দেবাশিস মিথিয়া
২২ বছর কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে (মেইন) শিক্ষকতা করার পর, ইংরেজির এক শিক্ষক নিজের স্কুলে নিজেই এখন 'উদ্বৃত্ত'। সরকারি শিক্ষার মান উন্নয়ন যজ্ঞে তাঁকে মিত্র ইনস্টিটিউশনে আর প্রয়োজন নেই। তাঁকে প্রয়োজন, পাথরপ্রতিমার ব্রজ বল্লভপুর-২’র ‘রক্ষাকালী হাই স্কুলে’। বাড়ি থেকে ১৪৫ কিমি দূরে প্রশাসনিক বদলি, পরিভাষায় যাকে বলে, অ্যাডমিনস্ট্রেটিভ ট্রান্সফার।
সমস্যাটা শুধু এখানেই নয়, গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। দেখা যাচ্ছে, স্কুল শিক্ষা সংক্রান্ত, সরকারি দুটি কর্মসূচি, পরস্পর হয়ে দাঁড়াচ্ছে পরস্পরের ঘোর বিরোধী। 'উৎসশ্রী' প্রকল্প শিক্ষার মানোন্নয়নের তাগিদে শিক্ষককে ফিরিয়ে আনছে ঘরের কাছে আর 'র্যা শনালাইজেশন অব টিচার' সেই শিক্ষককেই ঠেলে দিচ্ছে উৎস থেকে বহু দূরে। এ বদলি কিন্তু বাধ্যতামূলক। আর এই সরকারি টানাপোড়েনেই ত্রাহি রব উঠেছে শিক্ষক মহলে।
সরকারের 'উৎসশ্রী' প্রকল্পের কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গের বহু স্কুল শিক্ষকের জীবনে সবে যখন একটু স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই 'র্যা শনালাইজেশন অব টিচার' শিক্ষকদের একাংশের কপালে শুধু ভাঁজ নয়, কারো কারো জীবনে তুফানও এনে ফেলেছে। বেশিরভাগই যেখানে চাকরি করছেন আজ সেখানেই তাঁরা উদ্বৃত্ত। আজ হঠাৎ করে জীবনের সব হিসাব এলোমেলো। একই সঙ্গে শহুরে শিক্ষককুল, তটস্থ, ভীত সন্ত্রস্ত। সবাই ভাবছে ‘আমি উদ্বৃত্ত’। এই বুঝি বদলির নির্দেশ এল। ফলে পড়ানোতে কেউ মনোযোগ দিতে পারছেন না।
উৎসশ্রীর অপরিণামদর্শী বদলির কারণেই এমনটা। এই বদলির ফলে, স্কুলগুলির মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে (পিটিআর) বৈষম্য দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাননীয় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো, শিক্ষকের অভাবে ধুঁকতে থাকা স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত করতে ‘ র্যা শনালাইজেশন অব টিচার’ হওয়া উচিত। এতে, ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার রক্ষার পাশাপাশি মানবশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব হবে। কোর্ট এর নির্দেশে, রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ‘র্যা শনালাইজেশন অব টিচার’ সংক্রান্ত নোটিফিকেশন জারি করে। স্কুল শিক্ষা দপ্তরের যুগ্ম সচিব, স্কুল শিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন, জেলা পরিদর্শক (ডিআই)’র মাধ্যমে রাজ্যের স্বীকৃত সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত / স্পন্সরড মাধ্যমিক স্কুলগুলি থেকে ছাত্র–শিক্ষক অনুপাতের ভিত্তিতে কোথায় বিষয় শিক্ষক উদ্বৃত্ত এবং কোথায় বিষয় শিক্ষকের ঘাটতি তার তথ্য সংগ্রহ করতে। পাশপাশি, এও বলেন যে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে, উদ্বৃত্ত শিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে কিভাবে অন্ত বা আন্তঃজেলা পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে ঘাটতি শিক্ষকের অভাব মেটানো যায় তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব শিক্ষা দপ্তরের কাছে জমা দিতে।
সেই প্রস্তাব অনুযায়ী, সরকার এ বছর, এপ্রিল মাসে শহর থেকে গ্রামে উদ্বৃত্ত শিক্ষকদের বদলির কাজ চালু করেছেন। কিন্তু মজার কথা, নতুন বদলি নীতিটি কোনও আইন বলে চালু হলও তা স্পষ্ট নয়। যে সব শিক্ষক বদলির নির্দেশ পেয়েছেন তাদের সুপারিশ পত্রে বলা আছে এই বদলি, ১৯৯৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন আইনের ১০(সি) মোতাবেক। যদিও ১৯৯৭ সালে ১০ (সি) উপধারা ছিলই না, ছিল শুধুমাত্র ১০ নম্বর ধারা। যেখানে 'প্রোটেকশন অব টিচার'- বিষয়ের উল্লেখ আছে। পরবর্তীতে তিনটি উপধারা সংযোজিত হয়। যার মধ্যে ২০১৮ সালে যুক্ত করা হয়, ১০ (সি) উপধারা। সেখানেই, 'অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রান্সফার' বা ‘প্রশাসনিক বদলির’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়।
