BENGALI FILM INDUSTRY

বাংলা সিনেমা কেন বেহাল

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা রাজ্য

মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত সিনেমা চাই 

 

 

কমলেশ্বর মুখার্জি

 

দক্ষিণী সিনোমার ব্যবসা বাড়ছে, বাংলা সিনেমা সেখানে ধাক্কা খাচ্ছে কেন?

 

বাংলা ছবি অর্থনৈতিক ভাবে খুব ভালো করছে না, কিন্তু দেখতে গেলে বলিউডও ভালো করছে না। দক্ষিণী ছবিগুলো করছে। তার কারণ দক্ষিণের যে জনসংখ্যা, চার রাজ্যের বাসিন্দা ওই ছবি দেখে। বাংলা এবং হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে সেটা হয় না। দক্ষিণের ছবি ডাব করে বাংলা হিন্দির দর্শকরা দেখছে। সেটা বাঙালি পছন্দ করছে বলে দেখছে।

দক্ষিণী ছবির অনেক বেশ মনন সমৃদ্ধ, তাই সেগুলো কাজ করছে ভালো। বাংলায় মনন সমৃদ্ধ ছবি কিছু হয়েছে। সেগুলো মোটামুটি ব্যবসা করেছে ভালোই। এখন বলা যেতে পারে যে বাঙালি দর্শন মনন সমৃদ্ধ ছবিই চাইছে।

 

পুষ্পা, বাহুবলি হিন্দিতে মাল্টিপ্লেক্সে চলছে কিন্তু বাংলা সিনেমা মাল্টিপ্লেক্সে চলছে না, ভালো ব্যবসা করতে পারছে না কেন?

মাল্টিপ্লেক্সে এখন সিনেমা চলছে কারণ সিঙ্গেল স্ক্রিন অনেক কমে গিয়েছে। মাল্টিপ্লেক্সে যেতে মানুষের খরচ বেশি, টিকিটের দাম বেশি সেখানে। সেই কারণে অনেক ছবি আবার মাল্টিপ্লেক্সে ভালো করছে না, কিন্তু সিঙ্গেল স্ক্রিনে ভালো করছে। তবে সিঙ্গল স্ক্রিনে ছবি চালানোর খরচ বেশি মাল্টিপ্লেক্সের থেকে। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্স সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। সরকারি হলে টিকিটের দাম কম। কিন্তু সিনেমা কোনটা চলবে বা চলবে না সেখানে তো স্বজন পোষণ আছেই। যাদের সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থার যোগাযোগ আছে, ভালো সম্পর্ক আছে তারা হল পায়, যারা বিরোধী তাদের হল দেওয়া হয় না।

ওটিটি কি হলের ব্যবসায় ধাক্কা দিয়েছে?

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিনেমা জগতে একটা প্রভাব ফেলেছে। সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা কিন্তু একটা আলাদা অনুভূতি, সেটা ওটিটিতে নেই। তবে অনেক ছবি একসঙ্গে ওটিটিতে পাওয়ার ফলে দর্শকদের কাছে সবাই সমান গুরুত্ব পাচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।

 

কেমন ধরনের সিনেমা দর্শক চাইছে?

এই মুহুর্তে এই রাজ্যে যেই যে ঘটনা ঘটেছে তা প্রতিটা নিয়ে ছবি হতে পারে বলে মনে হয়। শুধুমাত্র খাগড়াগড় নিয়ে হয়েছে বলে লোকে দেখবে তা নয়। এমন সিনেমা যা মানুষের নিত্য দিনের সঙ্গে যুক্ত বা তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত এমন সিনেমা হলে তা মানুষকে টানছে। তবে মনে রাখতে হবে কতজন তা নিয়ে সিনেমা করতে চায় বা করার সাহস দেখাচ্ছে। 

 

বাংলা সিনেমাকে বাঁচাতে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন?

বাংলা ছবিকে বাঁচাতে গেলে অনেক হল তৈরি করতে হবে। ছবি দেখার খরচ কমাতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সের খরচ কমাতে হবে, মানে টিকিটের দাম কমাতে হবে। বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ম আছে যে তার নিজের রাজ্যে যে সিনেমা তৈরি হচ্ছে তা হলে চালানো বাধ্যতামূলক। এমন নিয়ম আমাদের রাজ্যে করতে হবে। মেইন স্ট্রিম কমার্শিয়াল ছবি যে মনন সমৃদ্ধ হয় তেমন তৈরি করার ঝুঁকি নিতে হবে। 

দেখুন ভিডিও

 

 

কয়েকজন প্রযোজকের হাত থেকে সিনেমাকে বের করতে হবে

 

চন্দন সেন

 

বাংলা সিনেমা কেন ধাক্কা খাচ্ছে, ভালো ব্যবসা তারা কেন করতে পারছে না?

