গৌতম রায়
সুরেশ দত্ত সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। ১৯৩০-এ অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলাতে তাঁর জন্ম। গাঁয়ের নাম ছিল হুতসিবাড়ি। গোয়ালন্দের ইলিশ আর হাজারিগুড় তখন মিলে মিশে আছে। কোটালিপাড়ার সংস্কৃতচর্চার আবেশ তখন ফরিদপুরের শিক্ষিত হিন্দু- মুসলমান, সব বাঙালিকে একটা ইতিবাচক আত্মাভিমানে নিবিষ্ট করে রেখেছে। জাতীয় আন্দোলনের ধারা তখন প্লাবিত করে রেখেছে ফরিদপুরকে। স্বদেশি সংস্কৃতির চর্চার সঙ্গে সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষিত, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উত্তাপ, কেবল ফরিদপুর নয়, গোটা পূর্ববঙ্গেই তখন প্রবল প্রতাপে নিজেকে মেলে ধরছে।
গ্রাম বাংলার লোক সংস্কৃতির যে ধারার প্রচলন গত শতকের তিন - চারের দশকে ছিল, সেটি যেন প্রকৃতিগত ভাবেই সুরেশ দত্তকে ছোট থেকেই বাইরের দুনিয়াকে চিনিয়ে দিয়েছিল। সেকালে লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে ব্রিটিশের অত্যাচার আর স্বদেশিদের গৌরবগাথা, একটি সন্মিলিত ধারায় প্রকাশ পেত। লোকশিল্পীরা, বাউল, কবিয়ালেরা ব্রিটিশের চোখ রাঙানির পরোয়া করতেন না। নিজেদের মনের ভাবনাকে নিঃসঙ্কোচে তাঁরা মেলে ধরতেন।
স্থানীয় পুলিশ নানাভাবে শিল্পীদের উপর হানাদারি চালাতো। বিচার ব্যবস্থায় জুরিদের যে প্রভাব ছিল, গ্রামীণ পুলিশ-প্রশাসনের ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ তোষামোদকারী একদল লোক ছিল বিশেষ রকমের প্রভাবশালী। সাধারণ নাগরিকদের উপর তারা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দের নিরিখে নানাভাবে তারা ব্রিটিশ পুলিশের বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের স্টিম রোলার চাপিয়ে দিতো।
দেশভাগের অল্প পরেই সুরেশবাবু চলে আসেন এপার বাংলায়। উদ্বাস্তু জীবনের সেই লড়াইয়ে তিনি সঙ্গী করে নেন তখনই চিল্ড্রেন লিটল থিয়েটারকে। দেশভাগ কালের সেই সংশয় তিমিরের মধ্যেই এই চিল্ড্রেন লিটল থিয়েটার তখন বাংলার সংস্কৃতির লুপ্তপ্রায় ধারাকে আবার জাগিয়ে তুলতে প্রাণপণ লড়াই শুরু করেছে। এই লড়াইয়ের আঙ্গিক ও গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতিতে যে ভাবে যুগ যুগ ধরে সমসাময়িকতার ছাপ পড়তো, তার আদলটি প্রথম থেকেই ছিল স্পষ্ট।
দেশভাগ মনুষ্যত্বের যে সঙ্কট ডেকে এনেছে, তাকে লোকজ সংস্কৃতিতে কীভাবে একটা সমাজমনষ্ক চেতনায় উদ্ভাসিত করতে পারা যায়, সেই ভাবনা থেকেই এই সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততা তৈরি হয়ে গেল সুরেশ দত্তর। অবন পটুয়া, ডিডো, মিঠু— তাঁদের সৃষ্টি হলো সুরেশ দত্তর উৎসাহে।
গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুতুল নাচ পেল নতুন প্রাণ। দেশভাগের অব্যবহিত পরের আর্থ- সামাজিক সঙ্কট, তীব্র বেকারি, উদ্বাস্তু জনস্রোতের নানা সঙ্কট। কেবলমাত্র মাথা গুঁজে বেঁচে থাকাটাই তখন এই ছিন্নমূল মানুষদের কাছে জীবন মরণের সঙ্কট। সমসাময়িক নানা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ। খাদ্য সঙ্কট। তাকে ঘিরে আন্দোলন।
এমন এক ভয়াবহ সামাজিক আবর্তের মধ্যে এই অবন পটুয়ার দল যেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘নবজীবনের গান’-এর সুরে বলে উঠলো ‘ভেঙে পড়া গ্রামে প্রাণের দুর্গ ফিরে বানাও।’ যখন দেশভাগ জনিত সঙ্কট বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিকে প্রায় ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে , সেই কালে সুরেশ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সুরেশ দত্ত অবিভক্ত বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা পুতুল নাচকে, যে নাচের কোনও কদরই নাগরিক সংস্কৃতিতে সে সময়ে ছিল না, তাকে সংস্কৃতির মূল স্রোতে তুলে ধরেছিলেন।
নিস্তরঙ্গ গ্রামের পুতুল নাচকে তিনি আবার বাংলা সংস্কৃতির প্রতিনিধি করে তুলেছিলেন। নিজের পূর্ববাংলার অভিজ্ঞতাকে তিনি আরো ঋদ্ধ করেছিলেন দেশভাগ উত্তর কালে এপার বাংলার গাঁয়ে গাঁয়ে তখন ও পুতুল নাচের যেটুকু সাবেকিয়ানা টিকে ছিল- তার সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি করে। এই পর্বে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার নানা আঙ্গিক তিনি আত্মস্থ করেছিলেন।
