প্রদোষ কুমার বাগচী
এ রাজ্যের মার্কসীয় ও প্রগতিশীল সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালার নাম ‘মুজফ্ফর আহ্মদ পাঠাগার’। মুজফ্ফর আহ্মদ ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৪ সালে তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে তাঁর জন্মদিনে তাঁর নামেই স্থাপিত হয়েছিল এই পাঠাগার। রাজ্যের সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য মার্কসীয় ও প্রগতিশীল পুস্তকাদির একটি বিশেষ গ্রন্থাগার গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু আধুনিক গ্রন্থাগারের উপযোগী বড় পরিসর সমৃদ্ধ স্থায়ী ভবন না থাকায় পাঠাগারটিকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল। আজ পাঠাগারটি তার ৫০ বছর অতিক্রম করতে চলেছে। অতিক্রমণের এই গৌরবজনক পথ ধরে অর্জিত সাফল্যই মুজফ্ফর আহ্মদ পাঠাগারকে আজ পাঠক সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী করে তুলেছে। বিদেশের পাঠকের কাছেও মার্কসীয় ও প্রগতিশীল সাহিত্যের পাঠাগার হিসাবে আজ এটি খুবই পরিচিত নাম।
কলকাতা শহরের মৌলালির কাছে ৭৯/৩এ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোডের যে বাড়ি এখন ‘দীনেশ মজুমদার ভবন’ নামে পরিচিত, সেই বাড়িতেই ১৯৭৪ সালের ৫ আগস্ট উদ্বোধন হয়েছিল এই পাঠাগারের। উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি ‘মুজফ্ফর আহ্মদ পাঠাগার’ স্থাপনের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা এবং তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেদিন থেকে পার্টির পরিচালনায় পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার হিসাবে বিকশিত হওয়ার প্রতিশ্রতি নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই পাঠাগার। প্রমোদ দাশগুপ্ত ছিলেন সেই সময়ে পার্টির রাজ্য সম্পাদক।
মুজফ্ফর আহ্মদের একটি স্বপ্ন ছিল মার্কসীয় ও প্রগতিশীল সাহিত্যের একটি সাধারণ গ্রন্থাগার গড়ে তোলার। তার আগে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের তিনটি স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পিআরসি, গণশক্তি প্রেস এবং ন্যাশনাল বুক এজেন্সি গড়ে তোলার কাজে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু পার্টি পরিচালিত সাধারণ গ্রন্থাগার স্থাপনের কাজ অধরা ছিল। তিনিও লেনিনের মতোই মনে করতেন, বৌদ্ধিক চিন্তা দিয়ে বিপ্লবের কাজে সাফল্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে হলে অধ্যয়ন অপরিহার্য। সে কাজ কেবলমাত্র গণশক্তি প্রেস ও এনবিএ’র দ্বারা সম্ভব নয়। এর জন্য একটি সুপরিকল্পিত ও সুসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে, যার মাধ্যমে মানুষ কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে সহজে জানা-বোঝার সুযোগ পাবেন। তার জন্য মার্কসীয় ও প্রগতিশীল সাহিত্যের একটা সাধারণ গ্রন্থাগার (পাবলিক লাইব্রেরি) গড়ে তোলা দরকার। যেখানে কেবল কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরাই নয় সামগ্রিকভাবে বামপন্থী ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার সাথে যুক্ত সাধারণ মানুষও বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারে হাত বাড়াতে পারবেন ও ব্যবহার করতে পারবেন— এই ছিল তাঁর একটি প্রধান ভাবনা। এমনকি জীবনের শেষদিনগুলিতে কিম্বার নার্সিংহোমে ভর্তি থাকাকালীনও তিনি একটি আদর্শ গ্রন্থাগার স্থাপনের কথা ভাবতেন। অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সেই স্বপ্ন মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর নামাঙ্কিত ‘মুজফ্ফর আহ্মদ পাঠাগার’ স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
পরাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি ভালো করে দাঁড়ানোর আগেই কানপুর, পেশোয়ার ও মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার মধ্য দিয়ে পার্টিকে অঙ্কুরে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। পরে পার্টিকে বেআইনি করা হয়েছিল। ফলে গ্রন্থাগার তৈরির ভাবনা ও সুযোগ কখনোই সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তিগত সংগ্রহ বা ইতঃস্তত বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা স্টাডি সার্কেলই ছিল ভরসা। ১৯৪২ সালে সোমেন চন্দের স্মৃতিতে একটি গ্রন্থাগার গড়ে উঠলেও সেটাকে ধরে রাখা যায়নি। পরে পার্টির প্রাদেশিক কমিটির প্রয়োজনে কোনোরকমভাবে একটি গ্রন্থাগার তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের পার্টি চিঠিতে বলা হয়েছিল ‘‘...বাংলাদেশের মতো বিরাট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির লাইব্রেরি একটি দেখিবার বিষয় হওয়া প্রয়োজন।’’ কিন্তু দুঃখজনক ‘বঙ্গভঙ্গ’-র আঘাত ও পরবর্তীকালে পার্টি বেআইনি হওয়ার পরিণতিতে সেই গ্রন্থাগারও উঠে গিয়েছিল।
পরে ১৯৫০-এর দশকে পার্টি নেতারা জেল থেকে বেরিয়ে ৬৪এ, লোয়ার সার্কুলার রোডে একটি ছোট গ্রন্থাগার তৈরি করেছিল। অবশেষে ১৯৬৪ সালে পার্টি বিভাজনের প্রাক্কালে পার্টি কর্মীদের বিপ্লবী শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ঐ বছরের ১৪ মার্চ আবদুল হালিমের সভাপতিত্বে ‘ইনস্টিটিউট অব মার্কসিজম-লেনিনিজম’ নামে একটি সেন্টার গঠনের জন্য সভা হয়েছিল। আবদুল্লাহ্ রসুল, সুশীতল রায়চৌধুরি, দীনেশ রায়, পীযূষ দাশগুপ্ত, সুরেন দত্ত, তারাপদ মুখার্জি, কাটু বোস, মহাদেব সাহা, রথীন দেব, অসিত সেন, সরোজ দত্ত এবং সমর মুখার্জিদের উপস্থিতিতে একটি সভা থেকে ‘ইনস্টিটিউট অব মার্কসিজম –লেনিনিজম’কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং বলা হয় ঐ সেন্টারে এমন একটি উচ্চমানের গ্রন্থাগার তৈরি করতে হবে, যা ভারতীয় সমাজের ধারণা, আদর্শবাদ ও দর্শনের উপরে গবেষণা পরিচালনা করবে এবং একটি তাত্ত্বিক মুখপত্রও প্রকাশ করবে। সর্বোপরি এই ইনস্টিটিউট জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কিছুদিনের মধ্যে ১৭২/২ধর্মতলা স্ট্রিটে এই ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন হলেও পুলিশি দমননীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সে কাজ আর এগোয়নি। এই সময় সংশোধনবাদ ও সঙ্কীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই আরও তীব্র হয়।
মুজফ্ফর আহ্মদের মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তাঁর মৃত্যুর পর পার্টি তাঁর শেষ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে তাঁর নামেই একটি গণ-গ্রন্থাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণ মানুষ যাতে গ্রন্থাগারটি ব্যবহার করতে পারে সে কথা ভেবে প্রমোদ দাশগুপ্ত গ্রন্থাগারকে পার্টি অফিসের বাইরে, কিন্তু পার্টি অফিসের কাছাকাছি কোনও প্রশস্ত বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অবশেষে ৭৯/৩এ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোডে একটি বাড়ি ৫০০ টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়। রাজ্য কমিটির নিজস্ব সংগ্রহের সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দিয়ে ১৯৭৪ সালের ৫ আগস্ট মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মদিনে সেই গ্রন্থাগারের সূচনা হয়। একটানা সাত বছর সেখানে চলার পর স্থানাভাব দেখা দিলে সাময়িকভাবে ৩৩ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পাঠাগারটি স্থানান্তরিত হয়। এইভাবে ১৯৮১ সালের ৫ আগস্ট থেকে ঐ গ্রন্থাগারের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। সেই সময়ে পাঠাগারের নতুন কক্ষের উদ্বোধন করেছিলেন পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ। পরে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পার্টি অফিসের নতুন ভবন তৈরি হলে সেখানেই অনেকটা বড় ঘরের ব্যবস্থা করে ‘মুজফ্ফর আহ্মদ পাঠাগার’-এর তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। বেশ কিছুদিন চলার পর ঐ পাঠাগারের পুনঃসম্প্রসারণের প্রয়োজন দেখা দিলে ১৯৯৭ সালের গোড়ার দিকে ৭৪এ, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের উপর ‘গণশক্তি’র নতুন ভবনের পঞ্চম তলায় ঐ পাঠাগারের সম্প্রসারিত অংশ চলে আসে এবং গণশক্তির পরিচালকমণ্ডলীর পরামর্শ ও সহযোগিতায় সেই পাঠাগার আরও আধুনিক চেহারায় বিকশিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেই সময়ে কমরেড শৈলেন দাশগুপ্ত ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক। আর অনিল বিশ্বাস ছিলেন গণশক্তি’র সম্পাদক। ১৯৯৭ সালের ৫ আগস্ট চতুর্থ পর্যায়ে সংগঠিত সেই পাঠাগারের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পলিট ব্যুরোর সদস্য এবং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
গ্রন্থাগারের নিয়ম মেনে যে কোনও আগ্রহী গবেষক-পাঠক এই পাঠাগার ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিদিন দুপর ১২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই পাঠাগার। রবিবারের দিনগুলিতে বিকাল ৩টা থেকে ৮টা পর্যন্ত পাঠাগার ব্যবহার করার সুযোগ আছে। ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পাঠাগারটিও নিয়মিত খোলা থাকে। সেখানেও রয়েছে নানা পত্রপত্রিকা ও দুর্লভ গ্রন্থের সম্ভার। মুজফ্ফর আহ্মদ, প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখার্জি, আবদুল হালিম, অনিল বিশ্বাস, দীপেন ঘোষ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্য মিশ্র, উল্লোল সেন মৃদুল দে, অধ্যাপক নবকুমার নন্দী, চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার প্রমুখ বহু মানুষ এই গ্রন্থাগারে তাঁদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দান করেছেন। বহু নতুন বইও কেনা হয়েছে। মার্কসীয় ও প্রগতিশীল সাহিত্যের বহু দুর্লভ গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা এই গ্রন্থাগারের সম্পদ। এখানে সোমনাথ লাহিড়ী, জ্যোতি বসু, ভুপেশ গুপ্ত, সরোজ মুখার্জি সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা’, জ্যোতি বসু সম্পাদিত ‘মতামত’, ১৯৩৪ সালে সরোজ মুখার্জি প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি ‘গণশক্তি’, পরে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত সুভাষচন্দ্র বসুর শুভেচ্ছাবাণী সহ নবপর্যায়ের ‘গণশক্তি’ ইত্যাদি পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’, ‘মঞ্জিল’, ‘শিবির’, বাংলা ‘জনযুদ্ধ’ ও ‘People’s War’, ‘Cross Road’ ‘National Front’, People’s Age’, New Age’, Daily Worker, China-India Review, জ্যোতি বসু সম্পাদিত People’s Democracy-র মতো অতি মূল্যবান ও দুর্লভ পত্রপত্রিকা। রয়েছে ‘গণশক্তি’সান্ধ্য দৈনিকের প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে প্রতিটি সংখ্যার আসল ও মাইক্রোফিল্ম কপি। রয়েছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুর্লভ দলিল। ৫০ বছরে তার গৌরবময় অর্জনও কিছু কম নেই। বর্তমানে দুটো স্থান মিলিয়ে গ্রন্থ সংগ্রহের পরিমাণ কমবেশি ৪০ হাজার। এখানেই রয়েছে নিউজপেপার ক্লিপিংসের এমন এক বিশাল সংগ্রহ, যার তুলনা এই রাজ্যে তো বটেই, দেশেও বিরল।
মুজফ্ফর আহ্মদ ছিলেন এমন একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট যিনি মনে করতেন পুরানো পৃথিবীর আবর্জনা সরিয়ে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে না পারলে মানুষের মুক্তি নেই। সেই মহান কর্তব্যে কর্মের পথ ধরে এই পাঠাগারকে যদি মার্কসীয় ও প্রগতিশীল সাহিত্যের সাধারণ গ্রন্থাগার হিসাবে মুজফ্ফর আহ্মদ যেমন চেয়েছিলেন, মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারা যায়, তাহলেই তাঁর স্মৃতির প্রতি আমরা যথাযথ সম্মান জানাতে পারবো।
Comments :0