 

বাংলা বাইরে বা ভারতবর্ষের বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যে বাঙালি আছে তাদের কাছে ছবি পৌঁছানো যাচ্ছে না সমস্যা হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ছবির বিষয়বস্তু। বাংলাদেশ যেটা নিচ্ছে সেটা বিশ্বজুড়ে যেই বাঙালিরা আছে তারা গ্রহণ করছে না। দক্ষিণী সিনেমাগুলো সঠিক প্রযোজক পায়। আমাদের এখানে কেউ কাউন্সিলর, এমপি, বিধায়ক হয়ে একশো কোটি টাকা রোজগার করেছে। এবার কিছু টাকা সাদা করতে হবে তারা এখন সিনেমা করছে। আমাদের এখানে দেড় কোটি টাকার ছবি হলে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু মানিকবাবুর মেঘর মতো সিনেমা গোটা বিশ্বের মানুষ দেখছে। এখান থেকে স্পষ্ট টাকাটা বড় কথা নয়। গল্প, বিষয় বস্তুটা আসল।

 

মাল্টিপ্লেক্সের জন্য কি বাংলা সিনেমা ধাক্কা খাচ্ছে?

মাল্টিপ্লেক্সে মানিকবাবুর মেঘবেশ ভালো ব্যবসা করেছে। প্রায় হাউস ফুল। নন্দনেও তাই। ফলত বিচার করা মুশকিল হচ্ছে। তবে মাল্টিপ্লেক্স যাঁরা পছন্দ করেন তাঁরা সিঙ্গল স্ক্রিনে যান না। চাহিদা আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

 

দর্শক কেমন সিনেমা চায়?

দর্শক কেমন সিনেমা চাইছে তার কোনও নিয়ম নেই। সময়ের দাবির ওপর সিনেমা তৈরি হয়। এবার এই মুহুর্তে অনেক দর্শক মনে করেন কেন আবার সিনেমায় গিয়ে একই জিনিস দেখবো যা রোজ দেখি? তাঁরা বিনোদন চায়। আবার অনেক মানুষ আছেন যাঁরা মনে করেন সিনেমা সমাজের দর্পণ, কিন্তু এই সংখ্যা অনেকটাই কম। বিনোদনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে এমনটা অনেকটাই কম।

 

সিনেমা বাঁচাতে কি করতে হবে?

কয়েকজন মাত্র প্রযোজকের হাত থেকে সিনেমাকে বের করতে হবে। অনেক স্বাধীন প্রযোজক,পরিচালক আছেন যাঁরা চান সিনেমা করতে, তাঁদের সুযোগ করে দিতে হবে। ফেডারেশনের যে চাপ যে এদেরকেই নিতে হবে না হলে কাজ করতে পারবেন না, সেটা হলে হবে না। এটা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। এখন সিনেমা অনেক বদলে গিয়েছে, বিষয়বস্তু বদলে গিয়েছে। 

সেন্সর বোর্ড, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশু রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুযায়ী যদি সিনেমা না হয় তাহলে তা তারা গ্রহণ করে না। এমন লোক রাখা হয় সেন্সর বোর্ডে। যারা শাসন ক্ষমতায় যায় তারাই এই কাজ করে।

 

খরচ, জাঁকজমকে পিছিয়ে বাংলা

 

শান্তিলাল মুখার্জি

 

দক্ষিণী সিনেমা পারছে, বাংলা সিনেমা কেন পারছে না ব্যবসা করতে?

পুষ্পা, বাহুবলী ভালো ব্যবসা করছে কারণ তার ব্যাপ্তি, জাঁকজমক। তাই সাধারণ মানুষ সেটা দেখতে যাচ্ছেন। বাংলা ছবির যে ব্যাপ্তি তাতে এটা করা সম্ভব নয়। তাই এত খরচ করতে পারছে না। তাও খরচ করে যেগুলো হয়েছে সেগুলো ভালো ব্যবসা করেছে। খাদান, বহুরূপী চলেছে। আসলে দর্শক যেটা দেখতে চাইছে সেই জাঁকজমক এখন করা মুশকিল।

 

দর্শক কেমন সিনেমা চাইছে?

