THE RED FLAG

রাজনীতি নয় বাঁচার লড়াইয়ে আজও পাশে সেই লাল ঝান্ডা

রাজ্য জেলা লোকসভা ২০২৪

অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়:  তপন

সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি করে বয়স্ক মা-বাবা’কে নিয়ে কোনোমতে চলছিল উত্তম বিশ্বাসের জীবন। কিন্তু বাদ সাধলো শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। উত্তম বিশ্বাস সে সময় তৃণমূল নেতা বিপ্লব মিত্রের গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ থাকার জেরে তাঁকে দলেরই এক মহিলা কর্মীকে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। 
লস্করহাট গ্রামের কালীপুজোকে নিয়ে বিবাদের সূত্রপাত। পাড়ার ক্লাব, প্রতিবাদ সঙ্ঘ সরকার থেকে সরকারি উৎসব অনুদানের ৩ লক্ষ টাকা পেলেও তা আত্মসাৎ করেন ক্লাবের তৎকালীন সম্পাদক রাজু দাস। আর এই ক্ষোভেই গ্রামবাসীরা তার বিরুদ্ধে মারমুখী হওয়াতে নিজের নিকটাত্মীয়কে বাঁচাতে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করে তৃণমূলের ওই মহিলা কর্মী। তিনি সে সময় ছিলেন তপনের তৃণমূল বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদা গোষ্ঠীর সঙ্গে। আর সে সময় মারাত্মক গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু করেছিলেন বিপ্লব মিত্র ও সত্যেন্দ্রনাথ রায়। তৃণমূলের সর্বময় কর্তা হিসাবে বিপ্লব মিত্র চেয়েছিলেন তপনকে নিজের দখলে রাখতে। বাদ সাধে সে সময় তপনের তৃণমূল নেতা বাচ্চু হাঁসদা ও তার জুড়িদার সত্যেন্দ্রনাথ রায়। এরপরে সত্যেন্দ্রনাথ রায় ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে টিকিট না পেয়ে বিজেপি’তে চলে যান। গঙ্গারামপুর বিধানসভা থেকে তিনি জিতে যান। তপনও তৃণমূলের হাতছাড়া হয়।
কিন্তু রাজায় রাজায় যুদ্ধের জেরে চরম পরিস্থিতি তৈরি হয় উত্তম বিশ্বাসের পরিবারে। মিথ্যা মামলায় চাকরি গেলেও সেই মামলা না ধোপে টেকেনি। অচিরেই খালাস পেয়ে যান উত্তম বিশ্বাস। কিন্তু গ্রামে কোনও কাজ নেই। নেই সামান্য চাষের জমি। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দলে নাম লেখাতে হয় উত্তমকে। কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাতে হয় তেলেঙ্গানায়। 
ঢালাইয়ে সাটারিং কাজের সামান্য অভিজ্ঞতা থাকায় উত্তম বিশ্বাস যোগ দিয়েছিলেন সেকেন্দ্রাবাদের কেএলসি কনস্ট্র্যাকশনে। কাজ শুরু করেছিলেন ২০২৩-র ১৯ এপ্রিল। ভালোই চলছিল কাজ। বয়স্ক বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটেছিল। যাক্, ছেলে তাও কিছু সংসারের খরচ পাঠাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুখ পাঁচ মাসের বেশি টেকেনি।  
গত ৬ অক্টোবর সাইবারাবাদ জেলার জগৎগিরিগুট্টা থানার তুলসীভানম অ্যাপার্টমেন্টে কাজ করছিলেন উত্তম। সকালে সেখানে বহুতলের সাটারিংয়ের কাজ করতে ২৬তলা থেকে পড়ে যান তিনি। সঙ্গীরা সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। ২০২৪-র ১৮এপ্রিল পর্যন্ত চুক্তিতে যাওয়া একমাত্র ছেলের অকাল মৃত্যুতে লস্করহাটের বিশ্বাস পরিবারে নেমে আসে চরম অন্ধকার।
বাবা কুমারেশ বিশ্বাস অসুস্থ। হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারেন না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা রাজকুমারী বিশ্বাসও পাগলপারা। লস্করহাটের মানুষের সহযোগিতায় এখন কোনোমতে চলছে তাঁদের সংসার। মেলেনি প্রাপ্য বার্ধক্য ভাতাটুকুও। এরই মাঝে গ্রামের মানুষদের নিয়ে সিপিআই(এম) তপন এরিয়া কমিটির সম্পাদক দিলীপ বিশ্বাস চালিয়ে যাচ্ছেন উত্তম বিশ্বাসের পরিবারের বাঁচার লড়াই। রাজনৈতিক পরিচয় উপেক্ষা করে তিনি ঠিকাদারের কাছ মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন। গ্রামের অন্যান্য মানুষদের মতো দিলীপ বিশ্বাস নিজের সামর্থ্যের মধ্যে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে চলেছেন।
বত্রিশ বছরের ছেলের কথা উঠলেই বাবা কুমারেশ বিশ্বাস চোখের জল আটকে রাখতে পারেন না। মা রাজকুমারী বিশ্বাস চান, মিথ্যা মামলা দিয়ে যারা তাঁর ছেলে গ্রামছাড়া করেছে, তাঁদের শাস্তি হোক। রাজকুমারী বিশ্বাস অগাধ আস্থা লাল পার্টির ছেলেদের ওপর। নিজেকে সামলে কোনোমতে বললেন, ‘এঁদের জন্য এখনো আমরা বেঁচে আছি। এমন করে আর যেন কোনও মায়ের কোল খালি না হয়।’
তপনের লস্করহাট, রামপুরহাট, দাড়াল এলাকায় সব ধর্মের মানুষের বাস। কিন্তু তপন বিধানসভায় বিজেপি আসার পর থেকে নানা সময় ধর্মকে কেন্দ্র করে বিবাদ লাগানোর চেষ্টা এখনও অব্যহত। লস্করহাটে মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি থাকায় নানান সময় নানা ধরনের মাংস ফেলে এলাকার মানুষের শাস্তি বিঘ্ন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাদ পড়ছে না মন্দির কিংবা মসজিদ।
সিপিআই(এম) কর্মীরা যুক্তি দিয়ে গ্রামবাসীদের বারংবার ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করছেন। সামনে লোকসভা নির্বাচন। তাই লস্করহাটে যাতে নতুন করে যাতে কোনও গোলমাল লাগানোর চেষ্টা না করা হয় তার জন্য তৈরি লাল পার্টির ছেলেরা। ‘ভোট আসবে, ভোট যাবে, কিন্তু গ্রামবাসীদের রক্ষা করার কাজ আমরণ করে যাব’, বললেন এলাকার তরুণ পার্টিনেতা দিলীপ বিশ্বাস।

Comments :0

Login to leave a comment