সরকার শিক্ষার প্রসারে, ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থে যে কোনও নিয়ম চালু করতেই পারেন। কিন্তু তার প্রয়োগ ও উদ্দেশ্য প্রশ্নের ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত। কিন্তু ‘র্যা শনালাইজেশন অব টিচার’-এর নামে সরকারের এই প্রশাসনিক বদলি আমাদের কিছু প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।
প্রশ্ন ১: এই বদলির প্রভাব কলকাতায় সবচেয়ে বেশি। এখনকার সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত/স্পন্সরড মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত এমনিতেই কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ৪০:১-এর কম ছিল। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ মার্চ পর্যন্ত আরও প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষককে ‘স্পেশাল ট্রান্সফার’ বা ‘বিশেষ বদলি’-র মাধ্যমে কলকাতা শহরে ফিরিয়ে আনা হলো। অন্যদিকে, কোভিডের পর একটা অংশের ছাত্র-ছাত্রী আর স্কুলমুখী হলো না। একদিকে ছাত্র সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান অন্যদিকে শিক্ষক বাড়ল। কলকাতায় পিটিআর আরও নেমে গেল। ২০২১ সালে উৎসশ্রী— যার মাধ্যমে দূরদূরান্তের শিক্ষকরা বাড়ির কাছে বদলি হলেন, তাঁদের মাত্র ৫-৬ শতাংশ গেলেন গ্রামের স্কুলে, বাকি ৯৪ -৯৫ শতাংশ ফিরলেন শহরে। স্বাভাবিক কারণেই পিটিআর অর্ধেকের কাছাকাছি নেমে এল। এখন প্রশ্ন হলো সরকারের দূরদর্শিতার অভাব এবং ভ্রান্ত নীতির ফলে এই যে পরিণতি, এর দায় কি শিক্ষকদের?
প্রশ্ন ২: স্কুল শিক্ষা অধিদপ্তর, 'উদ্বৃত্ত' শিক্ষক খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিদ্যালয় পরিদর্শককে। এই উদ্বৃত্ত শিক্ষকের সংখ্যা নির্ধারিত হবে, ২০১৭ র আগস্টে, ডেপুটি ডিরেক্টর অব স্কুলের 'সারপ্লাস টিচার' সংক্রান্ত একটি নির্দেশ মোতাবেক। সেখানে স্পষ্ট করে বলা ছিল, পিটিআর ৪০:১ ধরে কোন গ্রুপে কতজন শিক্ষক থাকবেন। পাশপাশি ১০০ পয়েন্ট রোস্টার মেনেই করতে হবে উদ্বৃত্ত শিক্ষকের তালিকা। সোজা কথায় স্টাফ প্যাটার্ন ও রোস্টার মেনে উদ্বৃত্ত শিক্ষকের সংখ্যা ঠিক হওয়ার কথা। স্কুলের প্রধানরা বিষয় ভিত্তিক বা গ্রুপ ভিত্তিক উদ্বৃত্ত শিক্ষকের তালিকা জমা দিলেন। পিটিআর মানা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোস্টার মানা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই উদ্বৃত্ত শিক্ষক নির্বাচন পক্ষপাত দুষ্ট বলেই মনে হয়েছে। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে একটা অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন ৩: কলকাতার, একটি ১২৫ বছরের পুরানো স্কুলে, নর্মাল বিভাগে ছাত্র সংখ্যার ভিত্তিতে ৪ টি বাংলা, ৪ টি ইংরেজির পদ উদ্বৃত্ত হাওয়ার কথা। রোস্টার অনুযায়ী এই ৮ পদ ঠিক কোনগুলি তার সঠিক ব্যাখ্যা কিন্তু সহ-শিক্ষকদের কাছে নেই। আবার এদের মধ্যে ইংরেজির ৩ জন উদ্বৃত্ত বলে প্রশাসনিক বদলির নির্দেশ পেলেন, অথচ বাংলার কেউ পেলেন না। তবে কি তারা উদ্বৃত্ত নন!! কিভাবে এমনটা হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তরও শিক্ষকদের কাছে নেই।
প্রশ্ন ৪: একটি স্কুলে কোনও বিষয়ে একাধিক পদ উদ্বৃত্ত হলে প্রশাসনিক বদলির নির্দেশ পাওয়ার কথা তুলনায় জুনিয়র শিক্ষকদের। অথচ বাস্তব অন্য কথা বলছে। নিউ আলিপুরে সাহাপুর সাবিত্রী বালিকা বিদ্যালয়ে ইতিহাসে যিনি উদ্বৃত্ত হলেন তিনি অনেক সিনিয়র, প্রায় অবসরের মুখে। যিনি রয়ে গেলেন তিনি তুলনায় অনেকটাই জুনিয়র। শোনা যাচ্ছে এই জুনিয়র শিক্ষিকা ডিআই অফিসের কোনও কর্তা ব্যক্তির কাছের লোক। স্বজন পোষণের এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে।
