Education

কলেজের ক্লাসরুম থেকে বলছি

ফিচার পাতা

শান্তনু ব্যানার্জি 

২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরানো ত্রিবার্ষিক (১+১+১) ব্যবস্থা বদলে চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেমের (সিবিসিএস) মাধ্যমে সেমিস্টার ভিত্তিক সিলেবাস চালু হয়। ছ’মাসের এক একটা সেমিস্টার। তার জন্য ছোট একটা ইন্টারনাল পরীক্ষা, টিউটোরিয়াল প্রজেক্ট কলেজকে নিতে হবে। বাকি থিওরি পরীক্ষাটি নেবে বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ন্যাক নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে  কলেজকে নিজের মূল্যায়ন করাতে হয় পাঁচ বছর অন্তর। প্রতি বছর কলেজের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের রিপোর্ট ন্যাক- কে পাঠাতে হয়। তার জন্য বছরভোর চলে হরেক কিসিমের প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নানা ধরনের স্বল্পদৈর্ঘ্যের কোর্স চালানো ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব আড়ম্বর, ছুটিছাটা এবং পরীক্ষাগুলো নিতে গিয়ে ছয়মাসের সেমিস্টারে দুই থেকে আড়াই মাস মেরেকেটে ক্লাস পাওয়া যায়। বিশাল সিলেবাসের একটা বড় অংশ না পড়ানো থেকে যায় অথবা ওপর ওপর কিছু বলে শেষ করতে হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে ছোটে। যাদের পকেটে কুলোয় না তারা পড়ে থাকলো পিছনে।
সেমিস্টার ব্যবস্থা শুরু হওয়ার বছর দেড়েকের মাথায় অতিমারীতে কলেজ গেল বন্ধ হয়ে। চালু হলো অনলাইন পরীক্ষা। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে তাদের প্রথমে জানিয়ে দেওয়া হলো অমুক তারিখের মধ্যে নির্দিষ্ট মেইল আইডিতে টিউটোরিয়াল প্রজেক্ট জমা দিতে। তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পরও বহু খাতা ধীরে ধীরে আসতে থাকে। একবার একটি ছেলের ইতিহাস প্রজেক্টের খাতা জমা আর পড়ে না। সারা দিন ফোন করে করে আমরা বিরক্ত হয়ে উঠেছি। রাত দশটা নাগাদ এক অধ্যাপিকা হঠাৎ তাকে ফোনে ধরতে পেরে খুব বকাঝকা শুরু করলেন। সব শোনার পর শান্তভাবে সে জানালো সারাদিন বাইক  চালিয়ে স্যুইগি বা জ্যোমাটোর খাবার ডেলিভারি দিতে ব্যস্ত ছিল। ফোন রিসিভ করতে পারেনি। গভীর রাতে মেইল করে সে কিন্তু খাতা জমা দিয়েছিল। খুব শুনি অনলাইন পরীক্ষায় বই দেখে লিখে ছেলেমেয়েরা ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পেয়েছে। আর একটা সত্য এই হতভাগ্য মাস্টাররা দেখেছে। সেটা হলো  বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া আর পড়াশোনা চালানোর পাশাপাশি সংসার চালানোর জন্য ওদের বিপুল লড়াই।
কোভিডক্রান্তি শেষ হতে না হতেই কেন্দ্রের ইচ্ছেকে মেনে নিয়ে রাজ্য সরকার চার বছরের মধ্যেই সিবিসিএস তুলে দিয়ে নয়া শিক্ষানীতি লাগু করে দিল। তিন বছরের, চার বছরের নানা রকম কোর্সের ব্যাপার আছে। বিস্তৃত বলার পরিসর নেই। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই, অনার্স আর পাশ কোর্সের সিলেবাস এক হয়ে গেছে। যারা শুধুই পাশ কোর্স পড়ে তাদের কোর্সের গালভরা নাম এমডিসি। ওই ক্লাসেই যাদের অনার্স আছে তারা মাইনর বা এমএন।
এবছর প্রথম সেমিস্টারে ইতিহাস পাশ কোর্সে আমার কলেজে মোট ছাত্রসংখ্যা ১৮৫ জনের মতো। বছরের প্রথমে দু’-একটি ক্লাসে ৫০/৬০ জন উপস্থিত ছিল। তারপর কমতে লাগলো। পুজোর ছুটির পর তিনটি ক্লাস পেয়েছি। উপস্থিতির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ০,৩ এবং ১১ জন।
