়া ও আরব দুনিয়ায় ইজরায়েল মার্কিন শিখণ্ডি হিসাবে কাজ করে। ব্লিন্কেন জানিয়েছেন, ইজরায়েলেই এই আক্রমণের সময়ে কয়েকজন মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর খবরও রয়েছে।
প্যালেস্তাইনের অন্য জায়গাতেও হামাসের এই প্রত্যাঘাতকে স্বাগতই জানিয়েছেন মানুষ। ইজরায়েলের জেলে ১৩ বছর বন্দি থাকা জেনিনের শারিফ তাহানে বলেছেন, ইজরায়েলে ভূমিকম্প ঘটে গেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে বহু সময় লাগবে। আশা করি এ থেকে তারা শিক্ষা নেবে। যারা প্যালেস্তাইন সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে আরব স্থিতিশীলতার পথে ধরেছিলেন তারাও শিক্ষা নেবে।
ইজরায়েলের বামপন্থী কোয়ালিশন হাদাশ উভয় পক্ষেই রক্তপাতের নিন্দা করেই বলেছে, আমাদের তরফে আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল নেতানিয়াহু সরকার প্যালেস্তিনীয়দের বিরুদ্ধে যে মনোভাব নিয়েছে তার এই রকম বিপর্যয়কর ফল হবে। ১২০ সদস্যের ইজরায়েলী সংসদ কেনসেটে হাদাশের ৪ জন সাংসদ রয়েছেন। সাংসদ ওফের কাসিফ বলেছেন, নির্দোষ অসামরিক মানুষের ওপরে যে কোনও আক্রমণের আমরা নিন্দা করছি। কিন্তু প্যালেস্তিনীয় জনগণের ওপরে আক্রমণেরও আমরা নিন্দা করছি। যে ঘটনা ঘটেছে তাকে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। চলতে থাকা দখলদারির প্রেক্ষিতে দেখতে হবে। আমরা বারংবার সতর্ক করেছি যা ঘটছে তা থেকে বিস্ফোরণ ঘটবেই এবং উভয় পক্ষেরই অসামরিক মানুষকে তার মূল্য দিতে হবে। বিশেষ করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে গত এক বছর ধরে যেভাবে ইজরায়েলী সেনারা আক্রমণ করেছে, ৩০০-র বেশি প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করেছে এবং বেপরোয়াভাবে বসতি স্থাপন করছে, কাসিফ তাকেই ‘প্রেক্ষিত’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ইজরায়েলের সরকার ফ্যাসিস্ত সরকার। তারা প্যালেস্তিনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযানকে সমর্থন করে, উৎসাহ দেয়, এমনকি নেতৃত্ব দেয়। জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে দেবার কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। দেওয়ালের লেখা স্পষ্টই ছিল— এতদিন প্যালেস্তিনীয়দের রক্তের অক্ষরে তা লেখা ছিল। এখন ইজরায়েলীদের রক্তও তাতে লেগে গেল। দখলদারির অবসানই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র রাস্তা।
এদিন চীন উভয় পক্ষকেই সংযত হবার আবেদন জানিয়েছে। চীনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন, বারংবার সংঘাত ঘটছে। এর থেকে প্রমাণিত হচ্ছে শান্তি প্রক্রিয়াকে স্থগিত রাখা চলে না। এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার মৌলিক সূত্র হলো দুই রাষ্ট্রের সমাধানসূত্র। স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলের উচিত হবে দ্রুত শান্তি আলোচনা শুরু করা এবং শান্তিকে স্থায়ী করার পদ্ধতি খুঁজে বের করা।
Palestine Israel war
সংঘাতে মৃত্যু প্রায় হাজার
×
Comments :0