এই প্রশ্নের বাইরেও , 'র্যা শনালাইজেশন অব টিচার’ সংক্রান্ত নোটিফিকেশনের ৪(বি)’তে বলা আছে, উদ্বৃত্ত শিক্ষককে যেখানে বদলি করা হবে, সেখানে স্বাভাবিক নিয়োগের ফলে শিক্ষক যোগ দিলে, এই উদ্বৃত্ত শিক্ষক যিনি এতদিন ওই স্কুলে সার্ভিস দিলেন তাঁকে তাঁর পুরানো স্কুলে বা অন্য কোথাও ফিরিয়ে আনা হবে। যতদিন তিনি অন্য স্কুলটিতে থাকবেন ততদিন ওই উদ্বৃত্ত শিক্ষকের চাকরি সংক্রান্ত সমস্ত নথি যেমন মাইনে, ছুটি, আচরণবিধি সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি থাকবে তার মূল স্কুলে। প্রশাসনিক বদলির নির্দেশে এটার উল্লেখ নেই । শহরের এই উদ্বৃত্ত শিক্ষক চিহ্নিত করণের কাজটি সমস্ত স্কুলে সমস্ত বিষয়ের জন্য একসঙ্গে করে, সরকার যদি শিক্ষা দপ্তরের ওয়েবসাইটে আপলোড করতেন, ব্যবস্থাটির স্বচ্ছতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকত না। কেন এমনটি করা হলো না, তার উত্তর শিক্ষা দপ্তরই দিতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হলো, শহরের এই সামান্য উদ্বৃত্ত দিয়ে গ্রামের স্কুলের পিটিআর’কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ৪০:১ এ নামিয়ে আনা কি বাস্তবে সম্ভব? তথ্য ও পরিসংখ্যানের দিকে লক্ষ্য করলে চোখ কপালে উঠে যাবার জোগাড়।
চিত্র ১: মুর্শিদাবাদের অর্জুনপুর হাই স্কুল। ছাত্র সংখ্যা ১০০০০-এরও বেশি। কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষকের স্থায়ী পদ থাকা উচিত ২৫০-এর কাছাকাছি। যদিও স্কুলে স্থায়ী শিক্ষক পদের সংখ্যা ১২৩। তবে, ৬০টি পদে কোনও লোক নেই। উৎসশ্রীর আগে পিটিআর ছিল প্রায় ৯৮:১, পরে বেড়ে হলো প্রায় ১৫৯:১।
চিত্র ২: উওর ২৪ পরগনার ধুতুরদহ কল্যাণ পরিষদ হাই স্কুলের ছাত্র সংখ্যা ৪২৩০। কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্থায়ী শিক্ষক পদের সংখ্যা হওয়া উচিত কমপক্ষে ১০০। যদিও স্কুলে স্থায়ী শিক্ষক পদের সংখ্যা ৬২। ২৮টি পদে কোনও লোক নেই। এখানে উৎসশ্রীর আগে পিটিআর ছিল প্রায় ১০৩:১, পরে বেড়ে হলো প্রায় ১২৪:১।
উপরের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত, যদি সরকার গ্রামের স্কুলগুলিতে বিষয় ভিত্তিক মোট শূন্য পদের সংখ্যা জানাতেন।
তবে, উদ্বৃত্ত শিক্ষক কোনও সমাধান নয়, গ্রামের স্কুলের ঘাটতি মেটাতে প্রয়োজন স্বচ্ছ ও নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ। প্রশাসনিক প্রয়োজনে বদলির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্কুল বাছাই করে দেন। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে। একান্ত অসম্ভব না হলে, স্থানান্তরের সময়ে শিক্ষকদের সুবিধা ও প্রতিষ্ঠানের দাবি উভয়কেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। গোটা বিষয়টিতে একধরনের অনাচার চলছে । নিট ফলের বিচারে চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ পঠনপাঠনের উপযোগী ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত।
শিক্ষার শরীরটা খুব নরম। অহরহ তাকে নিয়ে কাটা ছেঁড়া চলছে। চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, এমনকী সমকালীন মূল্য বোধেরও চাপে শিক্ষা জর্জরিত। কোনও চাপে সে বেঁকে যায়। আবার কোনও চাপে ভেঙেচুরে যায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর অহরহ চাপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন দেখার বিষয় এই যে চাপের কাছে মাথা নত করে সব ভেঙে চুরে যায়, না কী চাপ সহ্য করে আমাদের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ফিরে পায় তার হৃত গৌরব ।
'র্যা শনালাইজেশন অব টিচার’ এর নামে শিক্ষকদের প্রশাসনিক বদলি সরকার আপাতত রদ করেছে। গত ১৮ জুন, শিক্ষা দফতর, স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখে বদলি আপাতত স্থগিত করার জন্য পুনর্বিবেচনা করতে বলেছে। তবে, যারা বদলির নির্দেশ পেয়েছিলেন, তাঁদের কাছে এখনও কোনও নির্দেশে এসে পৌঁছায়নি। শিক্ষকদের একাংশ ও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের ধারণা পঞ্চায়েত নির্বাচনে শিক্ষকদের লাগবে। তাদের ক্ষোভ মেটাতেই এই বদলি প্রক্রিয়া আপাতত রদ। ভোট মিটলে আবার তেড়ে ফুঁড়ে লাগবে।
Comments :0