দক্ষিণ কোরিয়ায় পথ চলতে চলতে, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ঢুকে পড়েছিলাম ব্যাটারিচালিত বাইক কোম্পানিতে। জুনিয়র ম্যানেজার বেরিয়ে এসে দু-এক কথায় গল্প জুড়ে বললেন, কী দরকার আপনার এত কষ্ট করার। একটা ব্যাটারি-বাইক দিচ্ছি, নিয়ে চলে যান। হেসে বললাম, আমার প্রোগ্রামটাই সাইকেলে বিশ্ব পরিক্রমা। এই কষ্টই আমার জীবনী শক্তিকে বাড়িয়ে চলেছে।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই। ইউরোপে ঘোর বর্ষায় সাইকেলে চললাম দু’মাস, না একদিনের জন্যও সর্দি লাগেনি। শরীর খারাপ তো দূরের কথা। সন্দেহ নেই, সাইকেল জীবনী শক্তি বাড়ায়। করোনা কালে তার প্রমাণ পেয়েছি সবাই।
লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ারে ঢুকেই দেখলাম, পরিবেশ কর্মীদের পথ অবরোধ চলছে। দাবি, পেট্রোল ও ডিজেলচালিত যান বন্ধ হোক। সত্যিই তো, উষ্ণায়নের এই বিপদের যুগে এখনই পরিবহণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। চীন বা ভিয়েতনামে ব্যাটারিচালিত গাড়িই বেশি। ইউরোপের পথে বাইক তেমন না থাকলেও চার চাকার গাড়িই বেশি। ব্যাটারির গাড়ি প্রয়োজন, কিন্তু সাইকেলের চেয়ে পরিবেশ বান্ধব আর কে আছে? তাই সাইকেলের কদর এবং সাইকেলযাত্রীর সম্মান এই মহাদেশে সবচেয়ে বেশি।
মাস কয়েক আগের কথা। ইউরোপ থেকে তখন সবে ফিরেছি। সাইকেলে এজেসি বোস রোড ধরে, পার্কসার্কাস ক্রসিং পেরোতেই, সিভিক পুলিশ পথ আটকে জানান দিয়ে জানালেন, এই পথে সাইকেল চলা নিষেধ। দিন, একশো টাকা ফাইন দিন। বললাম, সে নয় দেবো, কিন্তু বলুন দেখি, আপনি বেতন কত পান ? উত্তর এলো, হাজার দশেক। বললাম, এই টাকায় রোজ বাস, অটো ভাড়া দিয়ে আসেন কী করে ? বললে, সাইকেলে আসি। তাঁকে বললাম, দেখুন এটাই বাস্তব। আমার কথা বাদ দিন, এই শহর, এই দেশে, ৯৩ ভাগ মানুষ দশ হাজারের নিচে আয় করে। কেউ বেসরকারি সংস্থায়, কেউ বা কায়িক পরিশ্রম করে। আপনারা যদি এই কড়াকড়ি করেন, তাহলে ওঁরা কাজে আসেন কী করে ? উত্তর এলো, কী করবো। ওপর তলার অর্ডার। বলেই বললেন, এক কাজ করুন।
আপনি এই পথে আসার সময়, শুধু সামনের এই মোড়টা নেমে পাড় হবেন। সিভিক পুলিশ তার অভিজ্ঞতায় বুঝলেন। কিন্তু চড়া দামের বাজারে, নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষ গাড়ি ভাড়া বাঁচাতে সাইকেল ব্যবহার করলে আটকানো হবে কেন? রাজ্যের কর্ণধাররা একবারও ভাবেন কী? সাইকেল ছাড়া তাঁদের সামনে বিকল্প কিছু আছে কী ?
কেন সাইকেল লেন?
বিশ্বজুড়ে এখন সাইকেলের ব্যবহারকে মান্যতা দেওয়া হয়। দেওয়া হয় সম্মান। সাইকেল যাত্রীও সে দেশের নাগরিক, পথে তাঁরও সমান অধিকার। দ্রুত নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছে যাবার দরকার তাঁরও যে আছে, তা মেনে নিয়েছে অধিকাংশ উন্নত দেশ। অন্য গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ না হয়, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই সাইকেল লেন।
দেশে দেশে সাইকেল পথ রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নেমে অবাক, উঁচু এয়ারপোর্ট থেকে নেমে সাইকেল পথ সোজা সিডনির রাজপথ হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় হাইওয়েতে। মায়ানমার, কাম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্স বাদে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাকি সব দেশ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া, চীন, রাশিয়া সহ ইওরোপের সব দেশেই রয়েছে সাইকেল পথ। ভুলেও অন্য কোনও গাড়ি ঢোকে না সাইকেল পথে। চীনে শুরুতেই এক শহরে আমার হেলমেট ফেললাম হারিয়ে। না, গোটা পথে আর হেলমেট কেনার প্রয়োজন অনুভব করলাম না, নিরাপত্তা সম্পর্কে সাইকেল লেনে ছিলাম এতটাই নিশ্চিন্ত।
সাইকেল পরিষেবাও রয়েছে বিভিন্ন শহরে।