গত ক্লাসে তিনজনকে নিয়েই একটা নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলাম, পুরোটা শেষ হয়নি। আজ এগারো জন এসেছে কিন্তু আগের তিনজন নেই। নতুন এগারো জনের মধ্যে বেশ কয়েকজন এই প্রথম ইতিহাস ক্লাসে এল। অধ্যায়টা এদের  জন্য আবার নতুন করে শুরু করবো? কিন্তু পরের ক্লাসে এদের কেউই হয়তো আসবে না ...যারা আসবে সম্পূর্ণ নতুন মুখ। পড়ানো কোনোদিনই শেষ হবে না। এটা পুরানো সমস্যা, অধ্যাপক মাত্রেই জানেন। তবে সমস্যাটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বই বন্ধ করে আমি ওদের ছাত্র বনে গেলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত কলেজে না এসে ওরা করেটা কি! আমি বিশ্বাস করি না ওরা দিনের এতটা সময় ঘুমিয়ে, আড্ডা মেরে, মোবাইলে গেম খেলে কাটায়। কখনও বন্ধুর মতো, কখনও বাবার মতো নরম, সহানুভূতির স্বরে জিজ্ঞেস করে গেলাম ... কেউ রা কাড়লো না। ঠোঁট টিপে বসে থাকলো।
সামনের দিকের মেয়েটির কাছে পেন চাইলাম রোল কল করবো বলে। কাছে আসতেই ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতেই ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল। বাবা পঙ্গু, মা বাড়ি বাড়ি কাজ করেন... ঘরের সব কাজ এমনকি রান্নাও তাকে করতে হয়। কলেজে আসার সময় পায় না। আগে একদিন মাত্র আমার ক্লাস করেছে।
এবার এক এক করে কাছে এনে নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। দু’জন শেয়ার মার্কেটে কাজ করার ট্রেনিং নেয়। ওটা ওই সকাল দশটা নাগাদ শুরু হয়। একজন দাদার ফুলের দোকানে ভোর থেকে বসে। দাদা বেলায় আসলে ওর ছুটি। আর একজন বসে দাদার ফলের দোকানে। দোকান থেকে ফিরে মিনারেল ওয়াটার বাড়ি বাড়ি পাঠায়। একজন জিমের ইন্সট্রাক্টর। অন্য আর একটি ছেলে মিও আমোরের দোকানে কাজ করে। কয়েকজন মুখ খোলেনি।
আমার গৃহসহায়িকার মেয়েটি এবছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে দেখা করতে এসেছে। আনন্দে তাকে হাজার খানেক টাকা হাতে দিয়ে বললাম নিজের খুশি মতো খরচ করতে। সে বি কম মেজর নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে আর ওই হাজার টাকা দিয়ে একটা চিরুনি কিনেছে। কলেজে পড়ার পাশাপাশি বিউটিশিয়ান হওয়ার শিক্ষানবিশী করবে, তার জন্য বিশেষ ধরনের চিরুনি চাই। এদের লড়াই দেখে গর্ব হয়।
কিন্তু নয়া শিক্ষানীতি লাগু হওয়ার পর ৮০- ৯০% পাশ কোর্সের ছেলেমেয়েরা ফেল করে যাচ্ছে।  তারপরও ওরা কেন পড়তে আসবে? এমন কোনও শিক্ষা তো আমি ক্লাসে দিতে পারছি না যা ওদের ভবিষ্যৎ জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য অনুকূল! কলেজগুলিতে ক্রমশ ছাত্রসংখ্যা কমছে। সায়েন্সের অবস্থা বেশ খারাপ। সায়েন্সের পাশ কোর্স আগেই প্রায় উঠে গিয়েছিল। অনার্সেও তলানিতে এসে ঠেকেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ে কেমিস্ট্রি অনার্সে ২০১৬ সালে তৃতীয় বর্ষে পরীক্ষার্থী ছিল ২০০০ এর উপরে। ২০২৩-২৪ এ সেটা নেমে এসেছে ৬০০ জনের কাছাকাছি। গতবছর নেপ শুরু হওয়ার পর ভর্তি হয়েছে ৪৩৬ জন। বিজ্ঞানের সব শাখায় একই অবস্থা। হিউম্যানিটিজের অনার্সের অবস্থাও তথৈবচ। হিউম্যানিটিজ পাশ কোর্সের ছাত্রসংখ্যা দিয়ে কোনরকমে কলেজ  চলছে। তাও বিরাট অংশ কলেজে নাম লেখায় স্কলারশিপের টানে। কন্যাশ্রীর ২৫০০০ টাকাটা পেতে পেতে ওদের স্কুলজীবন শেষ হয়ে যায়। টাকাটা হাতে এসে গেলে আর কলেজমুখো হয় না। এছাড়াও বিবেকানন্দ স্কলারশিপ, মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলের স্কলারশিপ, তফসিলি জাতি, উপজাতি স্কলারশিপ ইত্যাদি নানারকম আছে। এগুলো ওদের অধিকার, এগুলো পেয়েও কেন ক্লাসে আসছে না? আরও বড় কথা, এইসব স্কলারশিপের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজে ভর্তি হওয়ার হার বিপুলভাবে কমছে কেন? গ্র্যাজুয়েট না হলে মান থাকে না এই সংস্কারের বশে ওরা কিছু  সংখ্যায় এখনো আসছে এবং প্রতিবছর ব্যাপক হারে ফেল করছে। অচিরেই এই সংস্কার কেটে যাবে ... বিরাট অংশ কলেজ ফাঁকা হয়ে যাবে।