পূর্ববঙ্গের লোকজ সংস্কৃতিতে বিশ শতকের শুরুর সময় থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতার একটা ছাপ পড়তে দেখা যায়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পূর্ববঙ্গের সামাজিক জীবনে, কলকাতা কেন্দ্রিক সামাজিক - রাজনৈতিক অঙ্গনের মত তত প্রবল প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা অল্প কিছুকাল পরে ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা- এগুলির মাঝে সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলন কর্মসূচিগুলি ধীরে ধীরে সলতে পাকাচ্ছিল। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর, বরিশাল ইত্যাদি জেলার মতোই এই সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মসূচি মেদিনীপুর জেলাকে কেন্দ্র করেও বেশ জোরদার ভাবে সলতে পাকানোর কাজ চলছিল।
মেদিনীপুরের লোকজ সংস্কৃতিতে ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান থেকে শুরু করে বার্জ হত্যা— এসব কিছুই ধীরে ধীরে ছাপ ফেলতে শুরু করে। পূর্ববঙ্গের মতোই এখানকার লোকজ শিল্পীরাও হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ পুলিশের টার্গেট। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এইসব শিল্পীদের প্রতিভা, মনন, মেধার সন্মিলনের ক্ষেত্রে সুরেশ দত্ত অসামান্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। পুতুলনাচের ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গে আঙ্গিকের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আঙ্গিকের, অঞ্চলভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের একটা সংযোগ ঘটিয়ে লোকজ শিল্পের ক্ষেত্রে তিনি একটা অভিনবত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
লোকজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই সমন্বয়ের ভাবনার উপাদান হিসেবে সুরেশ দত্তের দীর্ঘদিন সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের অভিজ্ঞতার একটা বড় ভূমিকা আছে। ’৬২ সালে সরকারি বৃত্তিতে সুরেশবাবু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। তার আগেই তিনি ধ্রুপদী নাচের তালিম নিয়েছিলেন উদয়শঙ্করের কাছে। ভরতনাট্যম আর মণিপুরী নৃত্যে সুরেশবাবুর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে। ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের কাছে শিখেছিলেন অভিনয়। পরবর্তী জীবনে এই নাচ আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শিতা সুরেশ দত্তের শিল্প প্রতিভার স্ফুরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
সুরেশ দত্তর বয়স হয়েছিল ৯৪। পুতুল নাটকের দল তৈরি করেন ১৯৫৪ সালে ‘কলকাতা পাপেট থিয়েটার’। যোগাযোগ ঘটে খালেদ চৌধুরী, তাপস সেন, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, উৎপল দত্ত, ভি বালসারার মতো গুনিজনদের সঙ্গে। সুরেশ দত্তের নির্দেশনায় একের পর এক সাড়া জাগানো পুতুল নাটকের মধ্যে আলাদীন, রামায়ণ, মা, ছোটদের জন্য ইচ্ছাপূরণ, দত্যি দানা, কালো হীরে, আজব দেশ উল্লেখ্যযোগ্য। পুতুল নাটকের পাশাপাশি নাটকের মঞ্চ নির্মাণে নিজস্ব দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ নাটকের মঞ্চ নির্মাণ করে নাট্য জগতে সাড়া ফেলে দেন। এরপর টিনের তলোয়ার, অ্যান্টনি কবিয়াল, নাম জীবন, পান্নাবাঈ, মাধব মালঞ্চী কইন্যা, নৈশ ভোজ-এর মতো নাটকের মঞ্চ নির্মাণ করেন। আবার কলামন্দির থেকে জ্ঞান মঞ্চ, উত্তম মঞ্চ থেকে শরৎ সদন— কলকাতার বহু স্থায়ী মঞ্চ নির্মাণের পিছনে রয়েছে তাঁর ভাবনা। পু১৯৮৬ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি এবং ২০০৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার অর্জন করেন।
রুশদেশের প্রখ্যাত পুতুলনাচ শিল্পী মের্গেই ওব্রেজ টসভের কাছে তালিম সুরেশ দত্তের জীবনের একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই পর্বের কথা তিনি নিজের কর্মজীবনের নানা অধ্যায়ে বার বার বলেছেন। শৈশব - কৈশোরের অভিজ্ঞতা, প্রথম যৌবনে দুই বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় এক বছর ধরে সোভিয়েট দেশের পথে প্রান্তে সেখানকার লোকজ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচয় এবং সেই ধারাকে আত্মস্থ করা, এই পর্বটিই সুরেশ দত্তকে ভারতীয় সংস্কৃতির দুনিয়াতে একটা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। ‘কল্লোল’ বা ময়মনসিংহ গীতিকার নির্যাস ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী প্রমুখ অভিনীত সম্পূর্ণ পেশাদার থিয়েটার ‘নামজীবন’— মঞ্চ নির্মাণে অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন সুরেশ দত্ত। আমাদের সংস্কৃতির মূল যে লুকিয়ে রয়েছে লোকজ সংস্কৃতির অন্দরে, নিজের সমাজচেতনার অভিব্যক্তি দিয়ে সেটা বুঝেছিলেন তিনি। আর সেই বোধেরই সার্বিক প্রকাশ, তাঁর জীবন এবং সৃষ্টি।
Suresh Dutta
ফরিদপুর, সোভিয়েত আর পুতুলের প্রাণ
×
Comments :0