রণদীপ মিত্র
এক নড়বড়ে বাঁশের মাচা। পাগলা নদী পারাপারের একমাত্র সম্বল। সেই মাচাই আজ নদীপাড়ের গতরে খাটা জনপদের একতার স্মারক। যা দিনের আলো দেখেছে দুখু মালের শ্রমে, অভাবী নাসিমের জেদে। এমন অসংখ্য দুখু মাল, নাসিম শেখদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের জেদই তো বেআব্রু করেছে সরকারের ব্যর্থতা। বিভেদের নূন্যতম স্বর জায়গা পায়নি সেই মহল্লায়। বরং গ্রামের স্বার্থে, সুস্থ জীবন যাপনের স্বার্থে নদীপাড়ে একতার সুরই জমাট বেঁধেছে এক মাচাকে ভর করে।
বীরভূম-মুর্শিদাবাদ সীমান্তের অঞ্চল আমডোল। সেই অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রাম খুটকাইল, রামচন্দ্রপুর সহ আরও বেশ কিছু। বীরভূমের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বুক চিরে বয়ে গিয়েছে পাগলা নদী। নদীর পূর্বপাড়ের জনপদ এগুলি। রাজ্যে বয়ে ‘উন্নয়নে’র জোয়ারের ধাক্কায় ধাক্কায় বেসামাল হয়েছে হতদরিদ্র এই জনপদগুলি। নদী পেরিয়েই গ্রামে পৌঁছাতে হয় হাজারো মানুষকে। গ্রামের চাপে নদীর বুকে নির্মিত হয়েছিল কজওয়ে। কিন্তু টেঁকেনি এক বছরও! এক বর্ষায় হয়েছে দফারফা, ‘উন্নয়নে’র জোয়ারে নির্মাণের পড়ে পড়েই কজওয়ে ধসে একাকার হয় পাগলা নদীর সঙ্গে।
নদীপাড়ে ক্ষোভ স্বাভাবিকভাবেই তুঙ্গে ওঠে। অভিযোগ উঠেছে নির্মাণের মান নিয়ে। তারপরে আর সাড়া শব্দ মেলেনি সরকারের। কান পেতে কেউ শোনেনি নদী পারাপারের যন্ত্রণার কাহিনি। অগত্যা জেদ নেয় গোটা মহল্লা। তাতে শামিল হয়েছেন পেশায় জেলে দুখু মাল, তার প্রতিবেশী বছরের অধিকাংশ দিন চেন্নাইয়ে থাকা পেশায় রাজমিস্ত্রি নাসিম শেখদের মত মানুষ। পরিবার পিছু ধার্য হয় তিনশো টাকা চাঁদা। গাঁ বাঁচানোর অনুদান। বেঁচে থাকার লড়াইয়ের রসদ। একজোট হয় মানুষ। নিজেরাই দেয় শ্রম। পাগলা নদীর বুকে তৈরি হয় বাঁশের মাচা। মাচা আজ শুধু প্রাণের স্পন্দন নয়, সম্প্রীতির স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাগলা নদীর বুকে। নাসিম শেখ, দুখু মালদের আত্ববিশ্বাস, ‘‘আর কাউকে ভরসা করি না। আমরা এক থাকলে কোনও বাধাই গ্রামের কিছু করতে পারবে না। আমরা এক হয়েছি। তাই সরকার না দেখলেও সামান্য সাচ্ছন্দ্যের বন্দোবস্ত করেছে গ্রামের মানুষই।’’ কোনও এক প্রান্তিক গ্রামের সামান্য এক উদ্যোগের নজির হলেও পাগলা নদীর এই মাচাই তো গ্রাম বাংলার সম্প্রীতির প্রকৃত প্রতীক।
ধর্ম, জাত,বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গ্রাম বাঁচানোর প্রত্যয়ের নজির কি ওই একটি ? না। আছে আরও। যেখানে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ নয়, বরং অটুট ঐক্য সব বিপদ ফুৎকারে উড়িয়েছে।
উদাহরণ বীরভূমেরই লোহাপুর। সেখানেও সর্বেশ্বর, সতীশ, সুভাষদের সঙ্গে জিয়ারত, আলালদের বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের সাক্ষী হয়েছে ব্রাহ্মণী নদীর পাড়ের বলরামপুর, কুতুবপুর, মির্জাপুর, কুন্ডপাড়া, হামিদপুর সহ কত গ্রাম। বিনিময়ে আজও শুনতে হচ্ছে হূমকি। থেকে থেকেই আসে শাসানি। কিন্তু তা সর্বেশ্বর-আল্লালদের জোটের কাছে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায় বারবার। এলাকার প্রাণ ব্রাহ্মণী নদী। সেই ব্রাহ্মণীর গর্ভ থেকে বেপরোয়া বালি লুট জাঁকিয়ে বসেছিল। গ্রামের মানুষেই স্পষ্ট কথা, শাসকদল আর পুলিশের মদতেই তো নদী গর্ভ ক্ষতবিক্ষত করে চলছিল বেপরোয়া বালি লুটের কারবার। চিন্তার ভাঁজ পড়ে গ্রামের মানুষের কপালে। নদীপাড়ের কাঁচা বাড়িগুলির অস্তিত্ব রক্ষা সঙ্কটের মুখে পড়ে। বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি। দিনরাত এক করে দেদার লুট অতিষ্ট করে তোলে হাজার হাজার মানুষকে। গ্রাম বাঁচানোর তাগিদে এখানেও রুখে দাঁড়ান সুজন, সঞ্জীব,সতীশ, এনামুল, খায়রুলরা। নদীপাড় অবরুদ্ধ করে। আটকে দেওয়া হয় বালি পাচার। জল গড়ায় বহুদূর। পুলিশ ময়দানে নামে। শাসকদলের নেতাদের চোখ রাঙানি আছড়ে পড়ে গ্রামে। কিন্তু টলাতে পারেনি গ্রামের ঐক্যকে। গাঁ রক্ষার লড়াই, সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার শপথ নিয়ে একজোট হওয়া মানুষের মেজাজের কাছে ধাক্কা খায় লুটেরাদের ভয়াল থাবা। সর্বেশ্বর লেটের কথায়, ‘‘সামনে দাঁড়িয়েছিলাম বলে কত হুমকি এসেছে। এখনও আসছে। পুলিশ রীতিমত শাসিয়েছে। সেই কঠিন সময়ে সর্বক্ষণের জন্য পাশে ছিল জিয়ারত, আল্লালরা। এটাই তো আমাদের শক্তি।’’ সেই শক্তির দাপটেই তো ব্রাহ্মণীর গর্ভে আর নামে না মেশিন। গ্রাম কাঁপিয়ে দিনরাত লরি, ডাম্পারের চলাচল এখন বন্ধ। ব্রাহ্মণী আপন গতিপথে বয়ে চলেছে একরাশ স্বস্তি নিয়ে। ব্রাহ্মণীর পাড়ের লড়াকু মেজাজে গোটা মহল্লায় আপাতত বইছে নিশ্চিন্তির বাতাস। সেই বাতাসে নেই কোনও বিভাজনের সুর।
Comments :0