বুধবার দিল্লি শহরে গৃহহীন ব্যক্তিদের আবাসনের অধিকার সম্পর্কিত একটি মামলা শুনানির সময় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ বলেছে, মানুষ ফ্রি রেশন এবং টাকা পাচ্ছে, কিন্তু কাজ না করে। এই শুনানি চলাকালীন ২ সদস্য বিশিষ্ট বিচারপতিদের বেঞ্চ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে। তাঁরা ভোট অঙ্কের দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির বিভিন্ন খয়রাতি (freebie) দেওয়ার ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। বেঞ্চের বিচারপতি বিআর গাভাই এবং অগাস্টিন জর্জ মাসিহ মন্তব্য করেছেন, মানুষ কাজ করতে চায় না, কারণ তারা ফ্রি রেশন এবং টাকা পাচ্ছে। “তাদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে, দেশের উন্নয়নে যোগদান করতে উৎসাহিত করার বদলে, আমরা কি পরজীবী একটি শ্রেণি তৈরি করছি না”, বিচারপতি গাভাই এই প্রশ্ন তুলেছেন। পর্যবেক্ষণে তাঁরা আরও জানিয়েছেন, "আমরা তাদের জন্য আপনার উদ্বেগকে পুরোপুরি বুঝি, কিন্তু এটি কি ভালো হতো না, যদি তাদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখতে দেওয়া হতো?"
সঠিক পর্যবেক্ষণ। এনিয়ে বিশেষ দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই।
কিন্তু আর একটি মন্তব্য জনমানসে গভীর উদ্বেগ সঞ্চারের অবকাশ রাখে। আবেদনকারীদের পক্ষের এক আইনজীবী মন্তব্য করেছিলেন, সরকার বা কর্তৃপক্ষ কেবল ধনীদের জন্য সহানুভূতি দেখায়, গরিবদের জন্য নয়। এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ বিচারপতি গাভাই বলেন, “এই আদালতে রামলীলা ময়দানের ভাষণ দেবেন না”। তিনি আরও বলেন, "অযথা অভিযোগ করবেন না। এখানে রাজনৈতিক ভাষণ দেবেন না। আমরা আমাদের আদালত কক্ষকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের স্থানে রূপান্তরিত হতে দেব না।” এই মন্তব্যেও সমস্যা নেই। কিন্তু তিনি আরও যোগ করেন, “আপনি কীভাবে বলছেন যে সহানুভূতি কেবল ধনীদের জন্য দেখানো হয়? সরকারকেই বা কীভাবে আপনি একথা বলেন?” গরিবদের জন্য সরকার কিছু করেনি বা তাদের প্রতি উদ্বেগ দেখায়নি, এমন চিত্র আঁকাটা ভালো রুচির পরিচয় নয়।
রাষ্ট্র বা সরকার অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ধনীর হয়ে আমাদের দেশে কাজ করে না? এটা কি সত্য নয়, দরিদ্র মানুষ এদেশে প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছে? এটা কি রূঢ় বাস্তব নয়, বিজেপি সরকারের আমলে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ সাল অর্থাৎ গত নয়টি আর্থিক বছরে ব্যাঙ্কগুলো মোট ১৪,৫৬,২২৬ কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছে, যার মধ্যে বড় শিল্প এবং পরিষেবার কর্পোরেটগুলির ঋণ মকুব করা হয়েছে ৭,৪০,৯৬৮ কোটি টাকা। (প্রশ্নোত্তর, লোকসভা, ৮ আগস্ট, ২০২৩) এই অতি ধনীরা সংখ্যায় কত, পাঁচশো বা হাজার। অথচ বেকার যুবক অটোরিকশার ৩টি কিস্তি দিতে না পারলেই, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তার অটো কেড়ে নেয়, আদালত আইন অনুযায়ী তাকে শাস্তি দেয়। এরপরেও কি সংশয়ের অবকাশ থাকে দরিদ্র মানুষ এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উপেক্ষিত এবং সরকার ধনীদের পক্ষে কাজ করছে! অতি ধনীদের জন্য এই বিপুল ‘ফ্রিবি’ বা খয়রাতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না কেন? সত্যিই কি দরিদ্র মানুষ কাজ করতে চাইছেন না, নাকি সরকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ? গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের অন্যতম সূত্র মনরেগা প্রকল্পে ১০০ দিন কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও, গড়ে ৫০ দিনও কাজ দেয়নি সরকার। ২০২৩-২৪ সালের তুলনায় এবারের বাজেটে এই বাবদ বরাদ্দ কমেছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ গত ১১ বছরে ১০.৫৪ লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে কর্পোরেটদের। অথচ ২০২৩-২৪ সালের তুলনায় এবছর খাদ্যে ভরতুকি কমেছে ৮,৩৬৪ কোটি টাকা। এরপরে বলা যাবে না, সরকার অতি ধনীদের জন্যই? সরকারের বৈষম্যের বিরুদ্ধে দরিদ্র মানুষের কণ্ঠরোধের উদ্যোগ বিপজ্জনক প্রবণতা।
Editorial
উদ্বেগ কার জন্য?
![](https://ganashakti-new-website.s3.ap-south-1.amazonaws.com/24126/67aee4b8025dc_63e638caac42b_63e3574de6f94_Editorial.jpg)
×
Comments :0