আচ্ছা কলেজের বাইরে ওদের সৎ পরিশ্রমকে কি এই "বিকাশশীল" ভারতের সমাজ যথেষ্ট মর্যাদা দেয়? দেয় না। তাই ওদের নিজেদের প্রকাশ করতে এত কুণ্ঠা! ফেসবুকে লেখাটার একটা অংশ প্রকাশ করেছিলাম। ওদের অনুমতি নিয়ে ক্লাসরুমের একটা ছবি তুলেও সেটিকে অস্পষ্ট করে দিয়ে পোষ্ট করেছিলাম, যাতে ওদের মুখগুলো চেনা না যায়। প্রাচীন ঐতিহ্যের গৌরবময় ভারতবর্ষ, প্রগতিশীল বাঙালির কাছে কায়িক শ্রমের মর্যাদা এরকমই।
পুনশ্চ: ফেসবুকে লেখাটা দেওয়ার পর অনেকের মতে জেনারেল কোর্স পড়ে কোনও লাভ নেই। স্কিল চাই। কেন্দ্র, রাজ্যও মোটামুটি তাইই চায়। সিবিসিএস’র সিলেবাসই Skill Enhancement Course (SEC) নামে সব বিষয়ে দুটো করে পেপার ঢোকানো হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের অপদার্থতায় আর্টসের যে সেক পেপারগুলো ঢোকানো হয়েছে তা বিপুল সংখ্যক সাধারণ ছেলেমেয়েদের কাছে অর্থহীন। যেসব বই রেফারেন্স হিসাবে দেওয়া হয়েছে তা ওদের পক্ষে বড্ড কঠিন। যেমন পঞ্চম সেমিস্টারে জেনারেলের ছেলেমেয়েদের জেন্ডার ইনইকুয়ালিটি পড়ানোর একটিমাত্র বই রেফারেন্স হিসাবে দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো রাধা কুমারের “ History of doing”. যারা একটা প্যারাগ্রাফ শুদ্ধ বাংলা লিখতে অক্ষম তাদের গ্রুপে আমি এই বইটার কপি ডাউনলোড করে পাঠাই আর ক্লাসে যেকজনকে পাই তাদের কাছে গল্পের মতো করে কিছু বলার চেষ্টা করি।
অন্যদিকে সায়েন্সের সেক পেপারগুলো বেশ। ফিজিক্সে Microcontroller, Aurduino, Latexইত্যাদি সম্পর্কে বেসিক কিছু পড়ানো হচ্ছে। কেমিস্ট্রির সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে Pharmaceutical chemistry, Pesticide chemistryএইসব। NEP আরও একধাপ এগিয়ে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ঢুকিয়েছে সিলেবাসে। অথচ আর্টসের চেয়েও সায়েন্সে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দ্রুতহারে কমছে। শুধু স্কিল থাকলে হবে না, তার প্রয়োগের জায়গাটা তো চাই! সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক থেকে পাশ করা হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা কি মাইনেতে চাকরি করছে, কত ঘণ্টা খাটছে, ক’দিন ছুটি পাচ্ছে তার খবর মধ্যবিত্ত সাধারণ বাঙালির একটা বড় অংশের কাছে বোধহয় পৌঁছায় না। শিল্পখরার এই রাজ্যে কোনও উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে থাকছে না। বাকিদের ভবিষ্যতের সঙ্গে আমার ইতিহাস ক্লাসের সাধারণ ছাত্রদের খুব একটা চরিত্রগত পার্থক্য নেই।
একজন জানিয়েছেন, ইতিহাস পড়ে কি হবে …তার চেয়ে মেকানিক হওয়া ভালো। খুব সময়োপযোগী কথা। উনি আমার মনোহরণ করে নিয়েছেন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতি প্রমাণিত। আমার ছাত্ররা অন্তত একবার পরীক্ষায় বসে নিজেদের যোগ্যতা/ অযোগ্যতা প্রমাণের সুযোগটুকু পর্যন্ত পেলো না। কলেজ সার্ভিস কমিশনের প্যান্ডোরার বাক্স খোলা এখনো বাকি। সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ নেই। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাগুলোতে হিউমানিটিজের ছেলেমেয়েরা বেশ ভালো ফল করত। ওদের পরিসরগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
আর সত্যিই সাহিত্য, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান পড়ে হবেটা কি? সরকার চিন্তাশক্তিহীন রিমোট নিয়ন্ত্রিত নাগরিক বানাতে চায়। শিক্ষাকে তাই দুর্মূল্য, দুর্বোধ্য করে অসার্বজনীন করে তোলার ব্যবস্থা কোমর বেঁধে করা হচ্ছে। কেউ সিদ্ধান্তে আসার আগে দয়া করে সেমিস্টার ভিত্তিক নেপের সিলেবাসটা ভালো করে পড়ুন। হয়তো বোঝা যাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের দূরে রাখার ব্যবস্থা কিভাবে পাকা করা হয়েছে।
ভরসা একটাই। মানুষের মস্তিষ্ক। প্রতিষ্ঠানের বাইরেও তা সচল থাকে। ইতিহাস মানুষই রচনা করে।

লেখক অধ্যাপক।

Comments :0

Login to leave a comment