সিঙ্গাপুর, চীনের পথে পথে সারি সারি সাইকেল সাজানো, নাগরিকদের জন্য। যখন যার প্রয়োজন নিয়ে বেড়িয়ে পড়ছে, গন্তব্যে পৌঁছে সাইকেল রেখে দিয়ে চলে যাচ্ছে। দিনের শেষে কর্পোরেশনের কর্মচারীরা তা আবার গুছিয়ে এক জায়গায় করে রেখে দেন। আমাদের এখানে নিউটাউনে সাইকেল ভাড়া দেবার ব্যবস্থা চালু হয়েছে বটে। যেখানে সেখানে রেখে দিয়ে চলে যাওয়া যায় বলে জানি না। তবে এই দেশগুলিতে নাগরিকদের কোনো পয়সা এর জন্য খরচ করতে হয় না।
সাইকেল যাত্রীদের সম্মানই আলাদা দেশে দেশে।
আগেই বলেছি এই সব দেশগুলোতে সাইকেল যাত্রীদের কদর সর্বত্র। সাইকেলে চলতে চলতে প্রায়সই দেখতে পাবেন চার চাকা কিংবা বড় গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে, আপনার চলে যাওয়ার অপেক্ষায়। আপনি গেলে তবেই তাঁরা রাজপথে পা বাড়াবেন। বড় বড় গাড়ি ট্রাক ভুলেও আপনার পেছনে হর্ন দেবে না। যদি আপনি ঘাবড়ে যান এই ভেবে। নিঃশব্দে আপনার পেছনে এগোতে থাকবে। জাপানে ফুজিয়ামার পাহাড়ি পথে একটুকুও জায়গা না থাকায় ট্রাকগুলোকে সাইড দেওয়া যাচ্ছিল না। টানা আধা ঘন্টা পিছু পিছু চলে ধৈর্যের পরীক্ষাতে দাগ রেখে গেলো।
সাইকেল ভারতে আলাদা গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
সাইকেলে বিশ্ব পরিক্রমায় লেখক।
আমাদের এদেশে চিরকালই বহু মানুষ সাইকেলেই করেছেন যাতায়াত, কিন্তু উদারনীতির যুগে, শিল্প আনার উদ্যোগে, শহরের যানবাহনের গতি বাড়ানোর উদ্যমে, কোপ পড়েছে সাইকেলে। আগে বিধিনিষেধ ছিল শুধু পার্ক স্ট্রিট চত্বরে, কিন্তু শিল্প আসুক বা না আসুক, বিগত আট দশ বৎসরে বিধিনিষেধের গণ্ডি ছড়িয়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে।
করোনার সময় যানবাহন বন্ধ থাকায়, সাইকেলের উপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। সরকার, এবং পুলিশ প্রশাসনও মানুষের এই প্রয়োজন, হার না মানা মনোভাবকে উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে পথে পুলিশি কড়াকড়ি গিয়েছিল কমে। কিন্তু করোনা পেছনে যেতেই আবার সামনে চলে এসেছে সেই কড়াকড়ি, গরিব মানুষের উপর হয়রানি। গত ২০১১’তে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর, কোষাগারের অভাব মেটাতে যেন তেন প্রকারেন ফাইন আদায়ের সহজ পথ বেছে নেয়। বাস ট্যাক্সি অটোর পাশাপাশি সাইকেলও সেই গণ্ডিতে চলে আসে। ফলে সাইকেল যাত্রীরা প্রায়শই শিকার হচ্ছেন এই অর্থদণ্ড আর হয়রানির।
এই রাজ্য, এই কলকাতায় সাইকেল আন্দোলন জারি আছে।
সকলের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশে গড়ে উঠেছে সাইকেল সমাজের মতো আরও সামাজিক সংগঠন। সরকারের কাছে চলেছে তদ্বির। প্রায়শই ডেপুটেশন। 'চাই কলকাতায় সাইকেল লেন', 'চাই সাইকেল চালানোর অধিকার'। মাঝে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে সাইকেল লেন নিয়ে ভাবনা চিন্তার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। কলকাতায় সাইকেল লেন নিয়ে সমীক্ষাও শুরু হয়। কিন্তু সবই আবার চাপা পড়ে গিয়েছে।
চীনে সাইকেল চলাচলের জন্য ব্যবস্থা।
এটা ঠিক, কলকাতায় জায়গার সমস্যা রয়েছে। অপরিকল্পিত এই নগরে রাস্তার জন্য জায়গা ছাড়া নেই যথেষ্ট। কিন্তু সমাধান নেই, সেকথা বলা যাবে না। জাপানেও জনঘনত্ব বেশি। পাহাড়ি শহরে পথঘাট কিন্তু যথেষ্ট চওড়া নয়। সেই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই অনেকে চার চাকার গাড়িগুলিকে চওড়ার বদলে লম্বাটে আকার দেওয়া হয়েছে। ফুটপাত খুব বেশি চওড়া নয়। তবু তার মাঝেই পথচারী ও সাইকেল যাত্রীদের দু’টি আলাদা লেন টানা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক শহরেই তুলনায় কম চওড়া বিকল্প পথগুলিকে সাইকেলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আমাদের কলকাতায় এই লক্ষ্যে সমীক্ষার কাজ চলছিল, কিন্তু আবার সব চুপচাপ। আসলে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ চাই কাজে। প্রয়োজনে তার জন্য, সাইকেল সংগঠন, পরিবেশ সংগঠন ও অসংগঠিত শ্রমজীবী সংগঠন গুলোর যৌথ মঞ্চ গড়ে এই দাবি আদায়ের সার্বিক আন্দোলন গড়ে তোলাপ্রয়োজন। সন্দেহ নেই, এটিই সময়ের দাবি।
Comments :0