আগে যে কনটেন্ট ছিল এখনও তাই আছে। কিছু নির্দিষ্ট কনটেন্ট আছে যা মানুষকে টানে। কেজিএফ, পুষ্পার কনটেন্ট নতুন কিছু নয়। আমরা এইগুলো ৯০এর দশকে দেখেছি। প্রজন্ম অনুযায়ী কীভাবে তাকে আনা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে। প্রভাত রায়, স্বপন সাহারা অনেক হিট ছবি দিয়েছে। তখন যা ছিল এখনও একই কনটেন্ট। আমরা ওটিটি দেখিনি, এখন আছে। তাই এখন মানুষ ওটিটির মতো জাঁকজমক চাইছে। আমাদের তা দিতে হবে। যদি তা দেওয়া যায় তাহলে মানুষ দেখছে।

 

কি করলে বাংলা সিনেমা উন্নতি করা যাবে?

কিছুদিন আগেই শুনছিলাম চিরঞ্জিতদা বলছে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো সিনেমা এখন আর হিট হবে না। কারণ ওটা যখন মুক্তি পায় তখন বাংলায় সিনেমা হলের সংখ্যা ৭০০ থেকে ৭৫০। আমার কোনও প্রোডাক্ট যখন আমি ৭৫০ দোকানে দেবো, তার যা বিক্রি হবে, সেটা যদি ৪০টা দোকানে দেওয়া হয় তার কি বিক্রি হবে? এখন অত হিট ভাবাই যাবে না কারণ হলের সংখ্যা কমেছে। সাধারণ মানুষ যে হলগুলোয় যেতে পারে তা বন্ধ হয়েছে। মাল্টিপ্লেক্স হয়েছে, কিন্তু সবাই সেখানে যেতে পারে না। কিন্তু যে সাধারণ মানুষ সিনেমা দেখে তাঁরা দেখতে পারছেন না। আমাদের অনেক জেলা সদর আছে যেখানে সিনেমা হল নেই। তার সঙ্গে মানুষকে কাছে টানার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে সিনেমাটার। একটা কোন কারণের জন্য বাংলা সিনেমার ব্যবসা খারাপ হচ্ছে না। অনেকগুলো সমস্যা একসঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখন সিনেমা সব হলে ডিজিটালি চলে তাতে হিন্দি ছবি চালাতে যে খরচা, বাংলা ছবি চালাতে আরও খরচা, এটা একটা সমস্যা। অনেক সমস্যা জড়িয়ে আজ এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

 

 

বাঙালি তার ঘরানার সিনেমা চাইছে

 

মানসী সিনহা

 

বাংলা সিনেমায় দর্শক কেন কমছে?

এই কথা ঠিক একটা সময় বাংলা সিনেমার প্রতি দর্শকদের মধ্যে একটা অনীহা তৈরি হয়েছিল। তাঁরা হলে আসছিলেন না। কিন্তু এখন আসছে। কম বেশি সব সিনেমায় দর্শক হচ্ছে। এবার দক্ষিণী সিনেমার তো দর্শক আছে এটা ঠিক। ডাব হয়ে হিন্দিতে হলে তাতেও দর্শক হয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলা সিনেমা দেখার জন্য বাঙালি দর্শক আছে। এখন কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে তাই আমাদের দর্শক ফের আসছেন।

কেমন সিনেমা দর্শক চাইছে ?

সোজা কথা বাঙালি বাংলা সিনেমা চাইছে। বাঙালি ঘরানার সিনেমা চাইছে। কেন দক্ষিণী সিনেমার রিমেক হবে বাংলায়? আর সেই সিনেমাই বা কেন দর্শক দেখতে যাবে? এই রিমেকের জন্যই তে মানুষ মুখ ঘুরিয়েছিল।

বাংলা সিনেমার উন্নতির জন্য কি কি করা দরকার?

আমাদের দায়িত্ব দর্শককে ভালো সিনেমা উপহার দেওয়া। সেই কাজ করতে হবে। লোক ডাকবো ভালো রান্না করে খাওয়াবো না তা তো হয় না। ভালো সিনেমা করতে হবে, ভালো কনটেন্ট তৈরি করতে হবে তবে দর্শক আসবে। এখন কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে তাই আসছে। 

Comments :0

Login to leave a comment